এই গফুর, সেই গফুর

তায়েব মিল্লাত হোসেন
 | প্রকাশিত : ০৪ জুলাই ২০১৭, ১৭:০০

গরুকাণ্ডে উন্মাতাল ভারতবর্ষ। গো-রক্ষার নামে যারা মানুষের উপর হামলে পড়ছে, হত্যা করছে- তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে সেই দেশের নাগরিক সমাজ। গত কিছুদিনে তারা অনেক বেশি সোচ্চার হয়েছেন। তাদের মতো সুর তুলেছেন এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। যারা গো-মাতার সুরক্ষার নাম করে মানুষের খুনে হাত রাঙাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ভাষ্য দিয়েছেন তিনি। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মোদির হুঁশিয়ারির কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রামগড়ে উগ্রবাদীদের শিকার হয়ে একজন প্রাণ দিয়েছেন। বহুত্ববাদের আদর্শ হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে ভারতকে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হবে। সেই ভাবনা আমরা তাদেরই ভাবতে দেই।

কেউ কেউ কিন্তু এতে একমত হননি, হতে পারছেন না। একদা আমরা দেখেছি, মস্কোয় বৃষ্টি হলে আমাদের বামরা ঢাকায় ছাতা ধরতেন। দিল্লির সমস্যায় একই রকমের কিছু নমুনা মিলছে। এই বেলায় সামনে আছেন ডানরা। এই জুলাইয়ের দ্বিতীয় দিনে বৃষ্টিভেজা আষাঢ়ে তাদের হা-হুতাশের ছাতা দেখা দিলো ডিআরইউতে। যথারীতি ছিলেন ডানধারার লেখক-সাংবাদিক-প্রকৌশলী তথা পেশাজীবীগণ। এই আস্ফালন প্রায়ই হয়ে থাকে। এ নিয়ে তেমন কারও আপত্তি নেই। কেউ মাথাও ঘামান না। নিশিদিন এই মেঘবৃষ্টি আবহাওয়ায় সবার মাথা ঘামতে শুরু করলো পরের দিন। যখন ফরহাদ মজহার নিজ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হলেন। নাকি যাত্রা করলেন! কে জানে! তিনি বাসা থেকে লাপাত্তা আসলে সোমবার ভোর ভোর থাকতে। আর দেশবাসী জানতে পারলো দুপুরে। যাই হোক রাজপথের বিরোধীরা কাঁধে মোক্ষম একটা তুণ পেয়ে গেলেন। তারা বলতে থাকলেন, সরকারের উদ্যোগেই নাকি ফরহাদ মজহারকে তুলে নেয়া হয়েছে। যারা আরো এক কাঠি সরেস, তাদের ভাষ্য, আগের দিন গোরক্ষার বিরুদ্ধবাদী এক সভায় ছিলেন সাবেক বাম থেকে বাউল হয়ে ডানের পথ ধরা কবি-দার্শনিক-বুদ্ধিজীবী মজহার সাহেব। তাই তাকে ভারতের পথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার অবস্থান নিয়ে দিনভর ক্ষণে ক্ষণে যে তথ্য তাতেও কিন্তু ছিল সেই ইঙ্গিত।

শ্বেত-শুভ্র লুঙ্গি-ফতুয়ার কবিকে উদ্ধারে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব নিরাপত্তা শাখার কর্মীদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। ঢাকা-খুলনা-যশোর, কোথায় না খুঁজেছেন তারা। শেষে সাফল্য মেলে রাত সাড়ে ১১টায়। খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে দেখা মেলে ফরহাদ মজহারের। বাসটি ততক্ষণে চলে এসেছে যশোরের অভয়নগরে। এতে ভয় দূর হয় দেশবাসীর। কারণ কট্টর এই দার্শনিকের কিছু হওয়ার জন্যে নিশ্চয় অগ্নি-বোমা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো বিএনপি-জামায়াত। বিবৃতির তীর নিয়ে বসে ছিলো দেশি-বিদেশি অধিকার-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান।

ফরহাদ মজহারের উদ্ধারের পরের পর্ব চলছে এখন। সোমবার রাতে খুলনার এক রেস্তোরাঁয় তার পাতে যে ভাত-ডাল-সবজি ছিলো তার সাক্ষী মিলছে। কোনো প্রকারের মাংস যে ছিলো না, তা জেনে কী একটু নিরাশ হলো অন্ধ ভারতবিরোধী মহল? প্রাণীপ্রেমী মজহারের অভিযানে গফুর যে ছিলেন, তারও কিন্তু দলিল-দস্তাবেজ আছে। খুলনা থেকে ঢাকার বাস ধরার সময় তিনি নিজেই টিকিটে মি. গফুর নাম ব্যবহার করেন।

সাহিত্য পড়ি বা না পড়ি, গফুর আমাদের সবার প্রিয়, সবার পরিচিত মুখ। কারণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পখানি আমাদের মাধ্যমিকের পাঠে আবশ্যক ছিলো। গরুর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার বিপরীতে বকধার্মিকতার সমাজ বাস্তবতা সযতনে তুলে ধরেছেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আসুন তার একটু দেখে নেই শেষাংশে-

‘‘গফুর কহিল, দেরি করিস নে মা, চল্‌, অনেক পথ হাঁটতে হবে।

আমিনা জল খাইবার ঘটি ও পিতার ভাত খাইবার পিতলের থালাটি সঙ্গে লইতেছিল, গফুর নিষেধ করিল, ও-সব থাক্‌ মা, ওতে আমার মহেশের প্রাচিত্তির হবে।

অন্ধকার গভীর নিশীথে সে মেয়ের হাত ধরিয়া বাহির হইল। এ গ্রামে আত্মীয় কেহ তাহার ছিল না, কাহাকেও বলিবার কিছু নাই। আঙ্গিনা পার হইয়া পথের ধারে সেই বাবলাতলায় আসিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া সহসা হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লা ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ'রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক'রো না।’’

গল্পের প্রধান চরিত্র গফুর বাস্তবিকই নিঃস্বার্থ গরু-প্রেমী ছিলেন। মহেশ নামের গরুটির প্রতি তার দরদে কোনো খাদ ছিলো না। কিন্তু আজকালকার গো-ভক্ত বলুন, আর সেইরকম গরুখোর বলুন, সবার মধ্যেই মতলব আছে। সেই কালের ধর্মান্ধদের ঘাই দিতে একটি বোবা-প্রাণী গরুর নাম দিয়ে ‘মহেশ’ গল্প লিখেছিলেন শরৎবাবু। এ কালের মতলববাজদের বিরুদ্ধে কে লিখবেন? গফুর নামের প্রতি অবিচারের বিচার কে করবে?

যাই হোক, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, অংশুমান রায়ের সুরে শিল্পী ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত একটি গান আছে-

শরৎবাবু,

খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে

তোমার ‘গফুর এখন

কোথায় কেমন আছে?

আমাদের এই কালের মি. গফুর কোথায়, কেমন থাকছেন সময়ে সময়ে আমরা জানতে পারছি। সেই গফুররা আজো যে সমস্যায় আছে, তার সমাধান হলে ভালোই হবে। নানান রূপে তারা তো আমাদের ঘরেও আছে! পরের ঘরে অযাচিত উঁকিঝুঁকি মারা কিন্তু অসামাজিক কাজ। তার মধ্যে ঘরের ভেতর ঘোঁট পাকানোর চালাকিও বর্তমান। অতএব, সাধু সাবধান!

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :