একাত্তরে তিন বছরের আসমা এখন হতে চান বীরাঙ্গনা

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়পুরহাটের আসমা বিবির বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে ওই বছর আসমা ৮ বছরের শিশু। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শিশু থাকা আসমা এখন খেতাব পেতে চান বীরাঙ্গনার। ৭১ সালে তার বয়স ২০ বছর ছিল বলেই দাবি করছেন আসমা। তার বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভূক্ত হওয়ার অপচেষ্টায় হতবাক স্বজনরা। আর আসমার এমন দাবিকে ‘অনৈতিক’ বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
আসমা বিবি জয়পুরহাট সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবার জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে আসমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের নেতারাই জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যও বিষয়টিকে প্রতারণা হিসেবে দেখছেন। দলীয় নেত্রী আসমা বিবিকে এমন অপচেষ্টায় যারা সহযোগিতা করছেন তাদেরও শাস্তি চেয়েছেন সাংসদ।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসমা বিবিকে নিয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বীরাঙ্গনা হতে যা যা করছেন আসমা বিবি!
আসমা বিবির স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ৩ বছর। যদিও জাতীয় পরিচয়পত্র (৫৫৩৬৪২১২৯৯) অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৬২ সালের ২০ ডিসেম্বর। সেই হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার বয়স ছিল ৮ বছর ১১ মাস ২৭দিন। আর ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তার ৫৭ বছর ৮ মাস ১৮দিন। কিন্তু বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা না জানা আসমা জন্মতারিখ ১৯৫০ সালের ২০ ডিসেম্বর উল্লেখ করে জন্মনিবন্ধন নেন। সেই অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স হয় ২০ বছর।
শুধু তাই নয়, উপজেলার দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদ হতে তিনি যে জন্মনিবন্ধন নিয়েছেন সেটা পিতার পরিবর্তে স্বামীর নাম দিয়ে করেছেন আসমা বিবি। পরে এর ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধনের আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তথ্যে গরমিল থাকায় নির্বাচন কমিশন তার বাতিল করে দেয়।
এদিকে আসমা বিবিকে কোনো জন্মনিবন্ধন দেননি বলে ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম। বয়স বাড়ানোর আবেদনে কোনও দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গেলেও ১৯৬৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছেন মর্মে স্থানীয় একটি দাখিল মাদরাসা হতে প্রত্যয়নও জমা দিয়েছেন আসমা।
বিষয়টি জানাজানি হলে জেলা এবং মহিলা আওয়ামীলীগের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এর প্রেক্ষিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী জেলা প্রশাসকের নিকট সঠিক তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে আবেদন করেন।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে নিজেকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য এই চেষ্টা চালান আসমা বিবি। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আসমা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালকের কাছে তাকে বীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে আবেদন করেন।
জানা যায়, আসমা বিবির আবেদনের প্রেক্ষিতে জামুকার সহকারী পরিচালক আব্দুল খালেক চলতি বছরের ২ জানুয়ারী বিশেষ কমিটি কর্তৃক যাচাইবাছাইয়ের জন্য জয়পুরহাট সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেন। পরে সদর উপজেলার নারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। গত ২৪ জুন কমিটির আহবায়ক উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহনাজ সিগমা তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন। যেখানে তিনি আছমা বিবিকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন।
তবে প্রাথমিক তদন্ত শেষে যারা তাকে গেজেটভুক্ত করতে সুপারিশ করছিলেন তারাই এখন এটি বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছেন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শাহনাজ সিগমা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তখন তার কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল বিষয়টি সঠিক তাই সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্ত পরে যখন আরো নানা তথ্য এসেছে তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সেটি স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করেছি।’ আবার প্রয়োজনে আবারো তদন্ত করলে প্রকৃত তথ্য বের হতে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
এদিকে জামুকায় আবেদনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ শুরু করেন। আসমা বেগমের বিরুদ্ধে তারা সরকারি জায়গা দখল, গাছ কাটাসহ নানা অভিযোগ করেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদু ঢাকা টাইমসকে বলেন, আসমা বিবির সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে নানা সময়ে। সে যে বীরাঙ্গনা সেটি কোনও দিনই বলেনি। সে সরকারের সঙ্গে এবং দলের সঙ্গে প্রতারণা করতে চাচ্ছে। তার বিচার হওয়ার দরকার এবং এর সঙ্গে আরো যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা দরকার।’
তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন আসমা বিবি। নিজেকে বীরাঙ্গনা দাবি করা আসমা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওইসময় জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার জন্মতারিখ ভুল করে লেখা হয়েছে। তাই আমি সংশোধনের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আমি একজন প্রকৃত বীরাঙ্গনা হিসেবে যাবতীয় কাগজপত্রসহ গেজেটভূক্তির জন্য আবেদন করেছি।’
(ঢাকাটাইমস/০৮সেপ্টেম্বর/বিইউ/ডিএম)

মন্তব্য করুন