তপন শিকদার: প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

শাহিদুল হাসান খোকন
| আপডেট : ০২ জুন ২০২০, ১৯:১৫ | প্রকাশিত : ০২ জুন ২০২০, ১৯:০১
শাহিদুল হাসান খোকন

পশ্চিম বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির গেরুয়া ঝান্ডা যারা তুলেছিলেন তাদের অন্যতম প্রাণপুরুষের নাম তপন শিকদার। বাংলার বিজেপি প্রতিষ্ঠায় যে কজন রাজনীতিবিদের নাম উঠে আসে তপন শিকদার তারমধ্যে শ্রেষ্ঠজন এটা তার শত্রুরাও স্বীকার করেন। বাংলা বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক থেকে কেন্দ্রের সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। হয়েছিলেন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। ওপার বাংলার নামে কীর্তিমান এই মানুষ পরিচিতি পেলেও তিনি আমাদের এপার বাংলার সন্তান। আমার জন্মস্থান মাগুরার মহম্মদপুরে জন্ম এই ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদের। আজ তপন বাবুর প্রয়ান দিবস। প্রয়ান দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে একজন বাংলাদেশ প্রেমী তপন শিকদারকে তুলে ধরতেই এই লেখা।

তপন শিকদারের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার (বর্তমান বাংলাদেশের মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার) বসুর ধূলজুরি গ্রামে৷ তাঁর পিতা ধীরেন্দ্রনাথ শিকদার ছিলেন একজন মানবিক চিকিৎসক৷ তপন বাবুর পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়েছিল গ্রামের পাঠশালায়। এখন ৪৩ নং উত্তর কুঠিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুলটির নাম। এখানকার পাল্লা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পযন্ত পড়েছিলেন তিনি।

দেশ ভাগের পর তপনবাবুর পরিবার চলে যান পশ্চিম বাংলার মালদহের বুলবুলচণ্ডীতে৷ মালদহ কলেজ থেকে বি.কম পড়ার সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে হাতে খড়ি। স্নাতক হওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান। এই সময় থেকেই জনসঙ্ঘের দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই সূত্রে ১৯৬৯ সালে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থেকে নির্বাচিত জনসঙ্ঘের বিধায়ক প্রফুল্ল সরকারের ব্যক্তিগত সহায়ক হন তপন শিকদার। জরুরি অবস্থার সময় অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো আত্মগোপন করেছিলেন তপনবাবু৷ জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।

কলকাতার বিদ্যাসাগর কেন্দ্র থেকে জনতা পার্টির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রতিষ্ঠার সময় তপনবাবু এই রাজ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। কাধে থলে ভর্তি বই নিয়ে পায়ে হেটে, বাসে চড়ে, ট্রেনে ঝুলে রাজ্যে নেমে পড়েন দলের সাংগঠনিক কাজে। তৎকালিন ম জমানায় বৈরিতার সাথে যুদ্ধ করে বাংলায় যাত্রা করান বিজেপির রাজনৈতিক ট্রেন। তার এই ত্যাগের স্বীকৃতিও দেয় তার দল।

১৯৯৫ সালে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক হন নির্বাচিত হন তিনি। হয়েছিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতিও। বছর কয়েক ধরে তপনবাবুর সঙ্গে দলের রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোমালিন্য হয়। সেই সময় দলের সঙ্গে তাঁর কিছুটা দূরত্বও তৈরি হয়। শুনেছি, বিজেপিতে স্যুট-বুট পড়া নেতৃত্ব আর বাংলায় কট্টর হিন্দুত্ববাদ পন্থায় কখনও সায় ছিল না তপন বাবুর। এসব নিয়েই ছিল তাঁর নানা আপত্তি। শুনেছি উনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভুল স্বীকার করায় পরে ফের তিনি রাজ্য বিজেপির রাজনীতিতে ফিরে আসেন।

১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার দমদম কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দেন তপনবাবু। পরের বছর ফের লোকসভা ভোটেও জেতেন তিনি।

তিনি কেন্দ্রীয় টেলিকম এবং তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় সরকারের। তিন বছর পর তাঁকে কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় টেলিকম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এক দিনে ল্যান্ডলাইন সংযোগ প্রদান, বিকল ফোন ১৫ দিনে ঠিক না-হলে বিলের টাকা ফেরত, কম পয়সায় মোবাইল সংযোগের সিদ্ধান্ত নিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ভারত বর্ষে।

এবার লেখায় ফিরি বাংলাদেশপ্রেমী এক তপন শিকদার নিয়ে। শুরুতেই বলি, তপন শিকদার ছিলেন চাপা স্বভাবের একজন প্রচারবিমূখ মানুষ। আমার সঙ্গে উনার সম্পর্ক নিয়ে একটু পারিবারিক আলোচনা করে নেই। তপন শিকদারের পৈত্রিক বাড়ি আমার বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে। বাবার মূখেই প্রথম শুনেছি উনার নাম। বাবা আর উনি একই স্কুলে পড়তেন। তবে বাবার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন তপন কাকু। পারিবারিক সম্পর্ক ভালো থাকায় মিশতেন বন্ধুর মতই। পরে আমার এক চাচার মাধ্যমে তপন কাকুর পরিবার নিয়ে আরো বিস্তারিত জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখনই আগ্রহ জাগে কাকুর সঙ্গে যোগাযোগের। উঠে পড়ি উনার নাম্বার যোগার করার কাজে।

সফলতা পাই ২০০৪ সালে। তপন কাকুকে প্রথমবার যেদিন ফোন করলাম খুব ভয় লাগছিল মনে। এপাড় থেকে ওপারে যাওয়া অনেককেই দেখেছি জন্মভুমির প্রতি অশ্রদ্ধা, অনাগ্রহের বিষয়টি। কিন্তু প্রথম দিনেই ধারনা পাল্টে দিলেন তপন কাকু। কি অকৃতদার মানুষ। তিনি সেদিন একটি মিটিংয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ কথাটা শুনতেই আমাকে ফোনে রেখেই সবাইকে থামতে বললেন। একদম আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন- কও…। আমি পরিচয় দিতেই হয়ত তাঁর চোখে ভেসে উঠেছিল জন্মমাটির চিত্র। কয়েকটি নাম উচ্চারণ করে জানতে চাইলেন তারা কেমন আছে। তারপর বললেন- আমি ত একটা মিটিংয়ে আছি বাবা তুমি আরেকদিন আমারে সময় নিয়ে ফোন দিও। তোমার ফোনে জন্মমাটির গন্ধ পেলাম। তারপর অনেকবার ফোনে কথা বলেছি, দেখাও হয়েছে। সেসব লিখব পরে কোনো দিন সময় পেলে।

বাংলাদেশপ্রেমী তপন শিকদার নিয়ে যেটা বলছিলাম সে প্রসঙ্গে আসি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক স্থাপনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন তপন শিকদার। একমূখি কংগ্রেস ভক্ত আওয়ামী লীগ যখন বিজেপি সরকারের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলার অবস্থা তখন তপন শিকদার সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতার মধ্যে সরাসরি বাস চলাচলের কাজটি সম্পন্ন করতে অটল বিহারী বাজপেয়ী তাঁর আস্থাভাজন বাঙ্গালী তপন শিকদারকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকায় ঐ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাকু এসেছিলেন। পরে কাকুর মুখে শুনেছি ওই সময় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জন্মভিটা দেখার জন্য একটি সরকারি হেলিকপ্টার দিয়েছিলেন কাকুর জন্য। কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার কারণে তিনি তখন যেতে পারেননি। শুধু বাস চলাচলই নয়, দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আরো অনেক অজানা খবর তপন শিকদারের মূখে শুনেছি। শুনেছি ২০০১ সালে নির্বাচন নিয়ে কথাও। সেসব নিয়ে একটা বড় করে লিখার ইচ্ছে আছে।

মৃত্যুর আগেও কাকুর খুব ইচ্ছে ছিল জন্মভিটায় আসার। স্বাস্থ্যগত কারণে উনি আসতে পারেননি। পরে শুনেছি জন্মভিটার একটু মাটি নিতে একবার ভাতিজা সৌরভ শিকদারকে (বিজেপির যুব মোর্চার কেন্দ্রীয় সম্পাদক) পাঠিয়েছিলেন গ্রামে। কাকুর সে ইচ্ছে পূরণ না হবার দায় আমাদেরও। আমরা উনার জন্মস্থানের মানুষ উনাকে সম্মান দিতে পারিনি। উনাকে নিয়ে আসতে পারিনি।

২০১৪ সালেরে লোকসভা কেন্দ্রে কলকাতার দমদম কেন্দ্রে কাকু ছিলেন বিজেপির প্রার্থী। ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে ২ জুন প্রবীণ এই নেতা দিল্লির এইমস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন।

তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘বিজেপিকে গড়ে তোলা এবং জনসেবার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রয়াণ অত্যন্ত বেদনার।’

এখন ভারত বর্ষে স্যুট-বুট পড়া বিজেপির নেতারা তপন শিকদারকে না জানলেও বাংলা তথা ভারতবর্ষে বিজেপি গঠনে তপন শিকদার কি ছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর শীর্ষ নেতৃত্ব তা স্বীকার করেছিলেন।

সুবক্তা তপনবাবু খুব সহজ-সরল ভাষায় ভাষণ দেওয়ায় দক্ষ ছিলেন। মানুষকে খুব আপন করে নিতে পারতেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। রাজনৈতিক বড় পদ পদবী বা এমপি-মন্ত্রীত্ব উনাকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরাতে পারেনি কখনও। মৃত্যুর আগ পযন্ত তিনি সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করে গেছেন। প্রতিদানে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসাও। জানি না প্রয়াণ দিসবে কিভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষ স্মরণ করছে গণমানুষের এই নেতাকে। কোনো কর্মসূচি আছে কী না তাঁর দল বিজেপির? থাকলেই ভালো। না থাকলেও সমস্যা নেই প্রয়াত তপন শিকদারের। গণমানুষের নেতা থাকে গণমানুষের হৃদয়ে। আমার বিশ্বাস সেখানে আছেন তপন শিকদার। থাকবেন হাজার বছর ধরে। বাংলাদেশের জন্মভিটা থেকে প্রয়াণ দিবসে তপন কাকুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেন্দ্র (CBIR)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :