আমার মা

আবুল কাশেম
  প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২১, ১৪:১০
অ- অ+

গরুর গাড়ির খুব একটা প্রচলন এখন নেই। ছোটবেলায় গরুর গাড়ি ছিল আমাদের খেলার অন্যতম উপকরণ। দুই বা চারজন সমান সমান ভাগ হয়ে গাড়ির দুই মাথায় উঠে বসতাম। যদি কোনো পাশে বেশি ভারি হয়ে যেত তাহলে সেই পাশ মাটিতে নেমে যেত। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম যেন সেটি মাটিতে না নামে। মূলত এটিই ছিল খেলার মূল অংশ।

আমার আম্মু ছোটবেলায় কখনো গরুর গাড়ির এই খেলাটা খেলেছেন কি না কখনো শোনা হয়নি। তবে খেলুক না খেলুক এই খেলার মূল বিষয়টি তিনি যে অনেক ভালো করে আয়ত্ত করেছেন তা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারি। সংসার যদি গরুর গাড়ি হয় তাহলে তিনি তার সেরা খেলোয়াড়। এত ভালো খেলোয়াড় যে গাড়িটিকে কখনো মাটিতে পড়তে দেননি।

নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারকে টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন ও বন্ধুর পথ তা শুধু তারাই বুঝতে পারেন যারা এর মধ্য দিয়ে যান বা গিয়েছেন। আব্বু ঘরের বাইরে কাজ করেন আর ঘরের সবকিছু আম্মু দক্ষ সওয়ারের মতো কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে, কখনো হোঁচট খেয়ে এগিয়ে নেন।

ছোটবেলা থেকে বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করিনি কখনো। এখনও করি না। তবে অন্যকে মর্যাদা দেয়ার শিক্ষা, নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রাখা, পড়ালেখাকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়ার শিক্ষাটা আমি বাবা-মা থেকেই পেয়েছি। অন্য বাবাদের মতো আমারও আমার আব্বুর সাথে ছোটবেলায় ঘনিষ্ঠতা ছিল কম। আব্বুকে ভয় পেতাম অনেক বেশি। যদিও আমাকে আব্বু কখনো উঁচু গলায় কথা বলেছেন এটা মনে পড়ে না।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার আম্মু। নিজের যেকোনো কথা অনায়াসেই বলতে পারি। এখনো আম্মুর সাথে বসলে গল্পের কোনো শেষ থাকে না। আমার শিক্ষা জীবনের যা কিছু অর্জন এখন পর্যন্ত তার অনেকটাই বস্তুত আমার আম্মুর অর্জন। রাতে পড়ার সময় চুপে চুপে পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন কী করছি। তবে আম্মু-আব্বু কখনো আমাকে মারেননি কিংবা রূঢ় আচরণ করেননি।

আব্বুর গায়ের ঘাম এবং দক্ষ চালক আম্মুর বদৌলতে আমরা দুই ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। দারুণ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখনো তারা হাসিমুখে সব সামলে নেন। কোনো সমস্যার কথা জানতে চাইলে হাসিমুখে উত্তর দেন- সব ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই। আমিও এখন বাবা হয়েছি। বড় হয়েছি বেশ। তারা না বললেও আমি বুঝতে পারি। খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি।

আমি সন্তানের বাবা হয়েছি। প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ দেখি একটি সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে পৃথিবীতে আসা এবং তারপর এগিয়ে নিতে একজন মাকে কতটা কষ্ট করতে হয়। আমার সন্তানের মায়ের কষ্ট দেখে উপলব্ধি করতে পারি আমিও সারারাত একসময় মাকে ঘুমাতে দিইনি।

এখন দিনকাল অনেক বদলেছে, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। আমার সন্তানের জন্য অনেক কিছু করতে না পারলেও প্রয়োজনীয় সবকিছুই করার চেষ্টা করি। আধুনিক এই সময়ের চেয়ে আরও ২৫ বছরের বেশি সময় আগে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাকে তার সন্তান জন্মদান ও বড় করতে এর চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। এটি বুঝতে খুব বেশি বুঝদার হওয়ার প্রয়োজন হয় না। হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা আমাকে সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন।

শিক্ষিত বা বড় কোনো পরিবারের সন্তান নই আমি। তারপরও আমি গর্বিত আমার আম্মু-আব্বুর জন্য। আমি যখন মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরবো প্রায়। তখন আম্মু সিদ্ধান্ত নিলেন পড়ালেখা শিখবেন। অন্তত কুরআন যেন ভালোভাবে অর্থসহ বুঝে পড়তে পারেন, ধর্মীয় বইগুলো পড়তে পারেন সেই চেষ্টা শুরু করেন। এখন তিনি লেখাপড়ায় অনেক বেশি সফল। প্রচুর বই পড়েন। কুরআন পড়েন। যিনি নিজে সহিহভাবে কুরআন পড়তে পারতেন না তিনি গ্রামের অনেক নারীকে কুরআন পড়া শিখিয়েছেন-শেখাচ্ছেন।

মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। তারপরও সবকিছু সামলে সৎ পথে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। আমার মনে হয় আমি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলাম তখনও আম্মু যেভাবে বুকে আগলে রেখেছিলেন এখনো সেভাবেই রেখেছেন।

প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম কলটি আমি আম্মুকে দিই, বাড়ি থেকে দূরে আসার পর এর ব্যত্যয় খুব কম ঘটেছে। এখন অফিস থেকে বের হয়ে প্রথম কলটি আম্মুকেই দিই। মা-বাবা ছাড়া এই দুনিয়ার কোনোকিছুই আমাকে টানে না। অনেক বড় রেস্টুরেন্টে বসে বিলাসী খাবার খাওয়ার সময়ও আম্মুর হাতের মরিচ-পেয়াজ মাখা পান্তাভাত মিস করি।

আম্মু-আব্বু ছাড়া আমার পৃথিবীতে খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। তাদের মুখের হাসিটা দেখতে জীবনে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করতে পারি। আমার কাছের মানুষদের কাছে প্রায়ই বলি- ‘আম্মু-আব্বুর জন্য যদি পৃথিবীটাও ছেড়ে দিতে হয়, কখনোই দ্বিতীয়বার ভাববো না’। এটা শুধু মুখের কথা নয়। অনেক ভালোবাসি আম্মু। অনেক ভালোবাসি আব্বু।

ঢাকাটাইমস/০৯মে/একে

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বৈষম্যবিরোধী ও এনসিপির আন্দোলনের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার
বাংলামোটরে এনসিপির জুলাই চিত্র প্রদর্শনীর গাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ
তাড়াশে সম্পত্তি লিখে নিয়ে বাবা-মাকে বাড়িছাড়ার অভিযোগ
সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা