​সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চাই সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ

শাহাবুদ্দিন শুভ
 | প্রকাশিত : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৮

শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল দেখেছে দেশবাসী। এদিন ৯ ঘণ্টায় সিলেটসহ দেশের ৮টি জেলায় সড়কে ঝরেছে ২৪ প্রাণ। এর মধ্যে সিলেটে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আটজন এবং বগুড়ায় আরেকটি দুর্ঘটনায় চারজন মারা গেছেন। শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ঢাকা-সিলেটে মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছয়জন। হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায় আরও দুজন। বিলাসবহুল বাস লন্ডন এক্সপ্রেস ও এনা পরিবহনের মধ্যে সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আরও ১৮ জন।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন সড়কে মৃত্যুর মিছিলে কি পরিমাণে যোগ হচ্ছে লাশের পর লাশ। একদিনে যেখানে এত মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে সেখানে সারা বছরের হিসাবটাও অনুমান করা যায়। এর ফলে কোনো কোনো দুর্ঘটনায় একই পরিবারে সবাই যেমন মারা যাচ্ছেন আবার কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকটির মৃত্যুর ফলে পুরো পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার।

বুধবার (৩ মার্চ) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সেখানে তারা উল্লেখ করেন- চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ৪০৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৭ জন নিহত এবং ৬৫৯ জন আহত হয়েছেন। এই সময়ে ৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত, ৫৫ জন আহত হন। ১৩টি রেল দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং চারজন আহত হয়েছেন।

এতে বলা হয়, নিহতের মধ্যে ৯৭ শতাংশ নারী ও ৬৮ শতাংশ শিশু। ১৫৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৭১ জন, যা মোট নিহতের ৩৩.০৭ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮.৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১২৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৪.৫৬ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৬ জন, অর্থাৎ ১৪.৭০ শতাংশ। দুর্ঘটনাসমূহের ৭৯টি (১৯.৪৫%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪২টি (৩৪.৯৭%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১২৩টি (৩০.২৯%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৪৯টি (১২.০৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা ও ১৩টি (৩.২০%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

এখন দুর্ঘটনার পার্সেন্টেজ যদি যোগ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৪.৪২ ভাগ। এক্ষেত্রে চালকরা সরাসরি দায়ী। অনেক সময় অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে পাশাপাশি গাড়ির কোম্পানিগুলো ড্রাইভারদের দিয়ে ওভারটাইম ডিউটি করানোর ফলেও দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ তে ড্রাইভিং লাইসেন্সের যোগ্যতা: এই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে পেশাদার চালককে ৮ম শ্রেণি পাস ও বয়স ২১ বছর হতে হবে। এছাড়া অপেশাদার চালকের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সের বিধান রাখা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে যদি আইন অনুযায়ী কঠোরভাবে মনিটরিং করা যায় সেক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেকটা কমে আসবে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা অদক্ষ ও কম বয়সী চালকের জন্য হয়ে থাকে।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা ও বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ে হতাহত: এই আইনে বলা হয়েছে, হত্যার উদ্দেশে গাড়ি চালানো হয়েছে বলে মনে হলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা হবে। এই আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এ ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে দুর্ঘটনার প্রকৃতি। প্রতিবেদনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর তদন্ত প্রতিবেদনে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে যদি হতাহতের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সড়ক পরিবহন আইনের ১০৩ ধারায় মামলা হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর জেল অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। অর্থদণ্ডের পরিমাণ আদালত নির্ধারণ করবেন।

চালকের পয়েন্ট কর্তন: এই আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সে ১২টি বিশেষ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। প্রতিটি অপরাধের বিপরীতে সেই পয়েন্টগুলো কাটা হবে। পয়েন্ট কাটতে কাটতে একসময় নীল হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। মোটরযান চলাচলে সাধারণ অপরাধ হিসেবে ২৫টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চালকের সহকারী দিয়ে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানো যাবে না।

১১ ধারা ২ উপধারা (ছ) ধারাতে বলা হয়েছে ‘বেপরোয়া ও বিপজ্জনকভাবে মোটরযান চালনা ও ওজনসীমা লঙ্ঘন’। আমাদের দেশের অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গতিসীমার জন্য হয়ে থাকে। ঢাকা-সিলেট সড়কে সর্বশেষ যে দুর্ঘটনা লন্ডন এক্সপ্রেস ও এনা পরিবহনের মধ্যে হয়েছে সেখানে অতিরিক্ত গতিসীমার জন্যই হয়েছে এবং মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে একটি গাড়ির ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও সহকারী ছিলেন।

মহাসড়কগুলোতে ট্রাকের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে ওভার লোড। সড়ক চলাচলকারী প্রায় সকল ট্রাকই ওভার লোড নিয়ে থাকে। অনেক ট্রাক তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ পণ্য বোঝাই করে যার ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। সড়কের লোড নেওয়ার যে ক্ষমতা আছে তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও লাইফটাইমের আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যে ২/১ জায়গায় ওজন পরিমাপের স্কেল আছে সেগুলোও কার্যকর নয়। বিশেষ করে সিলেট অংশের রুস্তমপুর টোল প্লাজার গাড়ির ওজন পরিমাপে যে স্কেল তা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। দুর্ঘটনা কমাতে হলে মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী গাড়ির ওভার লোড নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজন। আর যেসব চালক এই আইন অমান্য করবে তার পয়েন্ট কর্তন সাথে সাথে করতে পারলেই অনেকাংশে দুর্ঘটনা কমবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ১২ ধারায় বলা হয়েছে (১) ‘কর্তৃপক্ষ বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির নিকট যদি এইরূপ বিশ্বাস করিবার যুক্তিসংগত কারণ থাকে যে, ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী কোনো ব্যক্তি অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম, মদ্যপ, অভ্যাসগত অপরাধী বা অন্য কোনো কারণে মোটরযান চালাতে অযোগ্য, তাহা হইলে কর্তৃপক্ষ বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্ধারিত পদ্ধতিতে উক্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ব্যক্তিকে মোটরযান চালাইবার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করিতে বা তাহার ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল করিতে পারিবেন।’

আমাদের দেশের চালকদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ, অনেক চালক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালনা করে থাকেন এবং দুর্ঘটনার পর এই বিষয়টি প্রায় সময়ই সামনে আসে। তাই এই বিষয়টি মনিটরিংয়ে রাখা উচিত। মহাসড়কের কোনো না কোনো স্থানে যদি চেক করা হয় যে চালক মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন কি না, যদি চালিয়ে থাকেন তাহলে সাথে সাথে তার লাইসেন্স আইন অনুযায়ী বাতিল করতে পারলে অবশ্যই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে।

পরিবহন মালিক-চালকের মধ্যে লিখিত চুক্তি ও পরিবহন মালিকের শাস্তি: এই আইনে পরিবহন মালিককে ২০০৬-এর শ্রম আইন অনুযায়ী অবশ্যই চালকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে হবে। লাইসেন্স ও চুক্তিপত্র ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। চুক্তি না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। চালকের সঙ্গে চুক্তিপত্র ছাড়া কোনো মালিক তার মোটরযানে চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকেরও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

চালক-হেলপারের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ: এই আইনের ৩৯ ধারায় চালক ও তার সহকারীর কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে, যা ২০০৬ সালের শ্রম আইনের আলোকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। মালিককে তা মানতে হবে।

চালক-হেলপারের কর্মঘণ্টা অবশ্যই নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কারণ অনেক সময় ড্রাইভারদের এক জায়গা থেকে ৮-১০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আসার পর আবারও বিশ্রাম না নিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। এর ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে বলে পত্রিকাতে খবর বের হয়। এই বিষয় চালক ও মালিকপক্ষকে আরো বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

সড়ক পরিবহন আইনের ১১ ধারা যদিও আছে কিন্তু এর প্রয়োগ আমাদের দেশে শুরু হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকাতে চালকগণ খুব ভয় পান এবং সাবধানে গাড়ি চালনা করেন। কারণ তার পয়েন্ট যখন কর্তন হতে হতে শেষ হয়ে যাবে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যাবে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে তিনি আর গাড়ি চালনা করতে পারবেন না। এ জন্য তারা আইন মান্য করেই গাড়িগুলো চালিয়ে থাকেন।

১২ ধারা (৩) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল করা হইলে তিনি কোনো মোটরযান চালাইতে পারিবেন না। এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। আর সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ সবকটি ধারা যথাযথভাবে পালন ও প্রয়োগ করতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, কমবে সড়ক দুর্ঘটনা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :