বটতলার ঔপন্যাসিক
মুখ ও মুখোশের শিল্পী মাসুক হেলাল। পথের মানুষ এঁকেছেন। তাদের নিয়ে লিখেছেন। এই করে করেই প্রতিকৃতি আঁকিয়ে হিসেবে দেশের শিল্পজগতকে আলাদা একটি মাত্রা দান করতে পেরেছেন। সৌভাগ্যবশত সম্পাদনা সূত্রে মাসুক ভাইয়ের এই শিল্পযাত্রার কিছুকালের সহচর ছিলাম। তো তিনি একবার লিখেছিলেন লেখক এমডি মুরাদকে নিয়ে। যার শীর্ষ ছিল উপরেরটি তথা ‘বটতলার ঔপন্যাসিক’। শিরোনামখানির কারণে নাকি নাখোশ হয়েছিলেন লেখক মুরাদ সাহেব। মানে তিনিও তৃণমূল নন নিজেকে মূলধারার কথাশিল্পী ভাবতেই ভালোবাসেন। ‘বটতলা’ বুলি কী তবে গালমন্দ?
বটতলা যে তৃণমূলীয় সাহিত্যধারার পরিচয় বহন করে, এইটুকুর বেশি আমারও ধারণা নেই। তাই বটতলা নিয়ে একটু জেনে নেই। এ বেলায় বাংলাপিডিয়ার ঠাঁই নিতেই হয়। তারা লিখেছে-
‘‘ বটতলা কলকাতা তথা বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের আদি স্থান। বর্তমানে এটি কলকাতার একটি থানার নাম। শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকার একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে এই নামের উৎপত্তি হয়। উনিশ শতকে বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প এখানেই শুরু হয়েছিল। এই বটগাছ এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা প্রধানত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত পাঠকের চাহিদা মেটাত।’’
এক দশক আগেও ঢাকার ফুটপাতে ফুটপাতে এমডি মুরাদের বই ছড়িয়ে রাখা হত। সেই থেকে যতুটুক জেনেছি, যতটুকু বুঝেছি তার পাঠক শহরের রিকশাওয়ালা, পোশাকর্মী, দিনমজুর প্রমুখ। গ্রামের কৃষক, কামার, কুমারের অন্দরমহল ঘাঁটলে এখনো মুরাদীয় কেতাবের নমুনা মিলবে- এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
এ থেকে অনুসিদ্ধান্ত হতেই পারে, এমডি মুরাদ বটতলা ধারারই পূর্ববঙ্গীয় লেখক। তাতে তিনি যে, অজাত-কুজাত লেখক হয়ে গেলেন, তা কিন্তু নয়। নিম্নবর্গের জনপ্রিয়তায় তার ধারেকাছে আছেন, এমন লেখক কিন্তু কমই আছে বাংলাদেশে। প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে যাকে গণ্য করা হয়, সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধায়ও বটতলীয়দের জনপ্রিয়তা আমলে নিতেন।
‘‘তিনি দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) উপন্যাসে বটতলার দেবীর নিকট নিজের লেখনীশক্তির বৃদ্ধি কামনা করেছেন, যাতে লেখার মাধ্যমে তিনি প্রচুর অর্থ লাভ করতে পারেন। এ উক্তির পেছনে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ থাকলেও এর মাধ্যমে তৎকালে বটতলা সাহিত্যের ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাবের চিত্রটিই ফুটে উঠেছে।’’
ঠিক এভাবেই বটতলা নিয়ে বঙ্কিমিয় দর্শন তুলে ধরেছে বাংলাপিডিয়া। বটতলার বই যে লাখো পাঠকের মনোরঞ্জনে সক্ষম ছিল, এ থেকে তা অনুমেয়। তো কী উপাদান-উপকরণে ভরপুর থাকতো এসব বই? বটতলা বরাবরই ধর্মেও ছিল, জিরাফেও ছিল। তাই কলকাতার বটতলা উপহার দিয়েছে ধর্মপুস্তক, পাঁচালি, পঞ্জিকা। নকশা ও কিসসাধর্মী বইও বের হতে অনেক। আবার যৌনতায় মোড়া রগরগে কাহিনিতেও ভরপুর ছিল বটতলার বই। এগুলো প্রকাশ হতো কমদামের কাগজে আর কটকটে মলাটে। ছবি-সমৃদ্ধ ছিল এসব বই। বিষয়ের বৈপরীতের কারণে একদিকে অন্দরের গোপন সিন্দুকে, অন্যদিকে প্রকাশ্য ঠাকুর ঘর তথা ধর্মালয়েও বটতলার বইয়ের কদর ছিল।
আর সব বিষয়ের মতো কলকাতার বটতলার ঢেউ একটা সময় আছড়ে পড়ে ঢাকায়। তার আদি আখড়া চকবাজারের কেতাবপট্টি। পরে তা বাংলাবাজার অব্দিও পৌঁছে যায়। তবে শাহবাগ, কাটাবন বইপাড়া পর্যন্ত আসতে আসতেই নাগরিক জীবনে আরো অনেক শস্তা বিনোদন চলে আসে। যার কারণে বটতলা বেশ খানিকটা আড়ালেই চলে যায়। তবে আমি বলবো, নীলক্ষেতের পাইরেসি বা ফটোকপি বই বটতলারই ভিন্নধর্মী একটা রূপ হয়ে তবিয়তে আছে।
চকবাজারে এখনো কিছু কেতাবঘর আছে। সেই হিসেবে বটতলার উপস্থিতি নিভু নিভু হলেও টিকে আছে। পুর্ববঙ্গীয় বটতলার কেন্দ্রভূমি হিসেবে বাংলাবাজার আওয়াজ ছাড়াই এখনো কিন্তু সরব। তাই বাহাদুর শাহ উদ্যান হয়ে সড়কটা মোড় নিয়ে যেই সদরঘাটের দিকে চলে গেছে, ঠিক সেই মোড়টার ধারে এখনো কিছু বই মেলে। কোনোটা খোয়াবনামা, কোনোটা কবিরাজির কিতাব।
আবার কামরূপকামাক্ষা, জাদু-বাণ মারা শেখা, কামসূত্র- এ জাতীয় পুস্তকেরও সমাবেশ সেখানে। আলোচিত-সমালোচিত, রগরগে ঘটনা-রটনার কাব্যি, পুস্তিকা, পাঁচালিও আছে নৌযানের দিকে ধাবিত যাত্রীদের কল্যাণে। এর জন্যে অবশ্য তাদের কিছু পয়সাপাতি গুণতে হয়। তবু সুধী সমাজের বই বিবেচনায় এগুলো বিকোচ্ছে পানির দরেই।
কেবল কমদরি বলেই নয়, শস্তা কথায়, গোপন বিষয়ের রগরগে উপস্থাপনা দিয়েই আড়াল একটি পাঠক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে গিয়েছেন কাসেম বিন আবুবাকার। আমরা সুশীল পাঠক যারা, তারা সেই খবর পেলাম দূর দেশের এক গণমাধ্যমের বরাতে। তার সাহিত্য নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড়। কেউ তাকে স্বীকার করছেন, কেউ অস্বীকার করছেন।
এই বির্তকে ফিরে যেতে হয় শুরুর মুখ ও মুখোশে। মাসুক হেলাল একবার এক পথের কবিকে নিয়ে লিখেছিলেন। আলাপে আলাপে সেই কবি জানিয়েছিলেন, একবার তিনি কবি শামসুর রহমানের বাসায় গিয়েছিলেন। নাগরিক কবি পথের কবিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আপনিও কবি, আমিও কবি। আমরা তো একই পথের যাত্রী!’
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক