কিশোরগঞ্জে মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার

আমিনুল হক সাদী, কিশোরগঞ্জ
  প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৫৩
অ- অ+

কিশোরগঞ্জ শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় গুরুদয়াল কলেজ মাঠে ১৯৬৬ সালে। এই শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সেসময় গুরুদয়াল কলেজের ফান্ড থেকে মোট ৭০০ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মো. ওয়াসিমুদ্দিন। শহীদ মিনার নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন ছাত্র সংসদের ভিপি এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ।

সেই শহীদ মিনারে সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করে একটি কবিতাও উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। সেই কবিতাটি ঢাকার আবদুর রউফ নামক জনৈক ছাত্রনেতার লেখা।

মো. আবদুল হামিদ শ্বেতপাথরে খোদাই করে নবনির্মিত শহীদ মিনারে সেই কবিতাটি স্থাপন করেছিলেন। একাত্তর সালে পাক বাহিনী সেই শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ছাত্র সংসদের জিএস সাবেক পৌর মেয়র মো. নূরুল ইসলাম নূরুর নেতৃত্বে শহীদ মিনারটি পুণ:নির্মিত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহর থেকে জনতার ঢল নামে। নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি আর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্মরণ করেন শহীদ ভাষা সৈনিকদের।

এভাবেই এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ও পৌর মেয়র মো. নূরুল ইসলাম নূরু।

জানা গেছে, বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের শহীদ হওয়ার খবর পরদিন বিকালে পত্রিকা মারফত কিশোরগঞ্জে এসে পৌঁছে। তাৎক্ষণিক কিশোরগঞ্জের ভাষা সৈনিকদের নেতৃত্বে গুরুদয়াল কলেজ হোস্টেল চত্বরে কালো পতাকা উত্তোলন করে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক মসজিদ ও মন্দিরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আবেদনপত্র প্রেরণ ও মাইকযোগে ঘোষণা করা হয়।

২৩শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় শোক মিছিল। শোক মিছিলে ন্যাশনাল গার্ড নামধারী চারতারা টুপি পরিহিত লাঠিয়াল বাহিনীর হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হন।

২৫শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা করে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরী করে বিকাল ৩টায় রথখলার মাঠে মাটি দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে ভাষা আন্দোলনের উপর কবিতা ও গান রচনা করে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন পুলেরঘাট এলাকার শামসুল ইসলাম হায়দার। রথখলার মাঠে মাটি দিয়ে তৈরি করা শহীদ মিনারই কিশোরগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রায় প্রতিদিনই শত শত ছাত্রের মিছিল ও সমাবেশ চলতো। এ অবস্থায় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী গঙ্গেশ সরকার, আবু তাহের খান পাঠান, আশরাফউদ্দিন মাস্টার, মিছিরউদ্দীন আহমেদসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে আন্দোলনের একপর্যায়ে তারাসহ আরও বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। তাদের গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনের মাত্রা আরও তীব্র হয়। কারাগারে বন্দি অবস্থায় রাজবন্দিরা ইট দিয়ে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে সেখানেও ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

হোদায়েত হোসেন জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলনের বিরবণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘৫২ সনে পশ্চাতপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিতে কয়েকজন শহীদ হওয়ার খবর কিশোরগঞ্জে পৌঁছে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। খবর শুনেই এখানকার ছাত্র সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৩ ফেব্রুয়ারি মুসলিম ইনস্টিটিউট (বর্তমান জেলা পাবলিক লাইব্রেরি) প্রাঙ্গণে হেদায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ। সেই সমাবেশের একমাত্র বক্তা ছাত্রনেতা আবু তাহের খান পাঠান ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের ঘোষণা দেন।

সেসময়ে হেদায়ত হোসেন তার আন্দোলনের সহকর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাংসদ আশরাফুদ্দীন আহমদ (আশরাফ মাস্টার), আবু তাহের খান পাঠান ও আবু ছিদ্দিকসহ আরও অনেকের নাম উল্লেখ করেছিলেন, সারাদেশ যখন ভাষা আন্দোলনে উত্তাল, তখন কিশোরগঞ্জের জনগণ উজ্জীবিত হয়েছিল স্থানীয় তরুণ ছাত্র নেতাদের মিছিল আর সভা-সমাবেশ দেখে।

আশরাফুদ্দীন আহমদ, হেদায়েত হোসেন, আবু তাহের খান পাঠান, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, এবি মহিউদ্দিন আহমেদ, আবু সিদ্দিক, প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গেশ সরকার, মোশারফ হোসেন আকঞ্জি, ফুলে হুসেন, আব্দুল মতিন, আ.ফ.ম সামছুল হুদা, আবু নাঈম, নজরুল ইসলাম, ফজলুল হক, আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, মিছিরউদ্দীন আহমেদ, শহীদুল হক, শামছুদ্দিন আহম্মদ, এম.এ আনিস, মাসুদুল আমিন খান প্রমুখ ছাত্রনেতা সেই সময়কার ভাষা আন্দোলনে কিশোরগঞ্জে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে যারা ভাষা আন্দোলনে অনন্য সাধারণ অবদান রেখেছেন কিশোরগঞ্জের ডা. এএ মাজহারুল হক তাদের অন্যতম।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন ছাত্র হিসেবে ডা. এ এ মাজহারুল হক মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

২২শে ফেব্রুয়ারি রাতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া উনিশ’ বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলন ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জেও এখানকার সংগ্রামী জনতা আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন যোগ্য সহযোদ্ধা হিসেবে। তৎকালীন মুসলিম লীগ ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের সচেতন বীর ছাত্র-জনতা।

১৯৬৩ সালে কিশোরগঞ্জ শহরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়। সে বছরই আবু তাহের খান পাঠানের নেতৃত্বে বের করা হয় প্রভাত ফেরি। প্রভাত ফেরিতে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী নারায়ণ সরকারের লেখা ও অশ্বিনী রায়ের সুর করা কয়েকটি সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। সেদিন সুরের মুর্ছনায় শহরে একটি শোকবিহ্বল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রভাত ফেরিটি কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে নির্মিত একটি প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। সেখানে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার লোক। সেই থেকে কিশোরগঞ্জে প্রভাত ফেরির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

সেদিনের ভাষা সৈনিকদের অধিকাংশই এখন আর জীবিত নেই। এদের মধ্যে শহীদ এবি মহিউদ্দিন আহমেদ কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে তাড়াইল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকার সময় অনেক যুবককে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। আর সেই কারণে তাকে একাত্তরে কিশোরগঞ্জ শহরের কাচারি বাজার এলাকা থেকে রাজাকাররা তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে হত্যা করে। তার লাশটিও পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় অবশ্য এখন আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত করছে। শহীদ পরিবারটিও ঘাতকদের বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/এসএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জনতা ব্যাংকের পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন
বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমির স্বপ্নপূরনে সদা সচেষ্ট বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি
রেডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বে ভিউয়ের সঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার পার্টনারশীপ
১২ দলীয় জোট থেকে জাগপাকে অব্যাহতি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা