বিশাল মুক্তিযুদ্ধ, সাতজন মাত্র বীরশ্রেষ্ঠ!

মাসুদ কামাল
  প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:৫৯
অ- অ+

মাঝে মধ্যে আমি আমাদের জাতীয় জীবনের কিছু ঘটনা, উৎসব, দিবস নিয়ে বেশ একটা দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। মহান যে মুক্তিযুদ্ধ, তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বিষয়ক কিছু ব্যাপারও আমি ঠিক বুঝি না। যেমন, আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মাত্র সাতজন কেন? আবার এই সাতজনই সামরিক বাহিনীর সদস্য কেন? মুক্তিযুদ্ধটা কি তাহলে কোনো জনযুদ্ধ ছিল না? দেশের অতি সাধারণ মানুষও কি এই যুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেনি? সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়া ছাড়াও সাত বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে আরও একটা মিল রয়েছে। এঁরা সকলেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধে আরও যে সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, তাদের অবদানকেই বা খেতাবযোগ্য বলা যাবে না কেন?

খেতাব আমাদের আরও কয়েকটা রয়েছে বীর-উত্তম, বীর-প্রতীক, বীর-বিক্রম। জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে এসব খেতাব পেয়েছেন। অথচ এমন অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা এই রাষ্ট্রীয় খেতাবের কোনোটিই পাননি। কেন? তাদের আত্মত্যাগ, বীরত্বের কি কোনোই মূল্য নেই? মহান যে মুক্তিযুদ্ধ, যার কারণে আজ আমরা স্বাধীন দেশের অধিবাসী, তার আত্মত্যাগী যোদ্ধাদের এই অবমূল্যায়ন বেদনাদায়ক। একজন লোক দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে বড় বীরত্ব আর কি হতে পারে? এই জীবনদানের বিনিময়ে তিনি তো আপনার কাছে টাকা- পয়সা বা চাকরিতে ঢোকার কোটা চাইতে আসছেন না। এই মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসাবে একটা খেতাব দিতেও কেন আমাদের মধ্যে এত কৃপণতা?

এত বিশাল একটা জনযুদ্ধ, দেশের সকল মানুষই যাতে জড়িয়ে গেল, তাতে মাত্র সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ! দেশে গত কয়েকটি বছর ধরে এই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটা মন্ত্রণালয় রয়েছে। আমি বুঝতে পারি না, এদের কাজটা কি? মাঝে একবার দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের সনদ বিতরণের দায়িত্ব পেয়ে এরা বেশ একটা কেলেঙ্কারির উদ্বোধন করে বসেছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজেই তার পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের ব্যবস্থা করেছে। অনেক আমলা নিজেদের নামে সনদ বাগিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন! বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর অবশ্য থেমে গেল। কিন্তু জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক কোনো সাজা হয়েছে বলে শুনিনি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ অবশ্য আরও একটা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশিদের যে পদক দেওয়া হয়েছে, সেই পদকে সোনার বদলে খাদ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এত কাজ তারা করেছে, কিন্তু আজও পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা করতে পারেনি। আমার তো মনে হয়, এই তালিকাটিই সবচেয়ে আগে করা উচিত ছিল। দরকার ছিল এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সকলকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ খেতাব প্রদান করা।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্তি নিয়ে খেদ থাকলেও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার অবশ্য অনেক কিছু করছেন। এতটাই করছেন যে, কখনো কখনো এটাকে আমার কাছে বাড়াবাড়ি বলেও মনে হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা সরকারি চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। কোটার কারণে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তারা এগিয়ে থাকছে। তুলনামূলক কম মেধা নিয়েও তারা সফলতা পাচ্ছে, নাগাল পাচ্ছে চাকরির সোনার হরিণের। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের জন্য এই কোটা সংরক্ষণের পেছনে কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই যুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অন্য সাধারণ মানুষের সন্তানদের মধ্যে যে এক ধরনের হতাশা বা ঈর্ষার জন্ম নিচ্ছে, সেটা কি আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা ভেবে দেখেছেন। আমি নিজে আমাদের পরিবারের মধ্যেই এরকম বিভাজন দেখেছি। সবচেয়ে হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তখন, যখন যুদ্ধে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিছু পাচ্ছে না, অথচ সার্টিফিকেট জোগাড় করা ব্যক্তির সন্তান কোটার সুযোগে ভালো চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। ইদানীং শুনছি, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাও নাকি বংশানুক্রমিকভাবে ওই কোটায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।

আমার কেন যেন মনে হয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খুবই সংকীর্ণ একটা খোপের মধ্যে আমরা আবদ্ধ করে রেখেছি। পুরো জাতির চেতনায় একে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে মাত্র দুটি বিভাজন ছিল। অতি অল্প কয়েকজন ছিল যারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসাবে কাজ করেছে। আর বাকি সকলেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কেউ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, অস্ত্র হাতে লড়েছে। আবার কেউ চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা, নানাভাবে সহায়তা করেছে সেই জনযুদ্ধে। এদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনোই সুযোগ ছিল না। এরা না থাকলে পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা, লড়াই করে জয়লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। সেই যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে লড়াই করা, সেই ঐক্যটা যেন নষ্ট করে দেওয়া হলো পরবর্তী সময়ে এই কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটার কারণে এখন কতিপয় সার্টিফিকেটধারীর সন্তানকে ঈর্ষা করে অসংখ্য সনদবিহীন স্বাধীনতাকামীর সন্তানেরা। এই পরিবেশকে আর যা-ই হোক সৌহার্দ্যপূর্ণ বলা যাবে না।

বলছিলাম বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব নিয়ে। বীরশ্রেষ্ঠ মাত্র সাতজন কেন? আর কেনই বা এরা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি আজ অবধি কারো কাছ থেকে পাইনি। অনেককে দেখেছিÑ এই প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো কথা পর্যন্ত বলতে চাননি। প্রশ্নটি করতেই এমন একটা ভাব করেছেন, যেন এটি একটি নিষিদ্ধ প্রশ্ন। ভাবখানা এমন যে, এই প্রশ্নটি করতে নেই, করলেই আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হয়ে যাবেন। প্রশ্নে অপরাধ কেন হবে, সেটাই আমি বুঝতে পারি না। বরং আমি তো উল্টোটাই জানতাম, মনে করতামÑ যত বেশি প্রশ্ন করা যাবে তত বেশি কাছাকাছি পৌঁছা যাবে সত্যের। প্রশ্নবিহীন আনুগত্য তো মূর্খতার নামান্তর। এমনকি স্বতঃসিদ্ধ যে ‘ধর্ম’, সেও প্রশ্নকে সম্মান জানায়। ধর্মের ধ্বজাধারী মূর্খরাই কেবল ভয় পায় প্রশ্নকে। যে ধর্ম যত বেশি প্রশ্নকে মোকাবেলা করতে পারে, সেটিই তত বেশি আধুনিক। আমি অনেক আলেমকে দেখেছি, হাসিমুখে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে, এমনকি ‘বেয়াড়া’ টাইপ প্রশ্নেরও এমন চমৎকার জবাব দিয়েছেন যে, মুগ্ধ হতে হয়েছে। তাহলে বীরশ্রেষ্ঠ বা কোটা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না কেন? কেন প্রশ্ন করা যাবে না মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে সৃষ্ট বিভাজনকে নিয়ে?

মাঝে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোককে এ নিয়ে প্রশ্ন করে অবশ্য একটা জবাব পেয়েছিলাম। তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে একটা সেক্টরে সাব- সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন। একবার ঘরোয়াভাবে আমাকে এনিয়ে তার নিজের ক্ষোভের কথাটিও বললেন। তিনি জানান, স্বাধীনতার পর কাদেরকে খেতাব দেওয়া হবে তা নির্ধারণে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। সেই কমিটির সকলেই ছিলেন ডিফেন্সের সদস্য। তারা তখন নিজেদের মতো করে একটা তালিকা করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার তখন দেশ পুনর্গঠন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, খেতাব প্রদানের ক্ষেত্রে যে শুরু থেকেই বিশাল একটা বৈষম্য থেকে যাচ্ছে, তা খেয়াল পর্যন্ত করতে পারেনি। এর আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হচ্ছে, খেতাব যারা পেয়েছিলেন তাদের অবদান নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন ছিল না। এখনো নেই। প্রশ্ন ওঠেছে যারা পাননি তাদেরকে অবহেলা করা নিয়ে।

আমার ওই পরিচিত ভদ্রলোক একটা ঘটনার কথা বললেন। সেটি উলিপুরের হাতিয়া অঞ্চলের ঘটনা। হাতিয়ার বুড়াবুড়ি গ্রামের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। এরা এই গ্রাম থেকেই আশপাশের থানাগুলোতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা করত। যেকোনোভাবেই হোক, পাকবাহিনী বিষয়টা জেনে ফেলে। একাত্তর সালের ১৩ নভেম্বর ভোর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী এই গ্রামটা তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় যুদ্ধ। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসারণের কৌশল নেয়। এসময় অন্যদেরকে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে একজন অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন। তার নাম হিতেন্দ্র নাথ। একটা গর্তে নিজেকে ঢুকিয়ে একটা থি-নট-থ্রি রাইফেল আর দেড়শ রাউন্ড গুলি নিয়ে সকাল থেকে শুরু করে বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি একাই পুরো এক ব্যাটালিয়ন আর্মিকে ঠেকিয়ে রাখেন। এক পর্যায়ে তার গুলি ফুরিয়ে যায়। ধরা পড়েন তিনি। পাকবাহিনী তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর সময়ও তিনি জয়বাংলা বলতে বলতে মারা যান। এই হিতেন্দ্র নাথ কোনো খেতাব পাননি। না বীরশ্রেষ্ঠ, না বীর উত্তম, না বীর প্রতীক।

এরকম হিতেন্দ্র নাথ কেবল একজন নয়। আরও অনেক আছেন। তারা সবাই অবহেলিত। কেউ তাদের খবর রাখে না। আমরা পড়ে আছি সাতজন মাত্র বীরশ্রেষ্ঠ নিয়ে। সরকারি স্বীকৃতি না পেলেও এটাই সত্য যে, এরকম হাজারো বীরশ্রেষ্ঠের ফসল আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ। হাজারো বীরশ্রেষ্ঠ ছিল বলেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা এতটা নির্মমভাবে এই ভূখ- থেকে বিতাড়িত করতে পেরেছিলাম। সেই বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে হবে, তাদেরকে সম্মান দিতে হবে। কথায় কথায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা আসলে কি? হিতেন্দ্র নাথদের সম্মান করা, তাদের ত্যাগ ও দেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নেওয়া, নাকি সনদ আর কোটা নিয়ে বেসাতি করা?

মাসুদ কামাল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিজয়নগর সীমান্তে পুশইনের চেষ্টা, বিজিবির টহল জোরদার 
গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ৩
কাকরাইল মোড়ে জবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, দুপুরে গণঅনশন
সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ক্ষমা চাইলেন অভিনেতা শামীম হাসান সরকার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা