ঘটনা ঘটালেও ভ্যাট দিতে হবে!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
  প্রকাশিত : ০৩ জুলাই ২০১৯, ১২:৪৯
অ- অ+

ঘটক বাহাদুরকে কে না চেনে! তার কাজই হলো আপসে ঘটনা ঘটানো, ছেলে বা মেয়েপক্ষকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথার ছলে পটানো, তারপর বিবাহকার্যটি সুসম্পন্ন হলেই গাঁটে কড়কড়ে নোট আর জামাইয়ের সদ্যকেনা জামাপোশাক এটা-সেটা নিয়ে হাসি মুখে বিদায় গ্রহণ। কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে তাতে বোধ করি ঘটক বাবাজীরা অতি সহজে আর মুক্তি পাবেন না। তাদের ঠোঁটের সেই তেলতেলে চওড়া হাসিও আর অনায়াসে বিস্তৃতি লাভ করবে না।

কেন কেন! হেতু কি বলুন দেখি! ঘটক পাখিভাই আবার কী করলেন! শুধু কি ঘটক পাখিভাই, অন্যান্য সকল ঘটকগণ যারা কিনা সুরম্য প্রাসাদে ঘটকালির দোকান খুলে বসেছেন, এবার তাদের সবাইকে করজালে আবদ্ধ করা হবে। পাবে আর খাবে কিন্তু হিসাব দেবে না, সেই দিন গুজার গিয়া ভায়া। সুখ-সুবিধা বলতে কিছু আর রইলো না। কাজকাম বাদ দিয়ে মামুলি দুটো বিয়ের ঘটকালি করে খাবেন, সেই কায়দাও আর নেই। সরকার নাকি বিপুল অংকের রাজস্ব আদায় করতে দিয়ে এবার করজাল বিস্তৃত করবেন। তাতে কেবল বড় বড় রাঘব বোয়ালই নয়, এবার চুনোপুঁটিরাও ধরা খাবে। কিছুতেই রেহাই পাবে না। ছোটো-বড় সকলেই আটকাবে সেই জালে। যার নাম ‘ভ্যাট নেট’।

কথায় বলে না, হাঁড়ির ঠেলায় পাতিল ভাঙে, বাস্তব অবস্থা এখন সেইরকম। ঘটকের ঘটকালির উপরে ভ্যাট বসবে ভালো কথা, কিন্তু ভ্যাট কি তিনি নিজের পকেট থেকে দেবেন! দেবেন না। তাহলে সেই ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর আসবে কোত্থেকে! কেন, যারা ঘটকের কাছে মেয়ে বা ছেলে খুঁজতে আসবে তাদের থেকে। বরপক্ষ কনেপক্ষ উভয়ের কাছ থেকে বাড়তি টাকা কাটবে এবার ঘটক। করের টাকা দিতেই হবে। নইলে নো বিয়ে, নো সম্পর্ক। হীরক রাজার দেশে যেমন, ‘বাকি রাখা খাজনা,মোটে ভালো কাজ না’।

খবর শুনে প্রান্তিক ঘটক মন্টু মিয়ার ভয়ানক মন খারাপ। তার বুক ধড়ফড় করে, তার গলা শুকায়, চিন্তায় মুখখানা একেবারে আমসি মেরে গেছে। কেন গো, তোমার মন খারাপের কারণটা কী শুনি? ভ্যাট তো আর তুমি দেবে না, দেবে তোমার খদ্দের। মানে যারা বিয়ে বসবে।

কিন্তু তাতে মন্টুর মন মোটে বুঝ মানে না। তেতো গলায় সে বলে, রাখো তোমার করের হিসাব! আমি কি আর ঘটক পাখিভাই নাকি! আমার অত টাকা আছে, নাকি নামডাক! আমার কাছে যারা আসে, তার সব হাড়হাভাতে কিপটে লোকজন। এদের বিয়ের খরচ দেবার মুরোদ নেই, সে নাকি আবার দেবে ভ্যাট! শুনে বেজায় হাসি পায়। শুকনো মুখে খিক খিক করে হাসে নিচুতলার ঘটক মন্টু মিয়া। সে হাসিতে প্রাণ নেই, মনোকষ্ট আছে। একেই বলে কাষ্ঠহাসি।

খবরের আদ্যোপান্ত শুনে মনে হয় মন্টুর কথা কিছু মিছে নয়। সব ঘটকের কি আর ঘটনা ঘটাবার সাধ্যি আছে! বগলে মেলা তাপ্পিমারা ছাতি নিয়ে, গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ঝড়জল বয়ে কত কষ্ট করে তবে একখানা বিয়ের খবর জোগাড় করে মন্টু মিয়া। তার কাছ থেকেই যদি ভ্যাট কাটে, তাহলে সে যাবে কোথায়!

অবশ্য সরকার বাহাদুর না বুঝেশুনে কি আর কিছু করেন! সোয়া তিন লক্ষ কোটি টাকার বিশাল রাজস্ব আদায় করতে হবে এবার। এত টাকা আসবে কোত্থেকে! আকাশ থেকে তো আর পড়বে না। তাই সরকার ঠিক করেছে, এবার ভ্যাটের আওতা বাড়াতে হবে। ভাঁওতাবাজি দিয়ে কেউ আর পার পাবে না। যারা ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছে তারাই কেবল দেবে, আর বাকিরা সব বসে বসে লেবেঞ্চুস খাবে বা সিনেমা দেখবে, তা তো হতে পারে না। কথায় বলে, দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। ভ্যাট আদায়ে সবাই এবার খানিক হাত লাগাও তো দেখি। তবেই না ঘাটতি বাজেট কমবে, দেশের যথেষ্ট আয়-উন্নয়ন হবে। সিঙ্গাপুরের মতো আমরাও একদিন উদ্বৃত্ত বাজেট পেশ করতে পারবো।

সে না হয় হল। ঘটকরা ভ্যাট দিতে শুরু করলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার একখান প্রশ্ন আছে। না না, কূটতর্ক নয়। একেবারে যুতসই প্রশ্ন। ধরুন ঘটক পাখিভাই একখানা বিয়ে জুড়লেন। ছেলে ও মেয়ে উভয়পক্ষের কুড়ি কুড়ি চল্লিশ লাখ টাকার উপর ভ্যাট ধার্য হল। আবারও বলি, ব্যবসায়ীরা কিন্তু কোনো ভ্যাট দেন না। কারণ ভ্যাট হল গিয়ে পরোক্ষ কর। যার উপর বর্তায় তিনি ভ্যাট পরিশোধ করেন না, বরং ভোক্তার পকেট থেকে ওটা উসুল করেন। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা কেবল ভ্যাট কালেক্টর বা সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। তাই ভ্যাটের হার বাড়লে তাদের ডাক-চিৎকার জুড়ে দেবার কোনো মানে নেই। গাঁটা কাটা গেলে তা যাবে ভোক্তার, মানে আমজনতার।

তো যা বলছিলাম, কেউ কেউ আছে না, বছরবিয়ানো গাভির মতোন বছরে বছরে বিয়ে করার অভ্যেস, ঘটকালির উপর ভ্যাট আরোপ হলে সেই বেচারারা কই যাবেন! ফিবছর বিয়েবাবদ ভ্যাটের টাকা চুকোতে গেলে তাদের দিন গুজরান কঠিন হয়ে যাবে যে! অবশ্য তাতে একটা উপকার হলেও হতে পারে। ভ্যাটের ভয়ে কেউ কেউ হয়তো বিয়ের স্বপ্নই মুলতুবি রাখবে। সারা জীবন। পরিবর্তে তারা আপসে প্রেম করতে পারে, বা লিভ-ইন। তাতে তো আর ভ্যাট গুনতে হয় না। আমার বক্তব্য খুব পরিষ্কার, এমন আইন হওয়া উচিত যে, একজন ব্যক্তি যতগুলো বিয়েই করুক না কেন, ভ্যাট দেবে শুধু প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে। বার বার ভ্যাট দিলে ‘কাসকেডিং ইফেক্ট’ বা ভ্যাট অন ভ্যাট হয়ে যাবে, যা মোটেও আইনসিদ্ধ নয়, বরং নিপীড়নমূলক।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আছি। চাকরি সূত্রে দুটো খেয়েপরে চলি আর কি। স্বভাবতই মনিবের সাথে বেইমানি করতে পারি না। তাই বলছি, ঘটকালির উপরে ভ্যাট আরোপ আজেবাজে কিছু নয়, বরং যৌক্তিক বিষয়। আপনি নিত্য নিত্য ঘটনা ঘটাবেন আর ভ্যাট দেবেন না, তা কী করে হয়! ঘটক পাখিভাই তো আর এমনি এমনি ছেলে বা মেয়ে খুঁজে দেন না। বিনিময়ে তিনি টাকা পান বা ফিস নেন। ভ্যাটের সংজ্ঞানুযায়ী পণের বিনিময়ে পণ্য বা সেবা দিলে তাকে বাণিজ্য বলে। আর মুফতে বাণিজ্য বলে এখন আর কিছু নেই। ব্যবসা করলে আপনাকে কর দিতে হবে। আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট দুটোই। কিছুতেই এর অন্যথা হতে পারে না। তাহলে আপনার সেই বিয়ে বিধিপ্রযুক্ত বা বৈধ হবে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মেয়ে পরপুরুষের হাত ধরে পালাবে বা স্বামী বিষ খাবে, এই আমি বলে রাখলুম।

তবে এ-কথাও ঠিক যে, এই সেক্টরে ভ্যাট খুব একটা আসবে বলে মনে হয় না। কারণ মুঠোফোনের যুগে ঘটকালি করতে অফিস থাকাটা বাধ্যতামূলক নয়। চালিয়াত যারা, তারা কিন্তু মুঠোফোনেই ওই কাজটুকু টুক করে সেরে নেবে। মিয়া-বিবির দেখাদেখি সব হবে চীনে রেস্তোরাঁয় বা ভিডিও কলের মাধ্যমে। অবশ্য সেখানেও ভ্যাট আছে। কিছু খেলে ভ্যাট দিতে হয়। আগে ছিল পনের শতাংশ, এখন একটু কমে সাড়ে সাত ভাগ। বাস্তবতা হল এই যে, অনেকেরই ভ্যাট দেয়ার অভ্যেস নেই, পছন্দও করেন না বিশেষ। কিন্তু রাজপাট চালাতে গেলে বা দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম সচল রাখতে চাই রাজস্ব। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে ঘটকালি হোক বা হাত দেখাদেখি, ভ্যাট আমাদের দিতেই হবে। দেশ বাঁচলে তবে জনতা বাঁচবে। আদৌ বাঁচবে তো! লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পল্লীবন্ধু এরশাদ চিরকাল মানুষের হৃদয়ে কণক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন
চাঁদা না দেওয়ায় পল্লবীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলা, গুলিবর্ষণ: গ্রেপ্তার ৩
ছন্দে ফিরলেন লিটন, সমতায় ফিরল টাইগাররা
১২ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১০৭ কোটি মার্কিন ডলার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা