টিপু হত্যা: লাল ফিতায় মোড়ানো মুসার জবানবন্দিতে আটকে আছে রহস্য

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩৯

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডে ওমান থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা সুমন শিকদার ওরফে মুসার জবানবন্দি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধুম্রজাল। এ জবানবন্দি রেকর্ডের পর আদালতের আদেশে সরাসরি লাল ফিতায় মুড়িয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া হলেও জবানবন্দির সেই গোপন তথ্য ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে নানা কথা, নানাজনের নাম। তৈরি হয়েছে তদন্ত ‘বিভ্রান্তের’ আশঙ্কা। এ নিয়ে বিব্রত তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ।

‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ এলোমেলো বক্তব্য প্রদান ও তথ্যপ্রকাশ থেকে বিরত থাকতে মামলার বাদী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার। সোমবার ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে আদালতে বিচারাধীন ও তদন্তানাধীন এ মামলার বিষয়ে যে কোনো বক্তব্য ও তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাদীসহ অন্যদের সতর্ক হতেও অনুরোধ করেন।

এদিকে আসামিদের জবানবন্দির বরাত দিয়ে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম বলছেন মামলার বাদী নিহত টিপুর স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সহসভাপতি ফারজানা ইসলাম ডলি। ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ২৫ আসামির ৫ জনকে জামিন দেওয়ায় প্রশ্ন তোলেন তিনি। প্রকাশ্যেই বলছেন, চার আওয়ামী লীগ নেতার নাম। যাদের দুজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তদন্তকারী সংস্থার ওপর তার আস্থা থাকলেও চার্জশিট দাখিল না করায় ইদানিং একটু কষ্ট পাচ্ছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কথা ঢাকাটাইমসকে বলেন তিনি।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও এক কাউন্সিলরের নাম উল্লেখ করে ডলি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে যে বার্তা পাঠিয়ে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাতে তাদের নাম রয়েছে। এতে সন্দেহ বেড়ে গেছে।’

‘জবানবন্দি কেন সিলগালা করে রাখা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? ১০ মাস পার হলেও কেন চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে না? সরিষার ভেতরে কি ভূত ঢুকেছে?’ এসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন মামলার বাদী ডলি।

আদালত সূত্র জানায়, মুসার জবানবন্দিকে আদালত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে লাল ফিতায় বেঁধে তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়াসিনের কাছে হস্তান্তর করে।

জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ইয়াসিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাদী এসব আন্দাজে (অনুমাননির্ভর) বলছেন। ওই তথ্য সুরক্ষিত আছে। যেসব তথ্য ছড়ানো হচ্ছে মুসার গোপন জবানবন্দি ঘিরে, তা ভিত্তিহীন।’ বাদীসহ কেউ যাতে আদালতের গোপন বিষয় বা তদন্তের গোপন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ায় সে বিষয়ে সতর্ক করেন তিনি।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গোপনীয়তা রক্ষা করে ওই জবানবন্দি আদালত তার কাছে পাঠিয়েছে। তা গোপন রয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত তা গোপনই থাকবে। এ জবানবন্দি নিয়ে অনুমাননির্ভর তথ্য ছড়ানো বেআইনি।

কেউ বা কোনো গোষ্ঠী তদন্ত কার্যক্রম বিতর্কিত করতে বা খুনিদের আড়াল করতে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকতে পারে এবং এ বিষয়ে তারা সতর্ক আছেন বলেও জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে টিপু হত্যার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত। এ দিন প্রতিবেদন দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ইয়াসিন বলেন, আদালত থেকে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশের চিঠি পাননি তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদন দিতে সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, মামলাটি এখনও তদন্তনাধীন। সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে ঘটনার গভীরে গিয়ে প্রকৃত সত্য বের করে আনতে চায় ডিবি পুলিশ।

মুসা তার জবানবন্দিতে যাদের নাম বলেছেন, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাদের নাম এসেছে- হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের দৃশ্যমান সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আবিষ্কার করার চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি পুলিশ। এছাড়া মামলার বাদী ও জামিনে বের হওয়া আসামিদের কর্মকাণ্ড নজরে রাখা হচ্ছে বলেও তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়। এদিকে মামলার বাদী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সহ-সভাপতি হয়েও একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকে জড়িয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ার কথা জানান টিপুর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠদের কয়েকজন। তারা এখনও টিপুর স্ত্রীকে সন্দেহের বাইরে বলে মনে করছেন না। তাদের অভিযোগ, খুনিদের সঙ্গে টিপুর স্ত্রীর যোগাযোগ আছে। খুনিদের আড়াল করতে এলোমেলোভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বলছেন টিপুর স্ত্রী। যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেই মনে করছেন তারা।

তবে এ বিষয়ে টিপুর স্ত্রী বলেন, ‘আমি কারও কথা শুনে কোনো অভিযোগ করি না। আমি আদালত, ডিবি কার্যালয়ে যাওয়া আসা এবং মামলা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি- তার ভিত্তিতেই কথা বলছি। আমার স্বামী খুন হয়েছে, আমি নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছি। আমার দিকে সন্দেহের আঙুল তুলে লাভ কি?’

তিনি বলেন, ‘আমি হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। প্রকৃত খুনিদের শাস্তি চাই। প্রধানমন্ত্রী আমার অভিভাবক। তার কাছে আমি এ অনুরোধ জানাতে চাই।’

‘টিপুর সহায়-সম্পত্তি টিপুর স্ত্রী-সন্তানদের কাছেই থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে টিপু কোনো অবৈধ কাজে যুক্ত ছিলেন না, কোনো চাঁদাবাজির প্রমাণ তার বিরুদ্ধে কেউ দিতে পারবে না। আর আমিও স্বচ্ছ রাজনীতি করি’, বলেন ডলি। আর জিডি করে কোনো লাভ হয় না। তাই এখন হুমকি পেলেও জিডি করি না।

টিপুর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠরা বলছেন, কোনো পক্ষ যেন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, যেন খুনিদের আড়াল করতে না পারে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ অনুরোধ তাদের। প্রকৃত খুনি যে দলেরই হোক তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবিও তাদের।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে খুন হন টিপু। ওই সময় তার গাড়ির পাশেই রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতি নিহত হন। আহত হন টিপুর গাড়িচালক মুন্না। পর দিন টিপুর স্ত্রী শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে ডিবি পলিশ। তবে টিপুর পরিবার ছাড়া আর কোনও ভুক্তভোগী মামলা করেননি।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘টিপু আমার সন্তানের মতো। এ হত্যাকাণ্ড আমার কাছে অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়ুক, তাদের শাস্তি হোক- এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’

পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, টিপু হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২৫ আসামি হলেন- সুমন শিকদার ওরফে মুসা, নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, ওমর ফারুক, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্যা পলাশ, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, আবুল হোসেন মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ, ইমাম খান ওরফে দামাল, নাসির উদ্দিন মানিক মারুফ খান, মশিউর রহমান একরাম, ইয়াসির আরাফাত সৈকত, সেকান্দার সিকদার আকাশ, হাফিজুল ইসলাম, ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইমরান হোসেন জিতু, রাকিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, জুবের আলম খান রবিন ওরফে রেলওয়ে রবিন, আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ‘ঘাতক’ সোহেল, খাইরুল ইসলাম, সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ রেজা সাগর, শামীম হোসাইন ওরফে মোল্লা শামীম, তৌফিক হাসান ওরফে বাবু, সুমন হোসেন ওরফে সুমন, এহতেশাম উদ্দিন চৌধুরী ওরফে অপু ও শরিফুল ইসলাম ওরফে হৃদয়।

এদের মধ্যে মুসা, আকাশ ও নাসির হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামিদের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইয়াসির আরাফাত সৈকত ও রাকিবুর রহমান এবং এছাড়া ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মশিউর রহমান একরাম ও আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল জামিন পেয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/০৭ফেব্রুয়ারি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :