২৫ মার্চ: ফার্মগেইটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড

আসাদুজ্জামান খান কামাল
| আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৯ | প্রকাশিত : ২৩ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৪

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ আর বঞ্চণার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছিল; তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে ’৫২ এর অধিকারের আন্দোলন থেকে ’৬৬ এর স্বাধীকারের আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা ধাপে ধাপে আন্দোলন করে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও যখন পাকিস্তানিরা জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। তখনই বাঙালিদের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীনতার বিকল্প আর কিছু নেই। তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দেলনের গতিপথ। দুরদর্শী বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পরিচালিত করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে।

নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অজুহাত খুঁজতে থাকে সামরিক সরকার। এরইমধ্যে ১ মার্চ, হঠাৎ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। স্ফুলিঙ্গের মত আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঢাকায়। উত্তাল মার্চে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ফার্মগেইট এলাকা।

বঙ্গবন্ধু আলোচনা চালিয়ে গেলেও জানতেন যে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে এবং সেজন্য তিনি আমাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলতেন। তৎকালীন সময়ে ফার্মগেট ছিল প্রতিবাদের মোক্ষম জায়গা। ফার্মগেইটে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমরা ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করতাম। ছাত্রলীগের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং আপামর জনতা আন্দেলনে যোগদান দিত। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে শুরু করি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশ গেইটের এক কিলোমিটারের মধ্যে র্ফামগেইট এলাকায় তখন প্রতিদিনই ব্যারিকেড দেয়া হত। মিছিলে মিছিলে উত্তাল থাকতো রাজপথ।

আমাদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিল তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক ও হাবিব ব্যাংকের সামনে (এখনকার জনতা ব্যাংক ও কনকর্ড টাওয়ার)। স্বাধীনতার জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মধ্যেই দেখতাম উন্মাদনা। সবার দাবি তখন ছিল একটাই; স্বাধীনতা। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের কাছে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বের হতে পারে। কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা ২৫ মার্চ ফার্মগেইটে একটি পরিখা খননের পরামর্শ দেন। পরিখা খনন অসম্ভব ছিল; কারণ ফার্মগেইটের পাশে আর্মিদের অবস্থান ছিল। পরিখার বদলে আমরা ফার্মগেইটে বড় করাত দিয়ে বড় দুটি কড়ই গাছ কেটে গাছের গুঁড়ি ও লোহা লক্কর দিয়ে ব্যারিকেড দেই। আমাদের সহযোগিতা করেন তৎকালীন তেজগাঁও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়াসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও আপামর জনসাধারণ। তেজগাঁও এলাকার শ্রমিকরাও এতে যোগ দেন।

২৫ মার্চ দিনভর মিছিলে-মিছিলে মুখরিত ছিল ফার্মগেইট এলাকা। পরিখা খননের বদলে আমরা কড়ই গাছের গুঁড়ি, পুরনো গাড়ি, লোহার জঞ্জাল জমিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করি। রাত ১০টার দিকে আস্তে আস্তে কমতে থাকে ফার্মগেইটের জনসমাগম। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি কতটা ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। ভয়াল সেই কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করতেই অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সাঁজোয়া যান প্রস্তুত থাকে; যাদের গন্তব্য ছিল রাজারবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানা। আমরাও রাতে ফার্মগেইটের কৃষি বিভাগের বাগানের ভেতরে প্রস্তুত ছিলাম। আর অপেক্ষা করছিলাম কখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাঁজোয়া যান বের হবে। এই দিন দুপুরে আমাদের সাথে যোগ দেন তেজগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা আমাদের কথামত রাতে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকের ছাদে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে পজিশন নেন। সারাদিন মিছিল মিটিংয়ের পর সন্ধ্যায় ফার্মগেইট এলাকায় জনসমাগম কমে আসে।

রাত ১০.৩০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে থাকে ঘাতক সেনাদের কনভয়। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কনভয় এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেইটের সামনে এসে আমাদের বাধার মুখে এবং ব্যারিকেডের সম্মুখে এসে কনভয়ের গতি থেমে যায়। আমাদের কাছে যা ছিল তাই আমরা কনভয়ের উপর ছুঁড়ে ফেলতে থাকি এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করি ফার্মগেইট এলাকা। তখন হাবিব ব্যংকের উপর অবস্থান নেয়া দুই পুলিশ সদস্যও ফায়ার ওপেন করেন। কনভয় এসে রাস্তা পরিস্কার করতে থাকে এবং আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; প্রথমে গুলি, পরে ব্রাশফায়ার করে। গুলির ফলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে বাধ্য হই। আমরা যতক্ষণ ওখানে ছিলাম ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিলাম এবং তারা মেশিনগানের গুলি দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাতকেরা। গোলাগুলির কারণে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে আত্মরক্ষা করি।

পাকিস্তানি ঘাতকেরা ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে আরও সতর্ক হয়ে যায়। ফার্মগেইটের প্রতিরোধের ইতিহাস জানা যায় পাকিস্তানি ঘাতক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে। বইটির ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে ফার্মগেইটে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতিরোধের কথা। যার বাংলা সারমর্ম হলো, “ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সেনাদলটি বাধার মুখে পড়ে ফার্মগেইটে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সদ্য কাটা বড় বড় গাছের গুঁড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে প্রথম দলটিকে থামিয়ে দেয়া হলো। পুরনো গাড়ির খোল এবং অকেজো স্টিম রোলার টেনে এনে রাস্তার পাশের ফাঁকা অংশও আটকে দেয়া হয়।

ব্যারিকেডের ওপাশ থেকে আওয়ামী লীগের অন্তত কয়েকশ কর্মী দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো, মুহূর্তেই সেনাদের রাইফেলের গুলির শব্দ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সাথে মিশে যেন একাকার হয়ে গেল। একটু পরেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে বিস্ফোরণ বাতাসে তীক্ষ্ণ শব্দ তুললো। এরপর কিছক্ষণ ধরে গগণবিদারী স্লোগান ও গুলির শব্দের সঙ্গে হালকা মেশিনগানের গুঞ্জন বাতাসে ভেসে আসতে থাকলো। প্রায় পনের মিনিট পরে গোলমালের শব্দ কমে এলো এবং স্লোগানের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় থেমেই গেল। স্পষ্টতই অস্ত্রের জয় ঘটলো। সেনাদল এগিয়ে গেল শহরের ভেতরের দিকে ।”

ফার্মগেইটে প্রতিরোধের ব্যারিকেড ভেঙে দিয়ে এগিয়ে যায় ঘাতকদল। বাংলামটর এলাকায় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করে তারা। এরপর রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পিলখানা এলাকায় ছুটে যায় সেনা কনভয়। রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ ভাইদের প্রথম সশস্ত্র বাধার সম্মুখীন হয় কনভয়। প্রতিরোধ গড়ে ইতিহাস রচনা করেন বাঙালি বীর পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা হতাহত হন এবং তারা পাকিস্তানি আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে টিকতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাতকেরা রাজারবাগ দখলে নেয়। পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে রক্তাক্ত রাজারবাগে রচিত হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস।

ফার্মগেইটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। কারণ আমরা ট্রেনিং নিয়ে ছাত্র জনতা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিজয় অর্জন করি। এই স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: ২৫ মার্চ ফার্মগেইটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেডের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :