স্মৃতির পাতায় শেখ কামাল-১

প্রতিটি কর্মীর প্রতি কামাল ভাইয়ের ছিল অসীম ভালবাসা

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩০ | প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট ২০১৭, ১৭:২৬
ছবিতে ডানদিকে শেখ কামাল এবং সবচেয়ে বায়ে লেখক

আজ ৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ভাইয়ের জন্ম দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে ৩২ নাম্বার নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। তখন আমি জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর শাখার ১৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য। বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের ট্রাজেডি নিয়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমি সেদিকে না গিয়ে জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে নিয়ে কিছু কথা লিখতে চাই। কারণ ১৯৭২ থেকে পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত আমার ছাত্র রাজনীতির মধ্যমনি ছিলেন শেখ কামাল ভাই। এই সময় ঢাকা শহরের ছাত্র রাজনীতির অনেক ঘটনার সাথে তিনি ছিলেন সরাসরি জড়িত।

কামাল ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তবে বঙ্গবন্ধুর সাথেও সরাসরি দেখা হয়েছে কয়েকবার। শেষ দেখা হয়েছে কামাল ভাই ও শেখ জামালের রিসিপশন অনুষ্ঠানে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এইসময় বঙ্গবন্ধু শেখ কামাল ভাই ও শেখ জামালের বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে গণভবনে করেছিলেন। শুধু তাই নয় বিলাসিতা পরিহার করে আগত অতিথিদের জন্য শুধুমাত্র পরোটা আর গোস্ত পরিবেশন করা হয়েছিল।

আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখন যেখানে থাকেন এই গণভবনে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠান। সন্ধ্যার দিকে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এসে গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করে আমি, নুরু ভাই, ইউনুস ও রউফ বঙ্গবন্ধুর পায়ের ধুলা নিতে গেলে তিনি একে একে আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘নগর পালরা এসেছে।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের নগরপাল বলে সম্বোধন করতেন।

এর আগে একবার ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্যদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে রমনা পার্কের পাশে পুরাতন গণভবনে গিয়েছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ (তোফায়েল ভাই) উপস্থিত ছিলেন। আরেকবার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বেতন মওকুফের দাবি নিয়ে পারভীন সুলতানা (লন্ডন প্রবাসী) ও নাজমা বেগমের (কেনাডা প্রবাসী) নেতৃত্বে একটি মিছিল সংগঠিত করে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কামাল ভাইয়ের সাথে মিলিত হতে অনেকবার যাওয়া হলেও একবার আমরা নেতার ৩২ নম্বর বাসভবনে গিয়ে দেখা করে কামাল ভাইকে বিদেশে না পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলাম।

এই বাসভবনের পেছনের বারান্দার একটি রুমে থাকতেন ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম (শহীদ ভাই)। নুরু ভাইয়ের সাথে শহীদ ভাইয়ের রুমে গিয়ে মহানগর ছাত্রলীগের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে কয়েকবার।

১৯৭২-৭৩ সাল। আমি তখন ঢাকা আইডিয়াল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন মাদারীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া। ওই সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মমতাজ হোসেন (৭২-৭৩)। তিনি পরবর্তীতে ব্রুনাইতে হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি ৭১ মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেনl কলেজ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিদিন সন্ধায় আমাকে মিরপুর রোডে ছাত্রলীগ মহানগর অফিসে (ঢাকা নিউমার্কেটের নিকটে টিচার্স কলেজের ঠিক উল্টো দিকে) যেতে হতো। উপর তালায় কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস আর নিচের তালায় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অফিস। এখানেই একদিন কামাল ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নুরু ভাই।

কামাল ভাই। শেখ কামাল হিসেবে যিনি সকলের কাছে পরিচিত। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কামাল ভাই জেনারেল ওসমানীর পাশে থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পুনরায় শিক্ষা জীবনে ফিরে আসেন।

এই সময় কামাল ভাই ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন শেখ শহীদুল ইসলাম (বর্তমানে মহাসচিব জেপি), সাধারণ সম্পাদক এম এ রশিদ (বর্তমান অবস্থান জানা নেই)। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ দেখাশুনা করতেন কামাল ভাই। এই কামাল ভাইকে নিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবনের অনেক স্মৃতি আছে যা চিরদিন স্বরণীয় হয়ে থাকবে।

কামাল ভাইয়ের অত্যন্ত প্রিয় ও বিস্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরু ভাই। ওই সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখার জন্য কামাল ভাই নুরু ভাইয়ের উপর অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। কামাল ভাইয়ের একজন বিস্বস্ত ও একনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে নুরু ভাইয়ের জনপ্রিয়তা ছিল অসীম। তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি (৭৩-৭৪)।

এই নুরু ভাই পরে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতি পরোক্ষভাবে তদারকি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন রউফ শিকদার (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা), মোহাম্মদ ইউনুস (বর্তমানে ব্যবসায়ী) ও আমার উপর। নুরু, রউফ, ইউনুস ও ডাবলু এই চারটি নাম এই সময় কামাল ভাইয়ের কাছের মানুষ হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগে সুপরিচিতি লাভ করে। যার কারণে কামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের আলাদাভাবে দেখা শুনা হতো একটু বেশি।

আমাদের এই গ্রুপকে কামাল ভাই একটু আলাদাভাবে দেখতেন বলে অনেকেরই ঈর্ষা হতো। ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাসার ড্রইং রুমের টেবিলের চারপাশে বসে আমাদের মিটিং হয়েছে অনেকবার। গেল ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন পরিদর্শন করতে গিয়ে কালের সাক্ষী সেই টেবিলটি এখনো ড্রইং রুমে দেখতে পেলাম। পেছনের বারান্দায় শহীদ ভাইয়ের সেই রুমটি খালি হয়ে পরে আছে।

ঢাকা মোহাম্মদপুর থানা ছাত্র লীগের সন্মেলন

চুয়াত্তরের কোনো এক সময় ঢাকা মোহাম্মদপুর থানা শাখা ছাত্রলীগের সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কামাল ভাই আর নুরু ভাই একদিন সন্ধায় ছাত্রলীগ অফিসের সামনে আমাকে বললেন মোহাম্মদপুর থানা শাখার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। আমি তখন ঢাকার সোবহানবাগ সরকারি কলোনির বাসিন্দা। ওই সময় সাংগঠনিক দিক থেকে সোবহানবাগ মোহাম্মদপুর থানা শাখার আওতায় ছিল। ছাড়াও আর যে যে অঞ্চল এই থানা শাখার অধীনে ছিল সেগুলো হলো শুক্রাবাদ, লালমাটিয়া, কলেজ গেট, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার, কাটাসুর ও জিগাতলা। কয়েকদিন চিন্তা ভাবনা করে নুরু ভাইয়ের মাধ্যমে কামাল ভাইয়ের কাছে আমার সন্মতির কথা জানিয়ে দিলাম।

নির্ধারিত দিন মোহাম্মদপুর বাজার সংলগ্ন শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো ছাত্রলীগ মোহাম্মদপুর থানা শাখার বার্ষিক সন্মেলন। সন্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেখ কামাল ভাই। তিনি শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে একটি লিখিত কাগজ হাতে নিয়ে একে একে কমিটির নাম ঘোষণা করলেন।

কামাল ভাইয়ের ঘোষণা অনুসারে মোহাম্মদপুর থানা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন বাদল ভাই (একটি সরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন)। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কামাল ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। সহসভাপতি কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদপুরের বরকত ভাই (বর্তমানে ব্যবসায়ী)। আর আমাকে করা হয়েছিল সাধারণ সম্পাদক।

কমিটিতে সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইকবাল। যিনি পরে মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। কমিটি ঘোষণার সাথে সাথে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আমরা নব নির্বাচিত কমিটি কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করি।

খুব সম্ভবত সময়টা চুয়াত্তর সালের শেষের দিকে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ রাজনীতিতে কামাল ভাইয়ের একজন প্রিয়, বিস্বস্ত ও কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। কামাল ভাই তার সারাদিনের কাজের শেষে প্রায়ই ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে এসে আমাদের সকলের খোঁজ খবর নিতেন। কামাল ভাই যেমন ছিলেন কোমল তেমনি ছিলেন সাহসী। ঢাকা মহানগরের কর্মীরা ছিল তার প্রাণের চেয়েও বেশি।

ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর

২৯ জুন, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা আসেন। ঢাকার মিরপুর মোহাম্মদপুরের বিহারী, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও জামায়াত, মুসলিম লীগ পন্থিরা ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘স্বাগতম’ ও স্লোগান দিয়ে বিপুলভাবে স্বাগত জানায়। এটি ছিল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির জন্য এক বিরাট অপমান, এক বিরাট আঘাত, এক বিরাট কলঙ্ক, এক বিরাট পরাজয়।

ভুট্টো, যার কারণে বাংলাদেশে লক্ষ্ লক্ষ্ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই মানুষটিকে মাত্র এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বড় সম্বর্ধনা! ভাবলাম, এর একটা বিহিত অবশ্যই করা উচিত। ভুট্টোকে বুঝতে হবে বাংলার স্বাধীনচেতা মানুষ তোমাকে চায় না। যারা তোমাকে স্বাগত জানিয়েছে তারা মুষ্টিমেয় পাকিস্তানের দালাল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। ওই দিন সন্ধ্যায় মিরপুর রোডে ছাত্রলীগ অফিসে আমরা সকলে মিলিত হলাম। ছাত্রলীগ কর্মীদের চোখে মুখে তখন সংগ্রামী প্রতিবাদী কন্ঠ আগুনের মত জলছে। এত বড় অপমান কী করে সহ্য করা যায়? ভুট্টোকে দেখাতে হবে, প্রতিবাদ করে বলতে হবে, আমরা তোমার রক্ত মাখা হাতের কথা ভুলিনি, কখনো ভুলবো না, ভুলতে পারি না।

রাতে ছাত্রলীগ অফিসে বসে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, সাংগঠনিক তফাজ্জল হোসেন (বর্তমানে ঢাকার যাত্রাবাড়ী আওয়ামী লীগ নেতা) প্রচার সম্পাদক আব্দুর রউফ শিকদার (বর্তমানে ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা) মোহাম্মদ ইউনুস পাঠাগার সম্পাদক (বর্তমানে ব্যবসায়ী), আমি সমাজসেবা সম্পাদক (বর্তমানে কাউন্টি কাউন্সিলার স্টকহলম কাউন্টি কাউন্সিল) সহ আরো অনেকে একসাথে সিদ্ধান্ত নিলাম ভুট্টোকে আগামীকাল অর্থাৎ ৩০ জুন সাভার সৃতিসৌধে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি। সকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন সাভার স্মৃতিসৌধে মাল্যদানে যাবেন তখন আমরা তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন করব।

সিদ্ধান্ত অনুসারে সারা রাত ধরে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হলো। শুরু হলো পোস্টার আর ব্যানার লেখার কাজ। রাতে ঢাকা নিউমার্কেট পোস্ট অফিস সংলগ্ন আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে গিয়ে পোস্টার ও ব্যানার লেখার জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়। সারারাত ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ, সেন্ট্রাল কলেজ, ইডেন কলেজসহ আসে পাশের অন্যান্য কলেজগুলোতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের খুব ভোরে মিরপুর রোডে ছাত্রলীগ অফিসের সামনে আসতে বলা হলো।

ওইদিন রাতে আমরা কয়েকজন তেজগাঁও রেল ক্রসিং এর পাশে গিয়ে কয়েকটি ট্রাক ভাড়া করি। গভীর রাতে আমাদের কর্মতৎপরতার খবর পেয়ে উৎসাহ দেয়ার জন্য কামাল ভাই ছুটে আসেন। আমি আগেই বলেছি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ ছিল কামাল ভাইয়ের প্রাণ প্রিয় সংগঠন, অতি প্রিয় সংগঠন। আমাদের সকলকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই এত রাত হওয়া সত্তেও তিনি আমাদের পাশে এসে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি। কামাল ভাইকে এত রাতে ছাত্রলীগ অফিসে আসতে দেখে কর্মীদের মনে আরো প্রেরণা ও উৎসাহ আরো বৃদ্ধি পায়।

পরদিন সকালে কয়েকটি ট্রাকে করে সাভার সৃতিসৌধের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। এই সময় আমাদের মুখে ছিল স্লোগান ও হাতে ছিল ব্যানার আর প্লাকার্ড। এখানে এসে আমরা সকলেই রাস্তার দুই পাশে দাড়িয়ে চিৎকার দিয়ে স্লোগান দিতে থাকি। পুরো এলাকা ঘিরে দেশি বিদেশি সাংবাদিক ক্যামেরা হাতে ভুট্টোর জন্য অপেক্ষায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভুট্টো সাহেব ঢাকা তেজগাঁও বিমান বন্দরে এত সংবর্ধনা দেখে ঢাকা থেকে সড়ক পথে সাভার এসে মাল্যদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে আমাদের প্রতিবাদী মিছিল আর স্লোগানের কথা শুনে নিরাপত্তার অজুহাতে ভুট্টো তার সে পরিকল্পনা বাতিল করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি রাশিয়ান সবুজ রঙের হেলিকপ্টারে কয়েক মিনিটের জন্য মাল্যদান করে তৎক্ষনাৎ সাভার স্মৃতি সৌধ ত্যাগ করে চলে যান।

এই সময় ভুট্টোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। ভুট্টোর মাল্যদানকালে আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রচণ্ড আওয়াজে স্লোগান দিতে থাকি, ‘লং লিভ লং লিভ শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক কিলার ভুট্টো কিলার ভুট্টো’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’।

স্মৃতি সৌধের চারিদিকে তখন লোকে লোকারণ্য। ওখানে রক্ষী বাহিনীর লোকও ছিল অনেক। কারণ রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প স্মৃতিসৌধের খুব কাছেই ছিল। মাঝখানে খালে পানি থাকাতে আমরা কেউই নিকটে যেতে পারছিলাম না। হঠাৎ একসময় ছদ্মবেশে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আর বিহারীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কলাবাগানের হারুনের (এখনো কলাবাগানের স্থায়ী বাসিন্দা) মাথায় আঘাত লেগে ফেটে যায়। তাকে একটি ট্রাকে করে দ্রুত ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের মাথায় আহসান ক্লিনিকে নিয়ে আসি।

খবর পেয়ে কামাল ভাই সাথে সাথে ক্লিনিকে ছুটে আসেন এবং আহত হারুনের মাথায় হাত রেখে স্নেহের দৃষ্টিতে সান্তনা দিতে থাকেন। এই সময় কামাল ভাই আমাকে বললেন, সব দিক দিয়ে হারুনকে খেয়াল রাখার জন্য। তার চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয়। কামাল ভাইকে পাশে দেখে রক্তাক্ত হারুন আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘কামাল ভাই, আমি রাজাকারদের দেখিনি, ওরা পেছন থেকে আমাকে আঘাত করেছে। সামনা সামনি হলে দেখে নিতাম।’

এই হলো আমাদের কামাল ভাই। যার মন, যার প্রাণ, যার সব কিছুই ছিল ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীদের জন্য। প্রতিটি কর্মীর প্রতি কামাল ভাইয়ের ছিল অসীম ভালবাসা।

চলবে...

লেখক: কাউন্টি কাউন্সিলার স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল, সুইডিশ লেফট পার্টি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :