মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে দরকার সবার সহযোগিতা

মো. আরিফুল ইসলাম সরদার
  প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:১২| আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:২০
অ- অ+

শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। অশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই সমাজের জন্য বোঝা। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনাও করা যায় না। একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে ধাবিত হতে গেলে চূড়ায় পৌঁছাতে হলে শিক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। একটি ভালো বীজ থেকেই সম্ভব একটি গাছ মহীরুহ হয়ে উঠা, তেমনি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। ভালো বীজ থেকেই কেবল ভালো ফল আশা করা যায়। প্রাথমিক শিক্ষাই হলো শিক্ষাব্যবস্থার বীজ।

শিক্ষার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। আর শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হলে দেশের ভবিষ্যৎ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ক্রমাগত বাড়ছে। এ বর্ধিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিক করার জন্য শিক্ষকদের জন্য আইসিটি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তারা বিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হচ্ছেন। বর্তমানে শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে। শিক্ষক ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায় প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তির মাধমে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর ও পিটিআই অভ্যন্তরীণ পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলো এক শিফট থেকে দুই শিফটে পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ নিশ্চয় টেকসই উন্নয়ন এর লক্ষ্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে।

স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রাথমিক শিক্ষা ছিল অবহেলিত। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজস্ব তত্ত্বাবধানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে চিহ্নিত করে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেন। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অবশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য- মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিও জন্য প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আবার অনেক প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ নিঃসন্দেহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। আর এ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারবেন। সবার জন্য ন্যায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করতে হবে। বিদ্যালয়ে ও বাড়িতে তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু জিপিএ ফাইভ বা পাসের হার বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় সকল ঘাটতি পূরণ করে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের আদর্শ ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের সাথে সম্মুখে এগিয়ে যেতে পারবো এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। সকল মহলের মতামত নিয়ে সমগ্র জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন, জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করেছে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ প্রাথমিক শিক্ষার সাথে জড়িত। পাঁচ থেকে ১০ বছরের এসব কচিমুখের শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। এরাই আমাদের আলোর দিশারী। প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে শেষ হওয়া এই শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতায় সুনিপুণভাবে সন্নিবেশ করা আছে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন। শিশুর বয়স, মেধা-বয়স, অভিরুচির ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ গবেষক দ্বারা তৈরি এসব শিক্ষানীতি পাঠক্রম সন্নিবেশিত। শিশু-শিক্ষার্থী সহজেই মুগ্ধ হতে পারে সে মতো সাজানো আছে ধাপে ধাপে। আকর্ষণীয় এবং সহজবোধ্য এসব পাঠ্যক্রম শিশু-শিক্ষার্থীদের নান্দনিক মানসগঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বয়সের ধাপে ধাপে তাদের শেখা পছন্দ ও রুচির পরিবর্তন ঘটে।

দক্ষ জনসম্পদ এবং মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার বিকল্প নেই। রূপকল্প ২০২১ এবং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জাতীসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষ) অর্জনের সরকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাংবিধানিক দায়-বদ্ধতা, রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ জাতিসংঘ ঘোষিত বৈশ্বিক লক্ষমাত্রাসমূহ অর্জনে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকার দৃষ্টি দিয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা এবং আধুনিকজ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে দক্ষমানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাসশুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফলপ্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরে পড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। স্কুল ও মাদ্রাসায় সকল ধরনের শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে যথাসময়ে বই পৌঁছে দিয়ে দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এই অভূতপূর্ব সফলতা সমগ্র জাতির কাছে প্রশংসিত হয়েছে এবং বিশ্বসমাজে পেয়েছে স্বীকৃতি ও মর্যাদা।

আজকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে এরাই দেশ পরিচালনা করবে এবং বহির্বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে। কাজেই শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের জন্য সৎ দক্ষ দেশপ্রেমিক ও উদার গুণাবলীসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিশুদের মনে দেশপ্রেম গড়ে তোলার মাধ্যমে মহন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাদের উজ্জীবিত রাখতে আমাদের সবার দায়িত্ব নিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। আর শিশুদের ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের ভালোবাসতেন এবং শিশুদের উন্নয়নে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় এবং একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আশানুরূপ ফলও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিই রচিত হয় প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে যথার্থ শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শিশুদের সার্বিক দিক দিয়ে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাতেই এগিয়ে যাবে দেশ, এগিয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ। গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নোয়াখালী সদর, নোয়াখালী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বৈষম্যবিরোধী ও এনসিপির আন্দোলনের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার
বাংলামোটরে এনসিপির জুলাই চিত্র প্রদর্শনীর গাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ
তাড়াশে সম্পত্তি লিখে নিয়ে বাবা-মাকে বাড়িছাড়ার অভিযোগ
সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা