তবু কীভাবে এমপি হয়েছিলেন আউয়াল?

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৭ মে ২০২১, ১১:৪২ | প্রকাশিত : ২৭ মে ২০২১, ০৯:৫৪

রাজধানীর পল্লবীতে ছেলের সামনে বাবাকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের সাবেক এমপি ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় জনসমর্থন না থাকলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তা নিয়ে এখন জেলা-উপজেলা জুড়ে সবার একই প্রশ্ন।

তখনো অভিযোগ ছিল, আউয়াল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে চায়নি। পাশাপাশি কেউ সাহস করে মুখ খুললেও টাকার বিনিময় ও হামলা-মামলা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এখন সবার মুখে মুখে একটি কথা, নির্বাচনী এলাকায় জনসমর্থনহীন ব্যক্তি কীভাবে এমপি হয়েছিলেন? তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ আসনের সাধারণ মানুষ।

এদিকে রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংসদের ২৭৪ নম্বর লক্ষ্মীপুর-১ রামগঞ্জ আসন থেকে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সরাসরি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হতে পারেননি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব ও হ্যাভেলি গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল এখান থেকে নৌকা প্রতীকে মহাজোট থেকে নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের একটি বিশাল অংশ ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আউয়ালের চরম বিরোধিতা করে। এ আসনে তরিকতের এক শতাংশ ভোটও নেই। তিনি ছিলেন জনসমর্থনহীন ব্যক্তি। তার প্রতি কোনো সমর্থন ছিল না বলে দাবি করেন অনেকেই।

ঢাকায় খুনের মামলায় এম এ আউয়াল গ্রেপ্তারের পর তার অনুসারীদের মাঝেও বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।

সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন এম এ আউয়াল। রাজধানীর পল্লবীতে সন্তানের সামনে বাবাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক এ সাংসদ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার অনুসারীদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ বা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।

কেউ কেউ আবার এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা বা গ্রেপ্তারে বিস্ময় প্রকাশ করে জানান, আগামী নির্বাচনে তাকে (আউয়াল) অযোগ্য ঘোষণা করতেই নাকি হীনস্বার্থ চরিতার্থ করেছে একটি মহল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও গ্রেপ্তারে মোটা অঙ্কের টাকা লগ্নি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তার অনুসারীরা।

যেবার এম এ আউয়াল নির্বাচিত হন, সেবার নির্বাচনের দিন তার নিজ গ্রাম ৪ নম্বর ইছাপুর ইউনিয়নের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে চলে ব্যাপক সংঘর্ষ ও কেন্দ্রে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। পুরো উপজেলায় চলে তাণ্ডব। নির্বাচনে সরকারি কাজে বাধা, ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়া ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা হয় ৩৪টি মামলা। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধলক্ষ। প্রতিটি মামলায় আসামি করা হয় একই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। একেকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে ডজনখানেক মামলা। পানিয়ালার একটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়ার ঘটনায় মারা যান এক পুলিশ সদস্য।

এম এ আউয়ালকে ইঙ্গিত করে রফিকুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ নিজের ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘লক্ষ্মীপুর জেলার চারটি আসনে ভাড়াটিয়া হাইব্রিড এমপি চাই না। হাইব্রিড নেতা ও এমপির কারণে জেলার মানসম্মান ধুলায় মিশেছে। আগামীতে মাঠের ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাই।’

শিক্ষাবিদ জেড এম ফারুকী নিজের ফেসবুকে আক্ষেপ করে লেখেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য সাংসদ একজন খুনি এবং খুনের মদদদাতা। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমরা বিব্রত ও লজ্জিত।’

এভাবে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

পল্লবীর খুনের মামলায় এম এ আউয়ালের জড়িত ও গ্রেপ্তার হওয়ার পেছনে কেউ কেউ আবার ষড়যন্ত্র দেখছেন। তার স্থানীয় প্রতিনিধি ও ঘনিষ্ঠজন মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এমপি আউয়াল সাহেব খুনের মামলায় কীভাবে জড়িত হয়েছেন, সেটা সন্দেহজনক। আমরা উক্ত ঘটনায় বিব্রত।’

ব্যবসায়িকভাবে তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে কি না, সে বিষয়টি তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করার দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘রামগঞ্জ উপজেলায় এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না। আগামী নির্বাচনে তার জোর সম্ভাবনা ছিল মনোনয়ন পাওয়ার। আমি মনে করি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।’

ভাদুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদ হোসেন ভুইয়া, কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিনসহ কয়েকজন চেয়ারম্যান জানান, এম এ আউয়ালের সহকারীরা বিনামূল্যের সরকারি ঘর, টি-আর, কাবিখা, কাবিটা, চল্লিশ দিনের কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, গভীর নলকূপসহ বিভিন্ন প্রকল্প দেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনেকে টাকা দিয়ে প্রকল্পের সুবিধা পাননি, আবার অনেকে টাকাও ফেরত পাননি। কিন্তু এ জন্য বিপাকে পড়েন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। আউয়ালের সহকারীরা এসব অনিয়ম করে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করে এদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান চেয়ারম্যানরা।

উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রামগঞ্জ পৌরসভার সোনাপুর ৪৫ নম্বর মৌজায় ১৪০০ ও ১৪০৩ এবং ১৪০৭ নম্বর দাগে হিন্দুধর্মাবলম্বী সোনাপুর নাপিত বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা হারাধন চন্দ্র শীলের ১৭ শতাংশ মূল্যবান জমি দখল করেন। হারাধন চন্দ্র মারা যাওয়ার পর তার কোনো ওয়ারিশ না থাকায় আউয়ালের নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে কৌশলে হারাধন চন্দ্র শীলের দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই নারায়ণপুর শীল বাড়ির রাধারাম শীলকে ওয়ারিশ সাজিয়ে রেজিস্ট্রি করে ওই জমি দখলে নেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রুহুল আমিন জানান, এই আসনে বর্তমান সাংসদ ড. আনোয়ার হোসেন খান ছাড়া এর আগে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় সংসদের সদস্য হতে পারেননি।

একে তিনি তাদের দুর্ভাগ্য হিসেবে উল্লেখ করে আ ক ম রুহুল আমিন বলেন, ‘২০১৪ সালে হঠাৎ করেই কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তরিকত নেতা এম এ আউয়ালকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আমরা বাধ্য হই তার নির্বাচন করতে। সে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের দলের বহু নেতা বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন। অর্ধশত ভোটকেন্দ্র ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে সরকারি সম্পদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়।’

উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মারুফ ভূইয়া জানান, ওই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম এ আউয়ালের প্রধান শত্রু ছিল আওয়ামী লীগ। তারাই চায়নি এম এ আউয়াল নির্বাচিত হোক।’

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে হামলা ও আগুন দিয়েছে দাবি করে মারুফ আরও বলেন, ‘বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। আসামির সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। আর একেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৮-১০টি মামলা। এসব মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে দিতে আমরা সর্বস্ব হারিয়েছি। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আল্লাহপাক তার উচিত শিক্ষা দিয়েছেন আউয়ালকে।’

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে তরিকত ফেডারেশনের হয়ে সংসদ সদস্য হন এম এ আউয়াল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে দলীয় গঠনতন্ত্রের ২৪ এর উপধারামতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে তরিকত থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তিনি ছিলেন তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব।

২০১৮ সালের নভেম্বরে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পরের বছর ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

(ঢাকাটাইমস/২৭মে/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

ভারতের রপ্তানির খবরে ১০ টাকা কমলো পেঁয়াজের দাম

অবন্তিকার আত্মহত্যা: এখনো মেলেনি তদন্ত প্রতিবেদন, থমকে গেছে আন্দোলন 

সড়কে এআইয়ের ছোঁয়া, বদলে যাচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা 

এখন তিন হাসপাতালে রোগী দেখছেন সেই ডা. সংযুক্তা সাহা

কোরবানির ঈদ সামনে, মশলার বাজারে উত্তাপ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :