কাছ থেকে দেখা দক্ষিণ কোরিয়া

মোহাম্মদ হানিফ
| আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:২৯ | প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৩৯

উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এটি বিশ্বে তৃতীয় প্রযুক্তির দেশ। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে আজ দক্ষিণ কোরিয়া উন্নতির শিখরে উঠে গেছে। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়ে দেশটিতে। দক্ষিণ কোরিয়ার চোখ-ধাঁধাঁনো উন্নতির পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে উন্নতমানের শিক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে আসে। বর্তমানে ১৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখেরও বেশি বিদেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশির সংখ্যাও অনেক, যাদের অধিকাংশই বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করছে।

কোরিয়া নামক দেশটির নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে কুকুর ও শূকর খাওয়ার দৃশ্য। কোরিয়ানদের কুকুর ও শূকর খাওয়া নিয়ে আমাদের দেশের লোকদের কৌতূহলের শেষ নেই। হ্যাঁ, কোরিয়ানরা কুকুরের মাংস খায়, তবে এর আগেপিছে অনেক কথা আছে। এখন কোরিয়ানরা কুকুরের মাংস খাওয়া অনেকটা ছেড়ে দিয়েছে। খুব কম রেস্তোরাঁয় কুকুরের মাংস পাওয়া যায়। তারা সবচেয়ে বেশি খায় শূকরের মাংস।

সম্প্রতি কোরিয়ার একটি আদালতে খাওয়ার জন্য কুকুর হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুকুরের মাংস দক্ষিণ কোরিয়ার রন্ধনশৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বছরে প্রায় ১০ লাখের বেশি কুকুর খায় কোরিয়ানরা। তবে এখন কুকুরের মাংসের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। কারণ, তরুণ প্রজন্ম কুকুরকে খাদ্য হিসেবে দেখার চেয়ে মানুষের ভালো বন্ধু হিসেবে দেখতে পছন্দ করে।

বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াতে ১৭ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ১৫ হাজারই এসেছে সরকারি ইপিএসের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মানুষ যে শূকরের মাংস খায় না সেটা সব মালিকপক্ষই জানে। তাই তারা কাউকে শূকরের মাংস খেতেও বলে না। তবে কোম্পানির রেস্তোরাঁতে সব দেশের লোকদের জন্য গরু বা মুরগির যে মাংস খেতে দেওয়া হয় এখানেও হালাল-হারামের প্রশ্ন থেকে যায়। ইসলামের বিধান মতো জবাই করা হয়নি এমন পশু বা পাখির গোশত খাওয়া মুসলমানদের জন্য হারাম। তাই গরু বা মুরগির মাংসও অনেকে খায় না।

এখানকার প্রবাসী মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হালাল খাবার নিয়ে। কাঁচা বাজার থেকে মাংস ছাড়া আর সবই কেনা যায়। সমুদ্রের মাছ, শাক-সবজি সব একদম তাজা পাওয়া যায়। তবে মুরগি, গরু, খাসি-এসব কেনার জন্য হালাল ফুড সেন্টারে যেতে হয়। এখন প্রায় সব সিটিতেই হালাল ফুডের দোকান পাওয়া যায়। দামও ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে।

দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ বৌদ্ধ ও ২০ শতাংশ খ্রিষ্টান। প্রায় ২৫.৩ শতাংশ কোরিয়ান নাগরিক নির্দিষ্ট কোনো ধর্মই পালন করে না। এখানকার মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। সঙ্গে প্রবাসী মুসলিম রয়েছে দুই লাখের বেশি। কোরিয়াতে ১৮টি মসজিদ, পাঁচটি ইসলামিক সেন্টার ও ১৫০টির বেশি নামাজের স্থান রয়েছে। কিছু মসজিদে শনিবার রাতে বিশুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে অনেকে শুদ্ধভাবে কোরআন পড়ার সুযোগ পান।

কোরিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কাজের উদ্দেশে কিংবা পড়াশোনার জন্য আমাদের দেশ থেকে অনেকেই আসছে। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত খাদ্য সংস্থা একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। কোথায় কোন রেস্তোরাঁয় হালাল খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে তা জানা যায় সেই অ্যাপে। সেই সঙ্গে হালাল পণ্য পাওয়া যায় এমন বিপণিবিতানও সহজে খুঁজে বের করতে পারবে। শুধু তাই না, এই অ্যাপটির মাধ্যমে মুসলিম ক্রেতা জানতে পারবে তার ক্রয়কৃত পণ্য হালাল কি না। আরও জানা যাবে কোরিয়ায় মুসলমানদের দর্শনার্থীদের পছন্দের জায়গা কোনগুলো, কাবা শরিফ বা কেবলা কোন দিকে এবং নামাজের ব্যবস্থা কোথায় কোথায় রয়েছে।

কোরিয়ানরা অনেক পরিশ্রম করে, তাই খেতেও পারে অনেক। তারা স্বাস্থ্য সচেতন, তাই সময়মতো খাবার খেয়ে নেয়। কোরিয়ানরা দুপুরের খাবার খায় ১২টা-১টার মধ্যে। খুব কম সময় নিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করে তারা। কারণ কাজের ফাঁকে দুপুরের খাবার শেষ করে নিতে হয়। আর রাতের খাবারের সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর রাতের খাবারটা অনেক সময় নিয়ে গল্প করতে করতে খেতে পছন্দ করে তারা।

আগে ভাবতাম, কোরিয়ানরা কাঠি দিয়ে কীভাবে ভাত খায়? এদেশে আসার পর দেখলাম, ওদের ভাত অনেক আঁঠালো। ভাত একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকে। তাই এক হাতে দুটো কাঠি ধরে ভাত খাওয়া সম্ভব হয়। কোরিয়ানদের পছন্দের খাবারের তালিকায় আছে, বিবিম্বাপ, কিম্বাপ, বুকুম্বাপ, সি উইড স্যুপ, গেজাং, গালবি, কংগুক্সু, সামগ্যেতাং ও চিকেন ফ্রাই।

কোরিয়ানরা এতটাই পরিশ্রমী জাতি, তাদের কর্মনিষ্ঠা আপনাকে অবাক করে দেবে। এত সুশৃঙ্খল জীবনে তাদের আনন্দ-উৎসবের কমতি নেই, জাতীয়ভাবে আয়োজিত হয় সব উৎসব। তারা প্রতিটি কাজে বিনোদন খুঁজে নেয়। আর তাদের বিনোদন বলতে একটু ভিন্ন রকম। একদিন খুব সকালে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে নদীতে গেলাম। সেখানে ১২ ঘণ্টার জন্য ৩০ হাজার উয়ন পে করতে হয়। গিয়ে দেখলাম অনেকে লেকে মাছ শিকারে ব্যস্ত। রাতে নাকি মাছ বেশি পাওয়া যায়। তাই সারারাত না ঘুমিয়ে মাছ শিকার করছেন অনেকেই। কাছে গিয়ে দেখলাম অনেক মাছ ধরেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যাওয়ার সময় রাতভর ধরা মাছ সেই নদীতেই ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। মূলত বিনোদনের জন্যই তারা এই মাছ ধরে।

দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। এরা তাই খুবই মিতব্যয়ী। প্রয়োজনের বেশি এক ফোঁটা পানিও এরা খরচ করে না। এদের পানির বিলটিতে এত বেশি বিবরণ থাকে যে, মাসের কোনদিন কোন ওয়াশরুমে কতটুকু পানি গোসলের জন্য ব্যয় হয়েছে, সেটাও জানা যায়। এক বাসায় একজন বৃদ্ধা থাকতেন। একবার পরপর তিন দিন তার বাসায় কোনো পানি খরচ হয়নি বলে তার কমিউনিটিতে জানানো হয়। তারা জানান, বৃদ্ধা বাসার বাইরে থাকবেন এরকম কোনো নোটিশ দিয়ে যাননি। তৃতীয় দিনেই তার বাসায় হাজির হয় পুলিশ, মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় সেই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

কোরিয়ার পুলিশ বিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়েও বেশি আন্তরিক। পুলিশের অনেক বড়সড় কর্মকর্তা অবলীলায় গণপরিবহনে যাতায়াত করেন এবং বিনা দ্বিধায় আপনার জন্য আসন ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। শিশু কোলে নিয়ে কোনো মায়ের সমস্যা হলে সেই কর্মকর্তা বিনা সংকোচে শিশুটিকে আগ বাড়িয়ে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকবেন। শুধু তাই নয়, আপনি কোথাও যাচ্ছেন, হঠাৎ পথ ভুলে গেছেন। যে কাউকে বললে আপনার হাত ধরে গন্তব্য পৌঁছে দেবে। মূলত তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও দেশপ্রেম যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।

লেখক : দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

প্রবাসের খবর এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :