সমুদ্রের ‘সবুজ সোনা’ শৈবাল চাষে অপার সম্ভাবনা

আশিকুর রহমান, পটুয়াখালী থেকে
  প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৭:০৪
অ- অ+

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের থাবা দিন দিন গভীর হচ্ছে। লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় এবং মৎস্যসম্পদ হ্রাসের মুখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা আজ হুমকির সামনে। এই সংকটের মাঝেই জেগে উঠেছে এক অপার সম্ভাবনা- সামুদ্রিক শৈবাল (সিউইড) চাষ। একে বলা হচ্ছে সবুজ সোনা

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্ট এবং এআইআরডির (AIRD) যৌথ উদ্যোগ পাইলটিং স্মল স্কেল ম্যাক্রোঅ্যালগি কালচার ফর আমেলিওরেটিং লিভলিহুড অব কোস্টাল কমিউনিটিস অ্যান্ড এড্রেসিং কার্বন-ডাই অক্সাইড রেমিডেশন প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই আনবে না, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায়ও রাখতে পারে অনন্য অবদান।

বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকা এবং ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় জলরাশি সিউইড চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০০ প্রজাতির সিউইড পাওয়া যায়, যার মধ্যে ১৯টি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে উলভা ইনটেসটিনালিস (Ulva intestinalis) অন্যতম, যা স্থানীয়ভাবে ডেললা নামে পরিচিত। এটি সহজে চাষযোগ্য এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর; দ্রুত বৃদ্ধি পায়, লবণাক্ত পানিতে টিকে থাকে এবং পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে।

সামুদ্রিক সবজি

প্রধান গবেষক ড. মো. রাজীব সরকারের ভাষ্য, সামুদ্রিক শৈবালকে আমি সামুদ্রিক সবজি বলে থাকি। কারণ এটিতে উচ্চ মানের প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস রয়েছে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সিউইড থেকে বায়োপ্লাস্টিক, বায়োডিসেল তৈরি করা যায়।

তারা প্রকল্পে সিউইড থেকে কিছু ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করেন জানিয়ে প্রধান গবেষক বলেন, এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে আয়রনের অভাব পূরণ করে এবং মানুষের মানসিক হতাশা দূর করে। প্রতি কেজি শুকনো শৈবাল ০.৫ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে।

প্রকল্পের সাইট হিসেবে বরগুনার কুয়াকাটা, লেবুরচর, গঙ্গামতি ও চোরপাড়া অঞ্চলে রশি ও জালের মাধ্যমে শৈবাল চাষ করা হয়। স্থানীয় জেলেরা এতে সরাসরি অংশ নেন। গঙ্গামতি ও লেবুরচরে শৈবালের ফলন সবচেয়ে বেশি। এই শৈবাল চাষের পদ্ধতি অনেক সহজ। এতে জমি বা রাসায়নিক সারের প্রয়োজন নেই।

শৈবাল দিয়ে যত পণ্য

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, উলভা শৈবালের গুঁড়া থেকে তৈরি হচ্ছে নানা রকম মূল্য সংযোজিত পণ্য, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে নতুন গতি দিতে পারে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা তৈরি করেছে নানা রকম পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারসহ ব্যবহারিক জিনিসপত্র; যেমন-

নরি শিট: এটি জাপানি সুশিতে ব্যবহৃত হয় ও প্রোটিনসমৃদ্ধ।

সিউইড ট্যাবলেট: আয়োডিন, আয়রন, ভিটামিন ১২ ও খনিজ সমৃদ্ধ এই ট্যাবলেট হজম ও থাইরয়েড হরমোন ব্যালান্স করতে সাহায্য করে।

সিউইড আইসক্রিম: ২৫ শতাংশ দুধের পরিবর্তে উলভা ব্যবহার করে খনিজ সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর এই খাবার শহুরে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে।

এ ছাড়া সিউইড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিস্কুট, জিলাপি, মিষ্টি, রোল। সাবান ও ফেসপ্যাকও তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় বাজার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হতে পারে।

পরীক্ষামূলকভাবে এসব পণ্য ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। ফেসপ্যাক ব্যবহার করে এক শিক্ষার্থী মাহজাবিন বলেন, এটি ব্যবহারে ত্বক নরম ও মসৃণ থাকে। সেই সাথে ত্বক ঠান্ডা রাখে।

বিভিন্ন খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীরা এই পণ্যগুলোর ব্যাপারে অনেক সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন। আশিকুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি সিউইড সম্পর্কে আগে শুনেছি, এখন খেয়ে দেখলাম। আসলেই এগুলোর স্বাদ অতুলনীয়। এগুলো বাজারে এলে ভালো চাহিদা পাবে বলে আমি আশাবাদী। সেই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

জলবায়ু ও কর্মসংস্থান বান্ধব

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সিউইড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সিউইড চাষের মাধ্যমে প্রতি কেজিতে প্রায় ০.৭ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষিত হয়। এটি ব্লু কার্বন ধারণার অন্তর্ভুক্ত, যেখানে সামুদ্রিক উদ্ভিদ কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়তা করে।

সিউইড চাষে যুক্ত হয়ে লাভবান হতে পারবে স্থানীয় জেলে, নারী ও বেকার যুবকরা। ইউএনডিপি, আইএলও এবং ইনোভিশন কনসালটিংয়ের মতো সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা হচ্ছে। কক্সবাজারে একটি ৪৫-৬০ দিনের চাষচক্রে একজন চাষি গড়ে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

এটি রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বিশ্বে সিউইডের বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এর সম্ভাবনা অফুরন্ত। এআইআরডির সহকারী গবেষক ড. মো. আরিফুল আলমের ভাষায়, এই সিউইড উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। সিউইডে থাকা ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুর মেধা বিকশিত করে, গ্যাস দূর করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই সম্ভাবনা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে উপকূলীয় অঞ্চল হবে টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল।

সর্বোপরি উলভা শৈবাল শুধু একটি সবুজ উদ্ভিদ নয়, এটি উপকূলবাসীর জন্য আশার বার্তা বয়ে এনেছে। জলবায়ু সংকটের এই যুগে, প্রকৃতির সহজ সমাধানই হয়তো আমাদের রক্ষার শেষ অবলম্বন। সমুদ্র আজ শুধু মাছের ভাণ্ডার নয়, এটি হয়ে উঠতে পারে সবুজ অর্থনীতির নতুন চাবিকাঠি ।

(ঢাকাটাইমস/২৩আগস্ট/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের নৈশভোজ
এক বছরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল ব্যাপকভাবে বেড়েছে: জামান মোল্লা
সরকারি খরচে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ১২ লাখের বেশি মানুষ
জনভোগান্তি এড়াতে রাজধানীর ৯১টি স্থানে সভা-সমাবেশ করার প্রস্তাব ডিএমপির
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা