‘সংবিধান’ নিয়ে মুখোমুখি দুই দল

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৬

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর এক বছরেরও কম সময় বাকি আছে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনীতির মাঠে ততই উত্তাপ বাড়ছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এখন মুখোমুখি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘কাটাছেঁড়া সংবিধানে’ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই থাকছেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান। তার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ পরিবর্তন আনা হয়।

আর বিএনপি নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া বাতিলের যে দাবি তুলেছে, সে দাবিতে তারা একক ও যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে-তা বাস্তবায়ন করতে হলে বাতিল করতে হবে পঞ্চদশ সংশোধনী। পরিবর্তন করতে হবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ইতোমধ্যে। তাদের আসনগুলোতে উপনির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিএনপি সংবিধান সংশোধনে সংসদে লড়াই করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপির দাবি মানতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর তা নির্ভর করছে সংসদ সদস্যদের ওপরে।

মোটকথা আওয়ামী লীগ না চাইলে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপির পক্ষে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যদিও বিএনপি যে ১০ দফা দাবিতে গেল বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে, তাতে সংবিধানের ওই সংশোধনী বাতিলপূর্বক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি অন্যতম।

এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য দেশের প্রধান দুই দলকে শান্তিপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে সংবিধানের নির্বাচনকালীন এই আইনি বিধান নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে সংবিধান নিয়ে আলোচনা তুলছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা সংশোধিত সংবিধানের পক্ষে অনঢ়। আর বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে একাট্টা রয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের (সংসদ) যাত্রা শুরু হয়। গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহিত হয় ৪ নভেম্বর। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কার্যকর হয় এ সংবিধান। এরপর ৫০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয় ১৭ বার। সামরিক শাসকের ছাতার তলায় ‘নির্বাচিত’ সংসদে সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮৮ সালে। পরে রাজনৈতিক সরকারগুলো বিভিন্ন সংশোধনী আনলেও তারা রাষ্ট্রধর্মের জায়গায় আর হাত দেয়নি।

গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের বিজয়ের পর ৯০ দশকের শুরুতে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনী পাস হয়েছিল।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। পরে পাল্টা সংশোধনী এনে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে তারপর নির্বাচন দিয়েছিল। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়।

এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আর কোনো নির্বাচন করার সুযোগ না রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেখানে ফিরিয়ে আনা হয় রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা। এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সে সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোন অধিবেশন বসবে না। সেই সময় সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলে বিধান রাখা হয়।

তবে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করেছিলো। নবম জাতীয় সংসদে সংশোধনীটি পাসের সময় বিএনপি-জামায়াতের সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯১টি। পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে এনেছিলেন ২০১১ সালের জুন মাসে।

কাটাছেঁড়া সংবিধানে নির্বাচন নয়: মির্জা ফখরুল

কাটাছেঁড়া করে সাজানো সংবিধানে আওয়ামী লীগের তামাশার নির্বাচন বিএনপি হতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল ঢাকার উত্তরায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শুরুর আগে এক সমাবেশে তিনি একথা বলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হবে। কোন সংবিধান? যে সংবিধান কাটাছেঁড়া করে একটি পাতানো নির্বাচনের জন্য সাজিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ? যে নির্বাচনে ভোট দিতে যায় না মানুষ।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এইবার তামাশার নির্বাচন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। এজন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন হচ্ছে।’

সংবিধানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সংবিধান: মঈন খান

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘মানুষ যেভাবে চায়, সেভাবে সংবিধান লিখিত হবে।’ তিনি বলেন, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সংবিধান। গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন।

মঈন খান বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজনে স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান বারবার লিখিত হয়েছে, পুনঃলিখিত হয়েছে এবং তা হতে থাকবে। মানুষের প্রয়োজনে যেভাবে সংবিধান তৈরি করতে হয়, ঠিক সেভাবে করতে হবে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ বাতিল করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ দাবি করেছিল। সঙ্গে ছিল জামায়াত ইসলাম। তখন জামায়াত জোরদার দল ছিল, এখন ততটা নাই। জামায়াত ইসলাম যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করেছিল, আওয়ামী লীগ হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬ সালে হালাল ছিল, আজ তা কেন হারাম হয়ে গেল?’

তিনি বলেন, জনগণের দাবির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন খালেদা জিয়া।

সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই: আইনমন্ত্রী

নির্বাচন নিয়ে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসে, সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা সংবিধানের নিয়ম মেনেই নির্বাচনে আসবে।’

গতকাল রাজধানীর বিচার প্রশাসন ইনস্টিটিউটে সহকারী জজদের ওরিয়েন্টেশন কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী এ কথা বলেন।

আনিসুল হক আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সংবিধানে বিশ্বাস করে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এর ঊর্ধ্বে নয়। যারা সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা সংবিধানের নিয়ম মেনেই নির্বাচনে আসবে।’

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমঝোতা পরবর্তীতে হবে কিনা—তা নিয়ে এখনও নিশ্চয়তা কাটেনি। এমন ‘অনিশ্চিত’ দাবি নিয়ে মাঠে আছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর। আর আওয়ামী লীগও নিচ্ছে নির্বাচনী প্রস্তুতি।

(ঢাকাটাইমস/০৫মার্চ/আরকেএইচ/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

অবশেষে রাজধানীতে নামল স্বস্তির বৃষ্টি

গাজা যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যকে পাশে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

আ.লীগ ক্ষমতায় থাকায় মানুষের জীবনমান উন্নত, সংসদে প্রধানমন্ত্রী

উপজেলা নির্বাচন: তৃতীয় ধাপে ১৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

বজ্রপাতে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রাণ গেল ছয়জনের

চলতি মাসে আরও দুটি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে

পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবেদন করতে গিয়ে সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হলে সুরক্ষা পাবেন: তথ্য প্রতিমন্ত্রী 

উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব ঠেকাতে স্পিকারকে ইসির চিঠি

১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কমলো ৪৯ টাকা 

আইএমএফের জ্বালানি বিষয়ক পরামর্শের সঙ্গে একমত নয় ক্যাব

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :