করোনায় মৃত্যুভয় ও আমাদের শোধরানো

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ১০ জুলাই ২০২০, ১৯:৫৮

রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ সাহেব যে হাসপাতালের বিজনেস করতেন তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। করোনা স্যাম্পল নিয়ে নেগেটিভ-পজেটিভ রেজাল্ট দিতে ব্যবসা করেছেন। যে রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারির আতঙ্কে রূপ নিল, সেই রোগ নির্ণয়ের জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। প্রথম দিকে এ রকম উদ্যোগ নেয়ার কেউ সাহসই দেখাতে চাইলেন না। উনি ব্যবসা ভালো বোঝেন তা জানা গেল। তবে তিনি মানুষের দুর্বলতা ও সরলতার সুযোগে জীবন নিয়ে খেলা করেছেন।

এককথায় বলা যায়, রিজেন্টের মালিক সময়ে দাউ মারার মতো বুদ্ধিমান ও চতুর, এবং একই সঙ্গে তার রয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে খেলার বেপরোয়া মনোবৃত্তি। তার অপকর্মের শাস্তি আমরা তো দাবি করবই। এখন তার স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা সবাই তার খারাপ কাজের শাস্তি দাবি করছে। তারা কিছুই জানে না বলে দাবি করছে। তাদের দাবি সত্য না মিথ্যা, তদন্ত হচ্ছে সবই জানা যাবে।

আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য সাহেদ সাহেবকে নিয়ে নয়। আসলে করোনা কি শিক্ষা দিয়ে গেল তা নিরূপণ করার চেষ্টা করব।

করোনার সময় কিছু জিনিসের ব্যবসা ভালো হয়েছে। মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, করোনা পরীক্ষা ইত্যাদি। ভাইরাসটি চীনে শুরু হয়েছে তা সবাই জানি। পরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। প্রায় ৬ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ইতিমধ্যে। এসব তথ্য সবাই জানি। কিন্তু করোনা নিয়ে যত দুর্নীতি বাংলাদেশে হয়েছে, তা অন্য কোনো দেশে হয়েছে কি না সে প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রথমে এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারী, এরপর দেখা গেল যত ধরনের জীবাণুনাশক আগে পাওয়া যেত, সবই নকল করে বানানো শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে। হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সদের, যাদের আমরা বলছি ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা, তাদের দেওয়া হলো অতি নিম্ন মানের সুরক্ষা সরঞ্জাম! করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি নিয়ে ছিনিমিনি খেলার স্বপ্ন আমাদের দেশের একশ্রেণীর কুচক্রী ব্যবসায়ী ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আর কেউ দেখানোর সাহস করেনি। বিশ্বব্যাপী করোনা পণ্য জালিয়াতি ও ভেজাল দিতে এমনকি করোনা টেস্ট নেগেটিভ-পজেটিভ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকলাম আমরা।

সত্যিই এসব অপকর্ম মনে অনেক চিন্তার খোরাক জোগায়। আর মনে মনে ভয় লাগে- যদি এখনই মরে যাই তাহলে এত এত টাকাপয়সা দিয়ে কী লাভ! কী হবে সেসব স্ত্রী-সন্তান, যারা এখন স্বামী বা পিতা কী ব্যবসা করত তা মোটেও জানত বলে মিডিয়ায় জানা যাচ্ছে। সত্যি বড়ই বিচিত্র এই দুনিয়া। বিপদের দিনে নিজ স্ত্রী-সন্তানকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না।

দুনিয়ার রীতি এটাই, যাদের জন্য আপনি-আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করছি, তারা বিপদের দিনে আজ আমাকে-আপনাকে চিনছে না। আমার মনে হয়, সাহেদ সাহেব অর্থাৎ পলাতক রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তা।

আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি- কোন মনীষী এই কথা বলেছেন, তা মনে নেই। তবে এটার অর্থ ভালো করেই বুঝেছিলাম। একদিন আপনি-আমি অবশ্যই মারা যাব জেনেও হন্যে হয়ে মিথ্যা আশায় মরীচিকার পিছনে ছুটছি তো ছুটছি। এই ছোটাছুটির যে শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। করোনায় আপনি বা আমি আজ মরে গেলে কবরে লাশ নিয়ে যাওয়ার আপনজন খুঁজে পয়া যাবে না। শুধু তাই না পিতা সন্তানকে ছেড়ে যাচ্ছে এবং সন্তান পিতা-মাতাকে। এই তো জীবন।

ক্ষমতার মোহে ন্যায়-অন্যায় বিসর্জন দিয়ে টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদের পিছনে ছুটছি। স্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ভালো পদে বসার যে প্রতিযোগিতা- এ তো মৃত্যু পর্যন্তই। করোনা ভাইরাসে ধনী-গরিব সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। কোনো ভেদাভেদ করছে না এবং কাউকেই ছাড়ছে না করোনা। সবশেষে একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, এ দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে হবে। জীবনকে সঠিক পথে চালিত করতে হবে।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সারা পৃথিবী তটস্থ। এর মধ্যে এই ভ্যাইরাস আস্থার সংকটও তৈরি করেছে চূড়ান্তভাবে। বিষয়টি নিয়ে কি চিন্তিত হয়ে গেলেন! না, চিন্তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবে আস্থা ধরে রাখতে হবে শেষ অবধি। যত দিন এই দেহে প্রাণ আছে।

কীভাবে আস্থা বিনষ্টকারী ভাইরাস হলো, পাঠক নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে। আমি সেই কথাই বলব। মানুষে মানুষে, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, দেশ-দেশে, রাজা-রাজায় আস্থা বিনষ্টকারী এক নম্বর স্থানটি করোনা ভাইরাস দখল করেছে। বিষয়টি একদিকে আতঙ্কের, তেমনি শিহরণ জাগানোর মতো ব্যাপার।

আমি ভয় সৃষ্টি করতে এই লেখা লিখছি না। আমাদের সতর্ক হতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক দূরত্ব থিওরি মানতে হবে। বেশি বেশি করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে, যেটা এই বিশ্বে এখন আস্থার সংকটে রূপ নিয়েছে। সন্তান তার মাকে বন-জঙ্গলে ফেলে রেখে আসছে। করোনা শুনে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে ৩০-৪০ বছরের সংসার ভেঙে চলে যাচ্ছে। একে-অপরের মধ্যে ডিভোর্স নিচ্ছে। আরো কত কী!

কোভিড-১৯ কাউকে ছাড় দিতে আসেনি। কে ধনী, কে গরিব- বাছ বিচার না করে সবাইকে স্পর্শ করে যাচ্ছে নির্মমভাবে। একবার যদি করোনা ধরে ফেলে, তবে শোধরানোর সময় পাব কি না নিশ্চিত নই কেউ। যদি সময় না পাই তাহলে সব আত্মঅহমিকা মুহূর্তের মধ্যে উবে যাবে। পড়ে থাকবে শুধু কর্ম। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক বা নকল মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এই বিষয়ে সচেতন কি না সেটিই প্রশ্ন।

এমনিতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে অতি আপনজনও কাছে আসছে না। যদি করোনার সাথে চাল চোরের গালি নিয়ে মৃত্যুবরণ করি, তবে সারা জীবন বিশ্বাস হারিয়ে চলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে বিশ্বাস নিঃশ্বাসের চেয়ে গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থেকেও মৃত।

এ কারণে করোনার কঠিন শিক্ষা বাদেও সামনে কোরবানি ও হজের যে শিক্ষা আমরা মুসলমানরা কোরআন-হাদিসের আলোকে জানি, তা কাজে লাগাতে হবে। নিজেদের বাস্তব জীবনে কোরবানি ও হয়রত ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর শিক্ষা নিয়ে ও ধারণ করে করোনা সংকট থেকে রেহাই পেতে হলেও এ যাত্রায় অন্তত তওবা এস্তেগফার পড়ে ভালো হওয়ার অঙ্গীকার করি। আর তাতে যদি করোনা মহামারি কেটে যায়, তাহলে সেটাই মঙ্গল। তবে করোনাভাইরাসের শিক্ষা শুধু প্রজারা নেবে, তা নয়; রাজা-বাদশাদেরও গ্রহণ করে ন্যায়ের আলোকে দেশ ও রাজ্য পরিচালনার শিক্ষায় ব্রতী হয়ে কাজ করতে হবে।

লেখকঃ কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক

(ঢাকাটাইমস/১০জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :