বিহারি ক্যাম্পের সংস্কৃতি যেভাবে কিশোর গ্যাং

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:০৪| আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:২৮
অ- অ+
ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের দল বাঁধা সংস্কৃতি থেকে রাজধানীতে আছর করেছে কথিত গ্যাং কালচার। পাড়া-মহল্লায় উঠতি কিশোরদের মধ্যে দল বেঁধে আড্ডা দেয়ার নামে যেসব গ্রুপ জন্ম নিচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবককুল থেকে বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত। বিশেষ করে রাজধানীতে এই কথিত গ্যাং-গ্রুপের দৌরাত্ম চরমে পৌঁছেছে। এর কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে গ্যাং কালচারের পেছনে রাজধানীর বিহারি কলোনির ভূমিকার কথা উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিহারিদের বসবাসের প্রথম দিক থেকেই তারা তাদের সংস্কৃতি ব্যবহার করে আসছিল। বর্তমানেও তারা তাদের সেই সংস্কৃতি নির্ভর। সেখান থেকেই বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং এর সূচনা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বলছে, রাজধানীতে গত তিন থেকে চার বছর ধরে এই গ্যাং কালচারের যাত্রা শুরু। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকার এই ‘লাড়া দে’ গ্যাং এর হাত ধরে এর সূচনা। এরপরই তা ছড়িয়ে পরে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় এরপর সারাদেশে। সম্প্রতি ‘লাড়া-দে’ গ্রুপের প্রধান মীমসহ দলের অন্য সক্রিয় কিশোরদের আটক করে পুলিশ।

এরপর একের পর এক আটক হচ্ছে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় প্রেমিকাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এসময় আতঙ্ক গ্রুপের মহসিন মারা যায়। এ ঘটনায় একই গ্রুপের আরও দুই জন আহত হয়।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে গ্যাং কালচার নতুন নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই মোহাম্মদপুরে দানা বাঁধতে শুরু করে গ্যাং কালচার। বাংলাদেশে আটকে পরা পাকিস্তানিদের বসবাস বিহারি ক্যাম্পগুলোতে। এসব ক্যাম্পের অধিবাসীরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেও এদের জীবনযাপনে সংস্কৃতি এখনো পাকিস্তানের আদলে।

মোহাম্মদপুর এলাকায় মোট চারটি ক্যাম্প রয়েছে। সবচেয়ে বড় ক্যাম্পটির নাম জেনেভা ক্যাম্প। শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোড ও বাবর রোড মিলে এই ক্যাম্পের বিস্তৃতি। এখানে বসবাসকারীর সংখ্যাও প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ। এখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংঘর্ষ হয়ে থাকে। আর এই সংঘর্ষ বাঁধে কিশোরদের মধ্যে। এই প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং রয়েছে বলে সূত্র জানায়।

ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পের মূল অংশের ভেতরে আড্ডা দেওয়ার জায়গা খুব কম। তাই বিহারি কিশোররা আড্ডা দেয় ক্যাম্পকে ঘিরে থাকার সড়কগুলোতে। এসকল সড়কে প্রতিদিনই বসে বিহারি কিশোরদের আড্ডা।

হুমায়ূন রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড এবং গজনবী রোডে এসকল কিশোরদের আনাগোনা প্রচুর। স্কুল-কলেজমুখী মেয়েদের যৌন হয়রানি করা তাদের সবচেয়ে ছোট অপরাধ বলছেন ভুক্তভোগীরা।

গণভবন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্যাম্পের পাশ দিয়েই আমাদের যেতে হয়। এরা মেয়েদের দেখলে টিজ করে। আমাদের উল্টাপাল্টা কথা বলে। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে বিরোধে যেতে চাই না। এরা খুবই উগ্র।’

জানা গেছে, এসকল কিশোররা মাদক সেবন, বিক্রিসহ ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এদের মধ্যে কোপাকুপির ঘটনা প্রায় নিয়মিত।

অনলি টক্কর, জিনিস-ল-জগত, আগুন, অনলি বিদোদ (বিরোধ), চ্যাতলে ভ্যাজাল, সুরাজ গ্যাং, মুড়ি খা, পিষ্যা দে সহ বিভিন্ন কিশোর গ্যাং এখানে সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্যাং ঘটিয়ে চলছে নানা অপরাধ। ছিনতাই, মাদক থেকে শুরু হতে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে এসব কিশোররা।

জেনেভা ক্যাম্পের মতো একই চিত্র পাশের জান্নাতবাগ ক্যাম্প, কৃষি মার্কেট ঢোল ক্যাম্প এবং টাউনহল ক্যাম্পে। এখানে ক্যাম্প সংলগ্ন রাস্তার পাশে গ্যাং সদস্যদের অত্যাচারে বিরক্ত হলেও স্থানীয়রা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পায়।

মোহাম্মদপুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে, আশির দশকে মোহাম্মদপুরে বিহারিদের আধিপত্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। তারা এক বয়সের কয়েকজন মিলে একেকটি দল গড়ে তুলেছিল। সে দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো।

সে সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে মফিজ মিয়া ঢাকা টাইমসকে জানান, বর্তমান কৃষি মার্কেট এলাকায় তখন বাঙালিরা যেতে ভয় পেত। কারণ বিহারিদের কয়েকজন তখন সেখানে আড্ডা দিত। মাদক সেবন এবং ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল আট থেকে দশজনের ওই দলটি। এমন বেশ কয়েকটি দল ছিল পুরো এলাকাজুড়ে, যা ধীরে ধীরে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ‘সেসময়ও বিহারিদের বেশ কিছু সক্রিয় কিশোর গ্যাং তারা দেখেছেন। তাদের গ্রুপের বিভিন্ন নাম ছিল। নামগুলো হতো দলনেতার নামানুসারে। আর এসব গ্যাং এর সদস্যরা অস্ত্রও ব্যবহার করত।’

মোহাম্মদপুর এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের গ্যাং হয়ে ওঠার পেছনে মূল সাহস এবং শক্তি যুগিয়েছিল বিহারি ক্যাম্পের উর্দুভাষী বন্ধুরা।

সমাজ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘বিহারিদের সঙ্গে আমাদের একটি মানসিক দূরত্ব আছে। তারা যখন বাংলাদেশে বসবাস করতে শুরু করল, তখন থেকে তারা তাদের মধ্যে তাদের মতো করে থাকার একটা প্রবণতা দেয়া যায়।’

‘তাদের কিছু সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে উপ-সংস্কৃতি হিসেবে প্রবেশ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিহারি কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আমাদের কিশোর-কিশোরীরা পড়াশোনা করে। আমাদের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তাদের কিছু উপ-সংস্কৃতি প্রবেশ করে। তারপর এটা আমাদের লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ে।’

তিনি বলেন, ‘দোষটা হচ্ছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা বর্তমান প্রজন্মের প্রতি উদাসীন। তাদের এই উদাসীনতা অপরাধের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।’

মঙ্গলবার থাকছে দ্বিতীয় পর্ব...

ঢাকাটাইমস/১৫সেপ্টেম্বর/কারই/ডিএম

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পল্লীবন্ধু এরশাদ চিরকাল মানুষের হৃদয়ে কণক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন
চাঁদা না দেওয়ায় পল্লবীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলা, গুলিবর্ষণ: গ্রেপ্তার ৩
ছন্দে ফিরলেন লিটন, সমতায় ফিরল টাইগাররা
১২ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১০৭ কোটি মার্কিন ডলার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা