প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে করণীয়

মো. আরিফুল ইসলাম সরদার
| আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:১১ | প্রকাশিত : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:৪০

বিবেক-জ্ঞান-বুদ্ধি ও মনুষ্যত্বের কারণে মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়। সততা-নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, পরোপকার এবং আদর্শ চরিত্রবান মানুষ হওয়ার মূল ভিত্তি সুশিক্ষা। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। অন্যদিকে বলা যায়, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বীজ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও মানবিক গুণসম্পন্ন একজন আদর্শবান মানুষ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর সামাজিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বুনিয়াদি শিক্ষা করে তাকে আগামী দিনের কাণ্ডারী হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। তাই এই শিক্ষাকে মানুষ গড়ার আঁতুড়ঘর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুকে ভবিষ্যতের দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা হলো প্রথম ও প্রধান সোপান। এই প্রতিটি শিশুর সুষ্ঠ সামাজিকীকরণ, আনন্দময় বর্তমান, সৃজনশীল ভবিষ্যৎ ও প্রগতিশীল উৎপাদনমুখর উন্নত সমাজ বিনির্মানের জন্য গুরত্বপূর্ণ| আর এই কাজই সম্পাদন করে প্রাথমিক শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির দিক তাকালে দেখা যায়, দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তৃতিতে গত ১০ বছরে অগ্রগতি হয়েছে ব্যাপক। যার শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে চার দফার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনেই রঙিন বই তুলে দেয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-প্রহরী নিয়োগের মতো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে।

শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টিসহ লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু, পুল শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগও প্রশংসা পাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে, যা বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুকরণীয়। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ।

পাঠদান পদ্ধতি পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়ে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয়টি নির্দেশ জারি করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হাসান স্যার। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, ভাষাজ্ঞান বাড়াতে নিয়মিত পাঠাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। তাই প্রতিদিন বাংলা ও ইংরেজি বইসহ থেকে একটি পৃষ্ঠা পঠনের জন্য বাড়ির কাজ দিতে হবে। এক পৃষ্ঠা হাতের লেখা বাড়ি থেকে লিখে আনতে বাড়ির কাজ দিতে হবে। ক্লাসে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট শ্রেণি শিক্ষক সব শিক্ষার্থীকে আবশ্যিকভাবে পঠন করাবেন। শিক্ষকরা নিজেরা শিশুদের সঙ্গে উচ্চারণ করে পাঠ করবেন, এতে শিক্ষার্থীদের উচ্চারণ জড়তা দূর হবে এবং প্রমিত উচ্চারণশৈলী সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চারণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মনোবল বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি শব্দ পড়া, বলা ও লেখা শেখাতে হবে, এর ফলে শিক্ষার্থীদের ভাষার ব্যবহার বাড়বে এবং এতে শিশুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারবে। সচিব স্যারের নয়টি নির্দেশনা বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে পালন করা উচিত।

আমাদের শিক্ষার হার বৃদ্ধির পেলেও আমরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে পারছি না। আমাদের শিক্ষা হয়ে উঠেছে পরীক্ষানির্ভর। আমাদের মধ্যে পরীক্ষা নির্ভতা কমিয়ে এর মেধা যাচাই করিয়ে প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায় পরায়ণতা শেখানো উচিত।

শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য সবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন একটি পরিচ্ছন্ন স্কুল পাবে তেমনি তারা কর্মঠ, উদ্যমী ও স্বাবলম্বী হবে এবং পরিচ্ছন্ন থাকার জ্ঞান লাভ করবে।

গ্রামের স্কুলগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা দুপুরে খাবার আনে না। দীর্ঘ সময় না খেয়ে খাবার কারণে দুপুরের পরে শিক্ষার্থীরা ঝিমিয়ে পড়ে এবং পড়ালেখার প্রতি তাদের অনাগ্রহ চলে আসে। এ সমস্যা দূর করার জন্য স্কুলেই রান্নার ব্যবস্থা করা উচিত অথবা শিক্ষার্থীরা যেন বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসে সে বিষয় তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত।

প্রত্যেক ক্লাসে শেষ সারিতে অভিভাবকদের বসার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং শিক্ষকদের মাঝেও ভালো পাঠদান করার জন্য আগ্রহ তৈরি হবে।

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষাকতা শুধু আয়-রোজগারের উপায় হিসেবে না দেখার জন্য শিক্ষকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা সময় উপযোগী মানসম্মত পাঠদান করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শিক্ষকদের প্রতি সম্মানজনক জায়গা তৈরি হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকের আনুপাতিক হার খুবই কম। বর্তমান সরকার শূন্য পদ পূরণের জন্য অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে আরও পদ শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

বিদ্যালয়গুলোতে যে ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে তারা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার মান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও সচেতন নয়। তাদের অনেকেই এটিকে ক্ষমতা বা আধিপত্য হিসাবে বেছে নিয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটিরও মান বৃদ্ধির করা প্রয়োজন। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।

শিশুর চেতনার প্রকৃত বিকাশ ঘটে থাকে প্রাথমিক স্তরেই। আমরা যদি শিক্ষার ভিত শক্তিশালী করতে চাই তাহলে অবশ্যই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, সচেতন অভিভাবক, সুশীল সমাজের ভূমিকা এবং সরকারের সার্বিক সহযোগিতা। তাহলেই একদিন শিশুর চেতনার প্রাথমিক শিক্ষা পরিপূর্ণতা লাভ করবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পাবে একটি আলোকিত জাতি।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নোয়াখালী সদর, নোয়াখালী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :