গবেষণা চুরি পাঠ্যবইতে চুরি পাঠদানে চুরি– আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:২৬ | প্রকাশিত : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:০৬

সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে লেখা চুরির অভিযোগ এসেছে এবং সেই চুরি ও দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা লেখকদের পক্ষে বিজ্ঞানী, যিনি ছিলেন সম্পাদক ও লেখক উভয় দায়িত্বে, অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক হাসিনা খান দায় স্বীকার করেছেন। বিষয়টি নাদিম মাহমুদ নামে একজন গবেষক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাতে উপস্থাপন করেছেন এবং সেটা ৭১ টিভিতে আলোচিত হয়েছে। আমরা জেনেছি, কোনো একজন লেখক এই দুর্জনের কাজটি করেছেন।

শুধু তাই নয়, নিজে অনুবাদ না করে গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করে অনুবাদ করেছেন এবং সেটা তিনি স্বীকার করেননি। যদিও সমালোচকেরা মনে করছেন, অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিষয়টিকে হালকা করে দেখাচ্ছেন। কেবল অধ্যাপক জাফর ইকবাল নন, সমাজে অনেকেই আছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হালকা করে দেখেন এবং এই হালকা করে দেখার প্রবণতা আমাদের অনেকেরই মাঝে সংক্রমিত হচ্ছে। একটি গবেষণা চুরির বিষয়কে এভাবে হালকা করে দেখার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন- আমরা সবাই কম-বেশি ভুল করে থাকি। এভাবে যদি উত্তর দেওয়া হয়, তবে হতাশা ছাড়া আশার কিছু থাকে কি? তবুও কিছু মানুষ চেষ্টা করে যান।

আমি জনাব নাদিম মাহমুদ এবং অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক হাসিনা খানকে ধন্যবাদ দিতে চাই। জনাব নাদিম মাহমুদ অনুসন্ধান করে জাতীয় পর্যায়ে সুনাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন- যখন সুশাসন একটি প্রত্যয় মাত্র এবং লজ্জায় সে মরে যাচ্ছে আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে! আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক জাতিকে যা উপহার দিচ্ছি তা এক নিলজ্জতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেই সত্য আমাদের বিবেককে যেন নাড়া দেয়- আমরা যেন বলতে পারি গবেষণা চুরি সত্য-মিথ্যা কিংবা ষড়যন্ত্র নয়।

সরকার শুদ্ধাচার নীতি গ্রহণ করেছে। সেখানে যারা পাঠদান করেন সেটাও প্রশ্ন করা যায় - চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা হয়ে গেছেন নীতিবিদ সক্রেটিস, দোকানদার হয়ে গেছেন ডাক্তার, চিকিৎসা ছেড়ে ডাক্তার হয়েছেন আইনজীবী কিংবা সংসদ সদস্য। ঠিক এমন সময়ে অধ্যাপক জাফর ইকবাল সত্য লুকাতে চাননি। অর্থাৎ সত্য যে এখনো বেঁচে আছে সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। সমাজের দাবি, তেমনিভাবে শিক্ষক-উপাচার্যরা যেন প্রমাণ করেন উনারা দুর্নীতিকে ফাঁসি দিতে মায়ার জালে আটকে নেই। গবেষণা চুরির একটি মারাত্মক অপরাধ। সেই চুরির অনেক অভিযোগ মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং উপাচার্যদের কাছে দিনের পর দিন পড়ে আছে বা থাকে।

শিক্ষকদের চুরির মাথায় পচনের মতো একটি বিষয়। সেই পচন রোধ না করলে আমরা যতই উন্নয়ন করি না কেন সেটা টেকসই হবে না। সেটি ওই মঞ্চের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। নৈতিকতা হলো সমাজের সিমেন্ট আর শিক্ষা হলো ওই ভবনের রড বা মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড যদি শক্ত না হয় কিংবা সিমেন্ট যদি ভেজালের হয় বা কমতি থাকে তবে জাতি হাজার বছর পিছিয়ে পড়বে। স্মার্ট বাংলাদেশ অধরা থেকে যাবে।

এখানে একটি ঘটনার কথা বলি। গবেষণা চুরির একটি অভিযোগ প্রায় এক বছর আগে একটি জার্নালের সম্পাদকের কাছে করা হয়। জার্নালের সম্পাদক অভিযোগকারীকে বলেন পত্রিকায় দিতে- তাহলে বিচার করা সহজ হবে। অপরদিকে, অভিযোগকারীকে আরেকটি মহল অনুরোধ করে এটা গুরুত্ব না দিতে। আরেকটি মহল নরম-কোমল একটি হুমকি দিয়ে রাখেন। অভিযোগকারী বিগত ৭ মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরছে! অভিযোগকারী অন্তত ২৫ জন সাংবাদিককে এই তথ্য দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোক, সরকারি দপ্তর অভিযোগ সম্পর্কে জানেন। আমলে নিয়েছেন কেউ কি? যদি জানতে চান উত্তরটা বেদনা দায়ক। একটি মাত্র পত্রিকা এই সংবাদটি ছেপেছে। অনেক স্বনামধন্য সম্পাদককে লেখা হয়েছে, টেলিফোনে বলা হয়েছে। তাদের কেউই অভিযোগ আমলে নেয়নি। সাংবাদিক নির্ভিকতার প্রতীক, সত্যের সন্ধানী, সত্য প্রকাশ অবিচল। কিন্তু সত্য এখন বোতলবন্দি। মিথ্যা এখন বুক ফুলিয়ে চলে।

গবেষণা চুরির বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট দেখে ওই সংবাদটি কমেন্ট কলামে শেয়ার করেছি। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে ওই পোস্টটি উধাও হয়ে গেছে! দৈনিক মানবজমিনের শিরোনাম ‘গবেষণায় অন্যদের ৯৮ শতাংশ চুরি, আমার ৭২ শতাংশ চুরিতে প্রশ্ন কেন? সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন, ৩ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার। এভাবে যদি কেউ বলেন তবে কী বলার আছে? তিনি এই মন্তব্য করে থাকেন, তিনি যদি ভুল পথে চলার বিষয়কে এভাবে স্বীকার করে থাকেন, তবে তাকেও কি আমরা ধন্যবাদ দেব? সত্যের পথে ফিরে আসার জন্য আরেকটু পথ বাকি আছে। যে বেতন সুবিধা নেওয়া হচ্ছে সেটাও সংশোধনের প্রয়োজন আছে বৈকি!

অধ্যাপক জাফর ইকবালকে তাই আমার আবারও ধন্যবাদ। মাত্র দুটি প্যারাগ্রাফ চুরি করা হয়েছে বলে যদিও গুরুত্ব কমাতে চেয়েছেন তবুও অকপটে স্বীকার করেছেন যে ঘটনাটি সত্য। তিনি তো বলতে পারতেন ওনাদেরকে না জানিয়ে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে! কিংবা এটা অমুক বা তমুক গ্রুপের কারসাজি! মানবজমিনের রিপোর্ট পত্রিকায় এসেছে- সেটার কোনো প্রতিবাদ আমরা পাইনি। যেসব শিক্ষকের নাম এসেছে তারা কি জানেন না? এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে উপাচার্যরা কেন আছেন? কেন প্রশাসন আছে? কেন supervisor বা reviewer আছেন? বিশ্ববিদ্যালয় একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেন কি চুরি বা অনুবাদকে উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়ার জন্য? যদি আমার চুরিবিদ্যাকে এভাবে বিভিন্ন মহল থেকে আমলে আনার পরিবর্তে সুরক্ষা দেই, চেপে যাই, মানবিকতাকে আনি তবে জাতির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। এভাবে যদি আমরা শর্টকাট পদ্ধতিতে উন্নত জাতিতে উন্নীত হতে চাই সেটা কি সম্ভব?

অভিযোগকারী থিসিসের পরীক্ষকদেরকে কাছে জানতে চেয়েছেন- অধ্যাপক জাফর ইকবাল দায় স্বীকার করেছেন- আপনারা কী করবেন? চেয়েছেন উত্তর পাননি! শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আদর্শ পুরুষ বা নারী। তিনি সত্যের সন্ধানী ও অনুসারী। তিনি কি তবে শক্তিহীন যে সত্যকে আলিঙ্গন করবার শক্তি ও সাহস নেই?

আরেকটি পুরনো ঘটনা বলে শেষ করতে চাই। ২০১০ সালে আমার বিভাগের সহকর্মীদের দক্ষতায় একটি গবেষণা কর্মের চুরি সম্পর্কে জানতে পারি। তারা আমার কাছে একটি আবেদন করে। আমি বিভাগের সভাপতি হিসেবে আবেদনটি তত্ত্বাবধায়কের কাছে অগ্রায়ণ করি মৌখিক পরীক্ষার আগের দিন। পরের দিন ভাইভাতে এসে একজন পরীক্ষক আমাকে বুকে টেনে দিয়ে বলেন- তুমি আমাকে জীবনের শেষবেলায় একটি অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছো। অভিযোগকারী ভেবেছিল ঠিক সেইভাবে এবারও কেউই বুকে টেনে নিয়ে বলবে– ‘সাবাশ! তুমি আমার মান রক্ষা করেছো।’ কিন্তু তিনি অধ্যাপক জাফর ইকবাল হতে পারেননি।

আমরা আরও অধ্যাপক জাফর ইকবালের অপেক্ষায় আছি! আমরা ওই উপাচার্য মহোদয়দের দিয়ে তাকিয়ে, যারা বিচারহীনতা, ইনডেমনিটির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমাদের আশা, উপাচার্যরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর চালু করবেন না।

অধ্যাপক হুমায়ন আজাদ আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের গ্রন্থের উপর একটি লেখা লিখেছিলেন। আমাদের এক শিক্ষক তিনি সন্তানকে মাদকের হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমরা সেই রকম নৈতিকতার অপেক্ষায় আছি। একদিন আমাদের বিবেক জাগবে!

লেখার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই- গবেষণা চুরি সম্পর্কিত একটি বিভ্রান্তিকে দূরীভূত করবার চেষ্টা থেকে। গবেষণা চুরি সম্পর্কে আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে। আমরা কেউ কেউ বলি ২০% বা ৩০% গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এটা একটি ভুল ধারণা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আছে ‘Plagiarism (চন্দ্ররেণু বিদ্যা- অমর্ত্য সেনের স্ত্রী নবনিতা সেন এই অনুবাদক জানালেন ইতিহাসের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, চ্যানেল ২৪, ইউটিউবে আছে /২০/১/২০২৩ দেখা) is presenting someone else’s work or ideas as your own, with or without their consent, by incorporating it into your work without full acknowledgement. All published and unpublished material, whether in manuscript, printed or electronic form, is covered under this definition. Plagiarism may be intentional or reckless, or unintentional. Under the regulations for examinations, intentional or reckless plagiarism is a disciplinary offence (https://www.ox.ac.uk/students/academic/guidance/skills/plagiarism).’

যথাযথভাবে স্বীকার না করলে কিংবা যথাযথভাবে রেফারেন্স না দিলে চুরি হিসেবে গণ্য হবে। একটি আইডিয়া একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন গণতন্ত্র একটি ‘প্রক্রিয়া’ গবেষককে এখানে বলতে হবে এটি কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আবিষ্কার। তেমনি ‘নিজেকে জানো’ বক্তব্যটি সক্রেটিসের। সেটাকে গবেষণায় ব্যবহার করতে হলে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে বলতে হবে।

গবেষণা বা পাঠ্য পুস্তক রচনা কঠিন একটি কাজ যেখানে সতর্কতা খুবই জরুরি। গবেষণা সৃষ্টিকে বলা হয় অভিসন্দৰ্ভ। এর মানে হলো- অতীব সুন্দর একটি রচনা। এখানে থাকে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ও নকশা। পিএইচডি তাই অতি মূলবান। আমরা অভিযোগ শুনি পিএইচডি এখন কিছু শিক্ষক মুড়ি-মুড়কির মতো বিলোচ্ছেন। অধ্যাপক পদ হয়ে গেছে হাতের মোয়া। যেনতেন কাজ দিয়ে সেটাকে পাওয়া যাচ্ছে। সুড়ঙ্গ পথে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পদোন্নতি নিচ্ছি। এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের দায়িত্ব আমাদের। দিনে পর দিন ক্লাস হয় না শুনতে আর ভালো লাগে না। পাঠদানে চুরি, গবেষণা চুরি, পাঠ্যপুস্তকে চুরির দায় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা কি দায় এড়াতে পারেন?

গবেষণা চুরি করে পদোন্নতি নেওয়া রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ চুরি এবং তার বিচার না করা চুরিকে বৈধতা দেওয়া। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আছে ভিক্ষুক, গরীব চাষী, ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায় বিধবা, পাথর ভাঙা শিশুর কষ্ট, খেটে খাওয়া মজুরের পানি করা রক্ত-ঘাম। আমরা যেন রক্তচোষা নিম্নতর প্রাণী না হই! শিক্ষকদের জাগরণের প্রত্যাশায় জাতি অপেক্ষায়।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :