বাজারে ডলার ছাড়ে রিজার্ভে টান

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৩, ১৪:০০ | প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫৩

বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ার পাশপাশি আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে ডলারের অস্থিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতেও নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রিজার্ভ থেকে ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে কোনো অর্থবছরের (১২ মাস) পুরো সময়েও রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। অস্থির ডলার বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না।

গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগেরদিন সোমবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের ১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধের পর রিজার্ভ এ পর্যায়ে নেমেছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১.২ বিলিয়ন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ছিল ১.৩২ বিলিয়ন, মে-জুন সময়ে ছিল ১.৯৬ বিলিয়ন এবং জুলাই-আগস্টে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিলো।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ আরও ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন কম। সংস্থাটির হিসাবে, বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়াবে ২২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে।

আকু হলো আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানের মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর সুদসহ আমদানির অর্থ পরিশোধ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল তারা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে উল্টো প্রায় ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় সারা বিশে^ই অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানির চেয়ে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডলার সংকট তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানির এলসিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় খরচ অনেকটা কমেছে। সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহ ফের হোঁচট খেয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ব্যাংকারদের মতে, বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফেরাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগের মধ্যেও সংকট কটেনি। নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপ রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্ববাজারে ডলার অনেক শক্তিশালী হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ডলার বিক্রি ১০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। রিজার্ভ কমে নেমেছে ৩২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়িয়েছিল বাংলাদেশ।

এ রকম অবস্থায় রিজার্ভ যেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় না নামে সে জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত রপ্তানি বিল ফেরত আনতে বলা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

পণ্য রপ্তানির এ হালনাগাদ পরিসংখ্যান গত বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশ করেছে। তথ্যানুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২০৯ কোটি টাকার সমান। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য আমদানি হয়েছে ৫ হাজার ৩৮৩ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ৭৩২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৩৪৯ কোটি ডলারের আমদানি ব্যয় কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। যেখানে জানুয়ারিতে এসেছিল প্রায় ১৯৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। সে হিসাবে মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমেছে ৩৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার বেশি এসেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও আমরা এখনও নিরাপদ অবস্থানে যেতে পারিনি। সার্বিক ডলার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের অন্যতম দুটি পথের মধ্যে একটি রেমিট্যান্স এবং অপরটি রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয় বাড়াতে ডলারের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীরা দেশে ডলার আনতে আগ্রহী হবেন। প্রবাসীরাও ডলারের মূল্য বেশি পাবেন।

ডলারের রেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করা যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদের হারকে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২২ জুন প্রথমবারের মতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ছিল। করোনার প্রভাব শুরু হলে বিশ্ববাজারে সুদহার অনেক কমে যায়। তখন বিশ্বের অনেক দেশ বিদেশি ঋণ কমালেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ২০২১ সালে রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পথ বেছে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ জিনিসের দর বেড়েছে। এরপর রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে।

(ঢাকাটাইমস/০৯মার্চ/আরকেএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :