কর্মীদের ওপর দায় দিয়ে ছাঁটাইয়ের চেষ্টা করেন সাহেদ
করোনাভাইরাসের রিপোর্ট নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার কর্মচারীদের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন করোনার ভুয়ার রিপোর্ট দেয়া জালিয়াতি চক্র ধরার অনুসন্ধানে নামে তখনই বিপদ আঁচ করেন সাহেদ। সঙ্গে সঙ্গে ভুয়া রিপোর্ট তৈরির দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে রিজেন্টের তিন কর্মীকে পেছনের তারিখে ছাঁটাইয়ের চেষ্টা করেন তিনি।কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে করোনাভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া একটি চক্রকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল জুনের মাঝামাঝি। সেই চক্রের হোতাদের ধরতে অভিযানে নেমে সরকার অনুমোদিত রিজেন্ট হাসপাতালের খোঁজ পায় র্যাব।
যেভাবে ধরা পড়ে রিজেন্টের জালিয়াতি
জানা গেছে, সড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জুনের শেষে রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা সনদ হাতে পেয়ে সেটি চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে এই সনদ ভুয়া। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করবেন বলে রিজেন্ট কর্তৃপক্ষকে জানান।
সাহেদ বিপদ আঁচ করতে পেরে তিন কর্মীর ওপর দোষ চাপিয়ে পার পেতে চান। সতর্কতার অংশ হিসেবে তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানান, তাকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। এ জন্য তিনি পেছনের তারিখে তার তিন কর্মী তারিক, সুমন ও পলাশকে ছাঁটাই করতে চিঠি তৈরি করেন। মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাকে জানান, ওই তিনজন বাইরের কিছু লোকের যোগসাজশে নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া প্রতিবেদন দিচ্ছেন।
ওই কর্মীরা তাদের ইনচার্জের কাছে বিষয়টি জানতে চান। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য এমন অনেক কিছুই করতে হয়। আসলে তাদের ছাঁটাই করা হয়নি। একটা ঝামেলা হয়েছে, মিটে গেলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সাহেদের নির্দেশে দুটি হাজিরা খাতা খোলে হাসপাতাল। ছাটাই হওয়া তিনজন একটিতে ও বাকিরা দুটিতে সই করছিলেন।
২ জুলাই আইপিএইচ ও নিপসম জানায়, রিজেন্ট থেকে রোগীদের যে সিরিয়াল দিয়েছে, সেই সিরিয়ালে কোনো নমুনা আসেনি। এরপর সাদাপোশাকে র্যাবের লোকজনও নমুনা দিতে রিজেন্টে যান। সাড়ে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা রিজেন্টে পরীক্ষা করান। যে টাকা তারা রিজেন্টকে দেন, সেগুলোর ফটোকপি নিজেদের কাছে রেখে দেন। এভাবে তারা জালিয়াতি সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
৬ জুলাই বিকালে র্যাব উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়। ওই দিন দুপুরেও সাহেদ রিজেন্ট গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, তিনজনের শোকজের চিঠি তৈরি আছে কি না।
মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, রিজেন্ট খুব দ্রুত ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। তিনি চাকরি করতে রাজি ছিলেন না। জোরাজুরিতে যোগ দেন। বিপণন বিভাগে বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেন তাড়াহুড়ো করে। সাহেদ বলেছিলেন, তারা পিপিই ও মাস্ক বিক্রি করবেন। তা ছাড়া উবার বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। তিনি এ ব্যবসা ধরবেন। কিন্তু তা আর হলো না। অর্থলোভে প্রতারণায় ফেঁসে গেলেন সাহেদ।
এদিকে, গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাহেদ করিম আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নেন। সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন ছেপেছে, ‘বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট’ শিরোনামে।
নিউইয়র্ক টাইমস লেখেছে, ছদ্মবেশে পালানোর সময় একজন হাসপাতাল–মালিক গ্রেপ্তার। পরীক্ষা না করেই অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে তিনি সনদ বিক্রি করেছেন। সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ইতালি থেকে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের বহনকারী বিমান ফেরত পাঠানোর কথা উল্লেখ আছে।
রিজেন্ট ও জেকেজির সংগ্রহ করা নমুনা ও তাদের জাল রিপোর্টের কারণে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত তথ্যে গরমিলের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চুক্তি হয়। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি নমুনা সংগ্রহ করছিল। দিনে ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) পাঠানোর কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তবে তারা কয়েক গুণ বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছিল বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সাহেদের বিরুদ্ধে আসছে নতুন অভিযোগ
৬ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর মো. সাহেদের প্রতারণার নানা খবর বেরিয়ে আসছে। গত শুক্রবার সাহেদ সম্পর্কে প্রতারণার তথ্য দিতে র্যাব যে হটলাইন নম্বর দিয়েছে, সেখানে ৭২ জন ও ই-মেইলে ২০ জন অভিযোগ জানিয়েছেন বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে রিমান্ডে থাকা সাহেদ সম্পর্কে গতকাল ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন নতুন জালিয়াতির তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, আলবার্ট গ্লোবাল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ করছিলেন সাহেদ। আদতে তাঁর কোনো পোশাক কারখানা নেই। তিনি ফেসবুক পেজ খুলে এ প্রতারণা শুরু করেন।
কিন্তু সাহেদের পৃষ্ঠপোষক কারা, সে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো তথ্য দেয়নি। র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, সাহেদকে তারা খুব অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিলেন। তিনি কয়েকজন পৃষ্ঠপোষকের নাম বলেছেন। যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করা ঠিক হবে না।
ঢাকাটাইমস/১৯জুলাই/ইএস