জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস
আজ নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার দিন

‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।’ এই ছত্রটি গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাসের (১৬) লেখা চিঠির অংশ।
গত বছরের ৫ আগস্ট মা-বাবাকে না জানিয়ে বাড়িতে চিঠি লিখে সে গিয়েছিল মিছিলে। ওই দিন রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলিতে শহীদ হয় আনাস।
এমনই আরও বহু কিশোর-তরুণ-যুবা মিছিলে, আন্দোলনে যোগ দিয়েছে পরিবারকে না জানিয়ে। কেউ ফিরেছে, কেউ আর ফেরেনি বাবা-মায়ের কোলে। শ্রমিক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, গৃহিণীরা নেমে এসেছেন পথে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিশে লড়েছেন নানা ভূমিকায়। পুলিশ আর সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলি-বোমা, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড উপেক্ষা করে হটিয়েছেন স্বৈরাচার।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ ৫ আগস্ট। দিনটি আন্দোলনের ধারাবাহিকতার সূচক ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। এক বছর আগে এই দিনে পূর্ণতা পায় জুলাই আন্দোলন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ। হাজির হয় এক নতুন বাংলাদেশ।
যেভাবে ৫ আগস্ট
১৪ জুলা্ই থেকে সরকারের দমন-পীড়ন, ১৪৪ ধারা, কিংবা কার্ফ্যু কোনো কিছু দমিয়ে রাখতে পারেনি ছাত্র-জনতাকে। ১৬ বছর ধরে নির্যাতিত বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরাও সব ভয় পেছনে ফেলে নেমে আসেন রাজপথে। স্বৈরাচারী আর লুটেরা সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ছাত্র-জনতার এক বিরল ঐক্য তৈরি হয় বাংলাদেশে।
এমনকি সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসাররা জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান। তারা জনগণের পাশে থাকবেন- এ কথা জানিয়ে দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশে ঘোষণা করেন এক দফা- শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে ৬ আগস্ট গণভবন ঘেরাওয়ের ডাক দেন তিনি। ঢাকার বাইরে সারা দেশেও ঘোষিত হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি। আর মানুষ প্রস্তুত হতে থাকে ‘মার্চ টু ঢাকা’র জন্য।
এই দ্রোহের ঢেউ সামলানো কারও সাধ্য ছিল না। তবু মরণ কামড় দিতে শেখ হাসিনা ৩ আগস্ট তার দলের নেতাকর্মীদের সশস্ত্র হয়ে মাঠে নামার নির্দেশ দেন। বিভিন্ন বাহিনীকেও আন্দোলন দমনে আরও বেশি বল প্রয়োগ ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে বলেন। আর একই সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিজের আত্মীয়স্বজনদের বার্তা পাঠান- ‘নো ওয়ান স্টে হিয়ার’।
৪ আগস্ট সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের পাশাপাশি পিস্তল-রাইফেল, রামদা-তলোয়ারসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের অন্য অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারতে থাকে তারা। তাদের গুলিতে রেহাই পায়নি বারান্দায় দাঁড়ানো শিশুও।
সেদিন শতাধিক মানুষের মুত্যু হয় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে। সন্ধ্যার আগেই সারা দেশে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আসে। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় কে বা কারা হামলা চালিয়ে ১২ পুলিশকে হত্যা করে। এক অনিশ্চিত আর ভীতিকর পরিবেশ সারা দেশে।
সরকার অনিদিষ্টকালের জন্য কার্ফু জারি করে। বন্ধ করে দেয় ইন্টারনেট। এর মধ্যে রাত নয়টায় সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ হাজির হন টিভি পর্দায়। দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি আর সরকারের নৃশংসতার কথা তুলে ধরে তিনি ৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট আনার ঘোষণা দেন। সবাইকে মসজিদের মাইকে এই ঘোষণা প্রচার করার আহ্বান জানান তিনি। আরও বলেন, তাদের হয়তো মেরে ফেলবে সরকার। যদি তা-ই ঘটে, তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সবাই সমন্বয়ক। জনগণ যেন নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলন সফল করেন। ৫ আগস্ট গণভবন ঘেরাওয়ের জন্য রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আহ্বান জানান আসিফ।
৫ আগস্ট। ভোর থেকে থমথমে রাজধানী ঢাকা। ঢাকার প্রবেশপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সাজোয়াঁ যান নিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান। মোড়ে মোড়ে মারমুখী পুলিশের কঠোর তল্লাশি। কোথাও কোথাও গুলি বর্ষণ। কী হতে যাচ্ছে কেউ জানে না।
কিন্তু ঢাকার আশপাশ থেকে মানুষ কার্ফ্যু ভেঙে নামতে থাকে পথে। সবার গন্তব্য রাজধানী, গণভবন। উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, গাবতলী, পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়, প্রগতি সরণি, বাড্ডা, রাজধানীর সব প্রবেশপথে হাজারো জনতা জমায়েত হতে থাকে। পুলিশ কোথাও কোথাও তখনো আন্দোলন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানায়। দুপুর নাগাদ খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করছেন।
এরপর আর কোনো বাঁধ মানেনি জনতা। ঢাকার চারপাশ থেকে ছাত্র-জনতার স্রোত গণভবনের দিকে ছুটতে থাকে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করে সামরিক কার্গো বিমানে ভারতে পালান শেখ হাসিনা।
ধাবমান জনতার এক অংশ গণভবনে প্রবেশ করে, এক অংশ সংসদ ভবন, আরেক অংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দখল নেয়। এ এক অভুতপূর্ব দৃশ্য।
রাজধানীসহ সারা দেশের নগর-শহর-বন্দরের মানুষ নেমে আসে পথে। অলি-গলিও জনাকীর্ণ। সেদিন কেউ ঘরে থাকেনি আর। পথে পথে উদযাপন করে সফল গণঅভ্যুত্থানের আনন্দ।
আবু সাঈদের পর ৮৩৬ শহীদ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাত্র ২০ দিনে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে। স্বৈরাচারবিরোধী জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ। ১৬ জুলাই পুলিশের তাক করা বন্দুকের সামনে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে তার বুক পেতে দেওয়া এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার ছবি বিপ্লবের আইকন হয়ে ওঠে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এই ছবি ভাইরাল হয়।
এরপর প্রতিদিন বড় হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। এই মিছিলে শহীদ হয়েছে ১৩৩ শিশু। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশু তারা। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ১১৭ জন।
সবচেয়ে কম বয়সী শহীদ শিশুটি ৪ বছরের আবদুল আহাদ। যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে নিজ বাসার বারান্দায় ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আহাদের। গণঅভ্যুত্থানে প্রথম কোনো শিশু শহীদ হয় ১৭ জুলাই। মো. সিয়াম (১৫) নামের শিশুটি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
দিন যত এগিয়েছে, শহীদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ (রোববার, ৩ আগস্ট) প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৮৩৬।
‘গুলির নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা’
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র–জনতার বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি হামলা ও গুলি করে আওয়ামী লীগ (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। এটি এখন নানাভাবে প্রমাণিত। তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এই সহিংস মরিয়া অপচেষ্টার সিপাহসালার ছিলেন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ মামুন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে মনে করেন দেশের মানুষ। তবে মানবাধিকার অপরাধ হিসেবে গণ্য করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ-প্রধানের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দিব উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
রাষ্ট্রপতির বাণী
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে গতকাল (সোমবার, ৪ আগস্ট) এক বাণীতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ বলে মন্তব্য করেছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আজ ঐতিহাসিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ২০২৪ সালের আজকের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।’
ঐতিহাসিক এই অর্জনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান তিনি। একই সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সকল শহীদকে এবং আহত, পঙ্গুত্ব বরণ করা ও দৃষ্টিশক্তি হারানো সব বীর জুলাই যোদ্ধাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার বাণী
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বাণীতে বলেন, ‘জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো- একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।’
পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনও দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত উল্লেখ করে বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।’
গণঅভ্যুত্থান দিবসের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ (৫ আগস্ট)। এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের মুখবন্ধ আন্দোলনের ফসল আমাদের এই ঐতিহাসিক অর্জন, তাদের সবাইকে আমি এই দিনে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আজ আমি স্মরণ করছি সেই সব সাহসী তরুণ, শ্রমিক, দিনমজুর, পেশাজীবীদের, যারা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। আমি গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি সকল জুলাই যোদ্ধাকে যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।’
(ঢাকাটাইমস/৫আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন