ঘাটতি না থাকলেও যে কারণে বাড়ছে চালের দাম

দেশের খুচরা বাজার, পাইকারি কিংবা মিলগেট- ঘাটতি নেই কোথাও চালের। দুর্ভিক্ষ হওয়ারও কোনো আশঙ্কা তো নেই-ই, উপরন্তু সরবরাহ রয়েছে স্বাভাবিক। এসবের পরও নানান অজুহাতে দিনদিন বাড়ছে চালের দাম। দাম বৃদ্ধির ফলে দিনদিন নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে। দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে ৩টি বিষয় সামনে এসেছে। কারণ ৩টি হলো- অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ, বাজার থেকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর চাল ক্রয় এবং সাম্প্রতিক সময়ে সংকটের খবরে সাধারণ মানুষের হঠাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল ক্রয়।
৭ দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে চালের দাম। আর খুচরা বাজারে বেড়েছে কেজি প্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
শনিবার ঢাকার কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকা। নাজিরশাইল চাল ৭০ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা ও হাইব্রিড মোটা ৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হতো খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৫ থেকে ৭২ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৬৫ থেকে ৭৮ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা, মোটা চাল স্বর্ণা ৪৬ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ৪৬ টাকা দরে।
পাইকারি বাজারে চিকন চাল প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা ৩৪০০ থেকে ৩৫৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে মানভেদে বিক্রি হয়েছিল ৬২ থেকে ৬৯ টাকা আর বস্তা ৩০০০ থেকে ৩৪০০ টাকা।
নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৩ থেকে ৭৫ টাকা আর ৫০ কেজির বস্তা ৩২৫০ থেকে ৩৭৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৭২ টাকা, বস্তা ৩০০০ থেকে ৩১০০ টাকা।
মাঝারি মানের প্রতিকেজি বিআর ২৮ নম্বর প্রতিকেজি চাল ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা আর বস্তা ২৭৫০ থেকে ২৮৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৫ থেকে ৫৫ টাকা, বস্তা ২৭০০ থেকে ২৭৫০ টাকা।
মোটা চাল প্রতি কেজি স্বর্ণা মানভেদে ৫০ থেকে ৫২ টাকা আর বস্তা ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা, বস্তা ২৩৫০ থেকে ২৪০০ টাকা।
হাইব্রিড ধানের চাল বা সবচেয়ে মোটা চালের দাম কেজিতে ৪৬ টাকা আর বস্তা ২৩০০ টাকা, যা আগে ছিল ৪১ টাকা কেজি, বস্তা ২০৫০ টাকায় বিক্রি হতো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বাজারে বর্তমানে যেসব চাল সরবরাহ রয়েছে, তা বোরো মৌসুমের। বোরোর শেষ পর্যায় ও আমনও উঠতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বাজারে নতুন চাল আসছে। তারপরও দাম বাড়ছে হুজুগে। আগামী বছর সংকট হতে পারে সেই খবরে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল কিনছে। আমনে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে ধানের দাম বেশি।
এছাড়া কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বাজার থেকে চাল কিনে নিচ্ছে এবং সরকারও এ বছর ধান ও চালের দাম বেশি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা মানা হচ্ছে না কোথাও। কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদ করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা পরে বেশি দামে মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ী কমানো, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা, সংকটের খবর নিয়ে সবাইকে আরও সচেতন করতে প্রচার বাড়ানো এবং সরকারের মনিটরিং বাড়ানোর পরামর্শ ব্যবসায়ীদের।
গোড়ান কাঁচা বাজারে চাল কিনতে আসা আব্দুস সোবহান বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনের দিনে কিভাবে সংসার চালাব- ভাবতেই পারি না। আবার শুনছি সামনে চালের দাম বেড়ে যাবে, তখন যে কি করব- ভেবে পাচ্ছি না।’
যাত্রাবাড়ী চালের আড়তে চাল কিনতে আসা সাইফুল ইসলাম জানান, সীমিত আয়ের মানুষ আমি। ৬ জনের সংসারের হাল স্বাভাবিকভাবেই টেনে নিয়ে চলছি। কয়েক দিন ধরেই শুনছি চালের দাম বাড়বে। তাই কয়েক বস্তা চাল কিনে রাখছি। দাম বেড়ে গেলে তো আরও সমস্যায় পড়তে হবে।
পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। বিক্রিও অনেক বেড়েছে। এরপরও সব ধরনের চালের দাম পাইকারিতে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোকামে দাম বাড়ায় তারাও বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন।
তারা আরও জানান, বাজারে নতুন চাল আমন আসতে শুরু করেছে। কিন্তু দাম বেশি। কারণ এ বছর আমন ধানের দাম বেশি। সরকার এ বছর ধানের দাম বাড়িয়েছে ফলে সাধারণ কৃষক তো বেশি দামে ধান বিক্রি করছে। যদিও তাদেরও উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
এছাড়া বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বেশি চাল কিনে নিচ্ছে। তারপর তারা আরও বেশি দামে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়ে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছর সংকট হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। ফলে মানুষ হুজুগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। এজন্য কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান নিতে হবে, সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে আগামী বছর সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে সতর্ক হতে বলার পর থেকেই হঠাৎ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাল কেনার প্রবণতা বেড়ে গেছে। হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় দামও একটু বেড়েছে। মোটা ও চিকন সব ধরনের চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে মোটা চালের দাম একটু বেশি বেড়েছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মোকাম মালিকরা জানান, দেশে চালের কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই। বাজারে বর্তমানে বিক্রি হওয়া চাল প্রায় ছয়-সাত মাস আগের। মজুদও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে আমন চালও বাজারে চলে আসছে। সরবরাহ আরও বাড়লেও দাম খুব একটা কমবে বলে মনে করছেন না মোকাম মালিকেরা। নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বলেন, আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলে দেশে ধান-চালের সংকট হবে না। বর্তমানে আমন ধানের দাম বেশি। উৎপাদন খরচও বেড়েছে, সব মিলিয়ে দাম বেশি।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। যদি হয়, তাহলে সেটা হবে খাদ্য সাপ্লাই না থাকার কারণে। নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়াতে হবে এবং যাদের আয় কম তাদের রেশনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
পূর্ববর্তী বছরের চেয়েও এবার ওএমএসে চাল কম দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী ওএমএসে চাল না পাওয়ার ফলেই খুচরা বাজারে সেই চাপ পড়ছে। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যবসায়ীদের লোভাস্ফীতির ফলেই দিনদিন দাম বাড়ছে চালের।’
‘চালের সংকট নেই’ জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘দেশে আমন কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। নতুন ধান উঠছে, বাজারে নতুন চাল আসছে। তবে চালের সংকট না থাকলেও অসৎ ব্যবসায়ীর সংকট নেই। নাই নাই শব্দের কারণে দাম বাড়ছে। অনেকেই চাহিদার চেয়ে বেশি চাল কিনছে।’
দুর্ভিক্ষ আসছে- এই আতঙ্কে ৩-৪ গুণ খাদ্য কিনে মজুদ না করার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি- বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসবে না, আসবে না, আসবে না। দেশে ধান-চালের কোনো সংকট হবে না।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে সারা বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট চাল আমদানি হয় ১০ লাখ ৬৭ হাজার টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল মজুদ রয়েছে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৮ টন এবং ধান ১১ হাজার ৬৩২ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, মাঝারি মানের ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং সরু চালে দশমিক ৬৯ শতাংশ।
(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর)

মন্তব্য করুন