একদিন কেটে যাবে দুর্যোগ, নিস্তব্ধ পথে ফিরবে কোলাহল

সুজয় সরকার
| আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২০, ১৬:২১ | প্রকাশিত : ০৭ এপ্রিল ২০২০, ১৬:১২

উত্তরা থেকে রাজারবাগ, অফিস থেকে বাসায় ফেরার জন্য সময় লাগছে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। দুই সপ্তাহ আগেও কমছে কম দেড় ঘন্টা লাগতো। গত দুই বছর ধরে এমন একটা দিন অনেকবার চেয়েছি। অথচ সেই বহুল প্রতিক্ষিত 'ফাঁকা ঢাকা' আজ আনন্দের বদলে হাহাকার জাগাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

মেসেঞ্জারে এক বন্ধু মেসেজ পাঠিয়েছে, দুয়েক লাইনের পরিসংখ্যান শেষে হ্যাশট্যাগে লেখা 'Stay Home'. গাড়িতে বসে দেখলাম, কিছুক্ষণ হাসলাম, পরে ভাবলাম রবীন্দ্রপ্রেমী হিসেবে কতবার আউরেছি "সব ঠাঁই মোর ঘর আছে..." সে অর্থে সবখানে ঘর ভাবলে, রাস্তায় থাকলেও তো ঘরই হলো। কত মানুষকে দেখছি আদতেই ঘর নেই; সে তুলনায় তো বেশ আছি।

না, সত্যি বলছি, এই দুর্যোগে ঘরে বসে না থাকতে পেরে কষ্ট লাগে না একটুও; বরং ভালো লাগে এই ভেবে যে দেশব্যাপী, পৃথিবীব্যাপী মাত্র যে কয়েকটা সার্ভিসকে বাইরে থাকার অধিকার দেওয়া হচ্ছে তাদের একজন আমিও। ফিরে আসি শিরোনামে ধার নেওয়া 'মেধনাদ-বধ' কাব্যে।

মাইকেল এই মহাকাব্যে প্রমীলার মুখে বলালেন, "আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?"। সমালোচকগণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন প্রমীলা রূপি বঙ্গললনার সাহস দেখে। স্বয়ং রঘুপতি কে ভিখারি বলে তার বিশাল সেনার সামনে দিয়ে মাত্র কয়েকজন সখি নিয়ে ইন্দ্রজিৎ-জায়া চলে আসলেন বীরদর্পে।

বলাবাহুল্য প্রতিপক্ষ মহামানব (যদিও তার নামে এ যুগে নৃশংস নরহত্যাও হচ্ছে) রাঘব না হয়ে বর্তমানের রাঘব-বোয়াল হলে প্রমীলা এই দুঃসাহসের মূল্য হাড়ে হাড়ে টের পেতেন। প্রমীলা কি পেলেন সেটা বড় কথা না, মাইকেল 'এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট' লিখে মজা পেলেন কি না তাও আমার জানা নেই। তবে আমরা যে সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মজা পাই সে তো চর্মচক্ষে দেখতেই পাচ্ছি।

আমরা সখা-সখি নিয়ে যেভাবে ঘুরছি ঘাটে-মাঠে-বাটে, যেন করোনা কোন ভিখারি রাঘব। করোনা ভিখারি না হলেও আমরা যে ভিখারি তা বুঝি আর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

গত এক সপ্তাহ ধরেই ঢাকার বিভিন্ন রাজপথে দেখছি এক শ্রেণির মানুষ টইটই করে ঘুরছে, উদ্দেশ্য যে ত্রাণের কোন গাড়ি বা কিছু তাও বুঝতে বাকি থাকে না। বেশ কিছু লোককে দেখেছি এক এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে আবার অন্যদিকে দৌড়াতে। এ তো গেল কতিপয় নিম্নবিত্তের দীনতা। উচ্চবিত্তের দীনতা তো পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে। যার ঢের আছে তার প্রণোদনাও লাগবে ঢের।

আর স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা সকাল বিকাল পোড়া পরোটার সাথে একগাদা আত্মসম্মান মেখে নাস্তা করে, তাদের জন্য আছে রবিবাবুর "এ জগতে হায়... " এর সান্ত্বনা।

এতোদিন পর আজ ঢাকা শহরটাকে বীভৎস রকমের ফাঁকা লাগল। এ ঢেউ হয়তো দুদিনে দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে যাবে। মৃত্যুকে যারা সংখ্যা ভেবে ডিজিট বাড়ার গণনায় আছি, হাজার হাজার মানুষকে যারা আলু-পটল ভেবে ঠেলে দিচ্ছি বিপদে সেই সবজিওয়ালা থেকে হঠকারিওয়ালা, তরকারিওয়ালা থেকে মন দেনেওয়ালা সবাই হয়তো সতর্ক হয়ে যাবে; ততক্ষণে অরিন্দমের বিষাদের পাল্লাটা ভারী না হলেই হয়।

আজ অনেককেই দেখলাম প্রশ্ন তুলতে পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী কেন কঠোর হচ্ছে না? তারা এমনকি জনতার পশ্চাদদেশে দু'ঘা দিয়ে দিতেও উৎসাহিত করছেন বেশ জোরেশোরেই। অথচ দুদিন আগেও একটু কটুকথা বললে আপনার আপেল সদৃশ গন্ডদেশ ক্ষোভে পশ্চাদদেশের রুপ নিতো। না, আমি আমাদের কোন বিচ্যুতিকে সমর্থন দিচ্ছি না অবশ্যই। তবে আপনারাও দেরি করে ফেললেন মশাই।

গ্রিক মিথোলজিতে 'প্যানডোরা'র বাকসো' নামে একটা ব্যাপার আছে যেখান থেকে 'Pandora's Box' বাগধারাটি এসেছে। গ্রিকদের বিশ্বাস মতে প্যানডোরা তার এই আপাত-সুন্দর বাকসো খুলে দেওয়ার সাথে সাথে বেড়িয়ে এসেছিল 'দুঃখ, দারিদ্র, হতাশা, যন্ত্রনাসহ অসংখ্য অপদেবতা'। সেখানে একমাত্র ভাল দেবতা ছিল 'আশা'। তাই যেখানেই এই অপদেবতারা যায়, আশাও সেখানে যায়।

আমাদের আশার মাত্রা হয়তো অনেক বেশি; সেটা কখনো উচ্চাশা হয়, আবার কখনো হয় তামাশা। তবুও আশায় বুক বাঁধি, একদিন কেটে যাবে এই দুর্যোগ, এই নিস্তব্ধ পথে ফিরবে কোলাহল, এই শঙ্কিত প্রাণে ফিরবে উচ্ছ্বাস।

কবিগুরুর মতো বলব, "আবার জাগিনু আমি। রাত্রি হল ক্ষয়। পাপড়ি মেলিল বিশ্ব। এই তো বিস্ময়..."

লেখক: সুজয় সরকার, ফেসবুক থেকে নেয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :