রক্তে ভেজা শ্রম দিবস

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ কিংবা ‘সকল দেশের সর্বহারারা, এক হও’ এমন সব স্লোগান শুনলেই আমাদের মাঠে-ঘাটে, কারখানায় ঘামে ভেজা শ্রমিকদের প্রতি অত্যাচার, নিপিড়নের কথা মনে পরে। যে আধুনিক ও সমৃদ্ধ পৃথিবী আমরা আজ দেখতে পেরেছি, তার পিছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ কালো অধ্যায়। আছে গুটিকয়েক অমানুষদের সাধারন শ্রমিকদের ওপর নির্মমতা এবং বর্বরতার লোমহর্ষক কাহিনী। আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস,যা মে মাসের এক তারিখে বিশ্বব্যাপি পালিত হয়। এই দিনটির সাথে জড়িত সাধারণ শ্রমিকদের এক করুন এবং গৌরবময় ইতিহাস। শুরুর দিকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো দিবসটি পালন করলেও এখন পুরো বিশ্বের সকল শ্রমিক দিনটি খুব গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে। শুধু শ্রমিক শ্রেণী নয় আজ মে দিবস সর্বশ্রেণী, পেশার মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১লা মে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই দিনটি পালিত হয় না। এই দিনটি ‘মে দিবস’ ও ‘লেবার ডে’ হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত।
মে দিবসের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমাদের ফিরে যেতে হবে শিল্পবিপ্লবের সময়ে যখন থেকে কলকারখানা গড়ে উঠেছিল অর্থাৎ অধুনা বিশ্বের সূচনা হয়েছিল। মূলত তখন কারখানার শ্রমিকগণ নানাধরণের বৈষম্যের স্বীকার হত। এরপর ধীরে ধীরে শ্রমিকরা তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে শুরু করে। যাহোক শ্রমিকদের এই মহান আন্দোললের সূচনাটা হয়েছিল শিকাগো শহরে। তৎকালীন আমেরিকার শিকাগো শহর ছিলো শিল্পায়িত শহর, বহুসংখ্যক কল- কারখানা তখন এই শহরে গড়ে ওঠে।সময়টি ছিলো শিল্পবিপ্লবের সময়, বিভিন্ন দেশ থেকে কাজের জন্য মানুষ এখানে আসতে থাকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা শ্রমিকদের দিয়ে ১০ থেকে ১২ ঘন্টার বেশি সময় কাজ করাতো আবার কখনও কখনও ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হত। তাদের খুব অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হত এবং তাদের জন্য খুব সামান্য কিছু মজুরি নির্ধারিত ছিল। এর ফলে শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হত।শ্রমিকদের রক্ত পানি করা শ্রম, তাদের হাত ধরে যে সভ্যতা গড়ে উঠছিল, তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে শিল্পবিপ্লবের সুচনা হয় এবং শিল্পবিপ্লবের সুফল সারাবিশ্ব ভোগ করছিল সেই সব শ্রমিকরাই তখন চরম অবহেলা আর অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে যখন নির্যাতন ও নিপীড়ন বাড়তে থাকে,সহ্য করতে না পেরে পরবর্তীতে নির্যাতিত ও নিপীড়িত শ্রমিকগন তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
শ্রমিকরা মালিকদের বিপক্ষে গর্জে ওঠে, বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তারা মিছিল, মিটিং এবং শোভাযাত্রা করে। তাদেরর দাবি ছিলো ‘৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম এবং বাকি ৮ ঘন্টা নিজের কাজে সময় ব্যয় করবে।’ তাদের উদ্দেশ্য ছিলো মানবযন্ত্র থেকে পরিত্রান পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা।সঠিক মজুরি নিশ্চিতের মাধ্যমে জীবনের মানোন্নয়ন করা এবং মালিকগন শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে, কর্মক্ষেত্রে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি করবে।কিন্তু সাধারন শ্রমিকরা কোনভাবেই মালিকদের মন গলাতে পারেনি।
ধীরে ধীরে শ্রমিকদের আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে পরছিলো।আমেরিকার শিকাগো, উইসকনসিন ও নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে শ্রমিকদের আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। এরপর আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয় এবং দাবি মানতে ১৮৮৬ সালের ১ লা মে পর্যন্ত সময় বেধে দেয়।কিন্তু মালিকগন দাবি মেনে নেয় নি। ফলশ্রুতিতে ১৮৮৬ সালের ৪ ঠা মে সন্ধ্যায় শিকাগো শহরে সকল শ্রমিক মিছিলের জন্য একত্রিত হয়।তখন আগস্ট স্পীড নামের একজন নেতা একত্রিত সকলকে উদেশ্য করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন,ঠিক সেই মূহুর্তে অজ্ঞাতনামা একজন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কাছে বোমা বিস্ফোরণ করে। এতে একজন পুলিশ সেখানে নিহত হয়।এরপর পলিশ নিরপরাধ শ্রমিকদের উপর হামলা চালায়। ১১ জন শ্রমিক শহিদ হন এবং শত শত শ্রমিক আহত হয়।বর্বরতা এখানেই থেমে যায়নি বরং আগস্ট স্পীডসহ ৮ জনকে বাদী করে মামলা করা হয়। ১৮৮৭ সালে ১১ ই নভেম্বর ৮ জনের মধ্যে ৬ জনের জনসম্মুখে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।১ জন একদিন পূর্বেই কারাগারের ভেতরে আত্মহত্যা করেন আর বাকি একজনকে ১৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এই নৃশংস ঘটনা ইতিহাসের পাতায় " হে মার্কেট ম্যাসাকার’"নামে পরিচিত। ১৮৯৩ সালে ২৬ জুন, ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং নৃশংস হামলায় হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর সেই অজ্ঞাত বোমা বিস্ফোরনকারীর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই দিনটি খুবই গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।বাংলাদেশে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গন্য করা হয় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সকল পেশার মানুষ সেদিন কর্মবিরতী দিয়ে থাকে।শুধু তাই নয় ব্যবসায়ীরাও সেদিনটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছুটি পালন করে থাকে।।এখন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে বাধ্য করা হয়।
সেইসকল শ্রমিকদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা,যারা জীবনের বিনিময়ে সকল পেশাজীবি মানুষদের সুনিশ্চিত কর্মক্ষেত্র উপহার দিয়ে গেছেন।।যাদের হাত ধরে সভ্যতা আজ এতো দূর এগিয়ে গেছে।যারা আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে অত্যাচারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, নিজেদের প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান পেতে হয়।তাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সংবাদটি শেয়ার করুন
মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
মতামত এর সর্বশেষ

স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জননেত্রী শেখ হাসিনা

জনম ও জনকল্যাণে উৎসর্গীকৃত এক জীবন শেখ হাসিনার

শুভ জন্মদিন দেশরত্ন শেখ হাসিনা

উন্নয়নের বঙ্গরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা: স্রষ্টার পরিকল্পিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব

বেলজিয়ামের সাংবাদিকের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জিয়ার ভূমিকা

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১১ সুপারিশ

এস. এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: এক অকুতোভয় শিল্পী ও শব্দসৈনিকের কিছু প্রাসঙ্গিক সৃষ্টির সাতকাহন

ফুটবল প্রশ্নে কেন ইমরুল হাসান আলাদা?
