এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

সংকটে এনসিসি ব্যাংক!

নিজস্ব প্রতিবেদক
 | প্রকাশিত : ০৭ মে ২০১৯, ০৯:০৩

ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অস্বস্তি। অন্যতম শীর্ষ পদে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান পেশাদারিত্বের সঙ্গে চালানো আদৌ সম্ভব কি না এ নিয়ে উঠেছে নানা কথা।

এনসিসি ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এমডির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আগামী ৮ মে বিশেষ বোর্ড সভা ডাকা হয়েছে। এনসিসি ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। আর এই অর্থের বৈধ কোনো উৎস নেই।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার টাকা ছাড়াও পরামর্শক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজার থেকেও তার হিসাবে টাকা জমা হয়েছে মোসলেহের হিসাবে। এমডি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এসব অর্থের মালিক হয়েছেন বলে বলছে বিএফআইইউ।

এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গতকাল দিনভর ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নূরুন নেওয়াজ, উপ-ব্যবপস্থাপনা পরিচালক খন্দকার নাইমুল করিম এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনিরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কাউকেই পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন ধরে অফিস সহকারী পরিচয় দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘স্যাররা মিটিংয়ে আছেন।’

একাধিকবার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মোবাইল নম্বরের কল ধরে একাধিক ব্যক্তি নিজেদের ‘অফিস সহকারী’ পরিচয় দিয়েছেন। ব্যক্তিগত ফোন অন্যের ধরার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নে একজন বলেন, ‘স্যার বলে গেছেন ধরতে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এমডির ব্যাংক হিসাবে লেনদেনে গড়মিলের অভিযোগের ঘটনায় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলতেও বিব্রতবোধ করছেন। যে কারণে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারা কথা বলছেন না।’

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, এমডির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ব্যাংক পরিচালনার নানা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রভাব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো গ্রাহকদের ওপরও পড়বে। তৈরি হতে পারে আস্থার সংকটও। তাই এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

তবে ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেন একে ব্যাংকের সংকট হিসেবে দেখছেন না। তার দাবি, এটি ব্যক্তিগত ঘটনা, ব্যাংকের নয়। দৈনিক ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে এমডি স্যারের নিজস্ব বিষয়। এ নিয়ে ব্যাংকের বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। আগামী ৮ মে পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভা ডাকা হয়েছে। সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকও এই বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। এনসিসি ব্যাংক গড়িমসি করলেও তারা বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে চায়। এইএনসিসি ব্যাংকের এমডিকে অপসারণের ব্যাপারে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এনসিসি ব্যাংকের এমডির বিষয়টি কী পর্যায়ে আছে আমি এখন বলতে পারবো না। তবে কারো বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসে এমডির নিজের ও স্ত্রীর নামে এই অর্থের লেনদেন হয়েছে। পাঁচটি ব্যাংকে থাকা মোসলেহ উদ্দিনের হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। ব্যাংকগুলো হলো এনসিসি, যমুনা, প্রাইম, সিটি ও প্রিমিয়ার। একই সঙ্গে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের হিসাবও জব্দ করেছে সংস্থাটি।

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের আয়ের উৎস ও সম্পদের বিষয়ে খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ‘এনসিসির এমডির ব্যাপারে এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আমরা তথ্য দিয়েছি। তারা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। আরও তথ্য চাইলে আমরা দিবো। এ ব্যাপারে আসলে যা করার তারাই করবেন।’

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ২০১৫ সাল পর্যন্ত যমুনা ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি এনসিসি ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালের আগস্টে তিনি এনসিসি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব নেন।

বিএফআইইউর তদন্ত অনুযায়ী, ৫ ব্যাংক, ২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৪টি ব্রোকারেজ হাউসে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে এনসিসি ব্যাংক ভবন শাখায় তাঁর হিসাবে প্রতি মাসের বেতন বাবদ জমা হয় ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪০ টাকা। তবে ওই শাখাতেই তিনি একটি বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খোলেন, যাতে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় ৫ হাজার ডলার। আর গত ৩১ জানুয়ারি জমা হয় ৮ হাজার ডলার।

২০১৫ সালের শেষে এনসিসি ব্যাংকে যোগদান করলেও তার যমুনা ব্যাংকের হিসাবে নিয়মিত টাকা জমা হয়েছে। যমুনা ব্যাংকে নিজের নামে একটি ও স্ত্রী লুনা শারমিনের সঙ্গে যৌথ একটি হিসাব রয়েছে। এতে জমা হয়েছে যথাক্রমে ৬ কোটি ও সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এভাবে যমুনা ব্যাংকের হিসাবে সাড়ে ৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে যমুনা ও এনসিসি ব্যাংকের গ্রাহক ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং একাই দিয়েছে ৪ কোটি টাকা। এই টাকা জমা হয়েছে ২০১৮ সালের ৫,১২, ১৫ ও ২৫ এপ্রিল।

দ্যা সিটি ব্যাংকে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী লুনা শারমিন ও তাদের যৌথ মিলে তিনটি হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে বিভিন্ন সময়ে জমা হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। প্রাইম ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখায় তাঁর নামে থাকা হিসাবে জমা হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকে থাকা হিসাবে জমা হয়েছে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

এ ছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে রয়েছে ৪ কোটি টাকা ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ২ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে নিজের নামে ৪টি ব্রোকারেজ হাউসে হিসাব খুলেছেন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। এসব হিসাবে জমা রয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ব্রোকারেজ হাউসগুলো হলো সিটি ব্রোকারেজ, এনসিসি ব্যাংকের সিকিউরিটিজ, সিএসএমএল সিকিউরিটিজ ও ই-সিকিউরিটিজ।

তদন্তে দেখা গেছে, যমুনা ব্যাংকে থাকা মোসলেহ উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত ভিত্তিতে টাকা জমা দিয়েছে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই চার দফায় ১ কোটি করে ৪ কোটি টাকা জমা করেছে তারা। এ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কাছে যমুনা ও এনসিসি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে।

আর সেই টাকার মধ্যে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ৩ কোটি টাকা ও ১ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত হিসাব খোলেন মোসলেহ উদ্দিন। আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়েও ২ কোটি টাকার আমানত হিসাব খুলেছেন তিনি। এর জোগানদাতাও ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর আশুলিয়ায় ৫১ লাখ টাকায় একটি জমি বিক্রি করেন মোসলেহ। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ৪ কোটি টাকা।

তদন্ত অনুযায়ী, সিটি ব্যাংকে থাকা হিসাবে টাকা জমা করেছেন এনসিসি ব্যাংকেরই একজন কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি ৪৫ লাখ টাকা জমা করেন, পরদিনই সেই টাকা উঠিয়ে নেন। পরে ওই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা অনাকাক্সিক্ষত। এটা আরও ভালোভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। এমডির ব্যক্তিগত আয়কর ফাইলটি রাজস্ব বোর্ড নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবে। দুর্নীতি দমন কমিশনও বিষয়টি নিয়ে সচেষ্ট হবে বলে আমি মনে করি।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

ভারতের রপ্তানির খবরে ১০ টাকা কমলো পেঁয়াজের দাম

অবন্তিকার আত্মহত্যা: এখনো মেলেনি তদন্ত প্রতিবেদন, থমকে গেছে আন্দোলন 

সড়কে এআইয়ের ছোঁয়া, বদলে যাচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা 

এখন তিন হাসপাতালে রোগী দেখছেন সেই ডা. সংযুক্তা সাহা

কোরবানির ঈদ সামনে, মশলার বাজারে উত্তাপ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :