বাংলা নাটকের বিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর নাটক

ফরিদ আহমদ দুলাল
 | প্রকাশিত : ০৫ মে ২০২৩, ০৯:৫৯
শিল্প-সাহিত্যের আঙিনায় স্বাধীনতা-উত্তরকালে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে নাটকে। ‘নাটক’ সাহিত্য হিসেবে অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় অনেকটা আধুনিক এবং যেহেতু আধুনিক, সংগত কারণেই যথার্থই তা জটিলও বটে। একটি পূর্ণাঙ্গ নাটকে জটিলতা সৃষ্টি (Suspence) এবং জটিলতা মুক্তি (Climex) অধ্যায় দুটি অপরিহার্য। নাটকের জটিলতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, নাটক শুধু লিখন-পঠনেই শেষ হয়ে যায় না- একটি নাটকের চরম উৎকর্ষ তখনই যাচাই করা যাবে, যখন নাটকটির মঞ্চায়ন সমাপ্ত হবে। আর নাটক মঞ্চায়ন শিল্প-জটিলতার আরও এক অন্যতম ধাপ; কেননা একটি নাটক মঞ্চায়নের জন্য প্রয়োজন হয় একদল মানুষের, যাদের চিন্তা-চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ের পরই একটি নাটক মঞ্চে আসতে পারে। ব্যক্তিচিন্তার এই যুগে যৌথশিল্পের অন্যতম এই ‘নাটক’ বিষয়টি যে কতটা জটিল তা বোধকরি আর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। দীপ্ত একটি নাটক মঞ্চায়ন অযোগ্যতায় ব্যর্থ, আর সার্থক মঞ্চায়নগুণে একটি অপক্ব নাটক সমাদৃত হয়ে উঠতে পারে। নাটক পাঠে পাঠকের ততটা আগ্রহ নেই, যতটা আগ্রহ দর্শকের।
সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল এই মাধ্যমটির জনপ্রিয়তা কিন্তু অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে মোটেই কম নয়। উপন্যাসের পর সম্ভবত নাটকই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আবেদনপ্রধান শিল্পমাধ্যম। কোনো কোনো বিবেচনায় নাটক উপন্যাসের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে যায়। নাটক তাই যুগে যুগে জীবনশিল্প নামে বিবর্তিত। রবীন্দ্রনাথ গীতিকবিতা এবং নাটককে সমান মূল্য দিয়েছেন এবং আলোচনা করে গীতিকবিতাকে ‘শিল্পীর আত্মপ্রকাশ’ আর নাটককে ‘শিল্পীর বংশপ্রকাশ’ নামে অভিহিত করেছিলেন। নাটক কতটা সুদূরপ্রসারী তা কবিগুরুর উক্তিতেই বিধৃত। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত এক ইংরেজ লেখিকা Elzabeth Drew বলেন, ‘Drama is the creation and repreasentation of life in terms of the Theaters.’ ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা অধ্যাপক Ifor Evance বলেন, ‘The Drama is a multiple art using scenic effects, music, the gestures of the actors and the organizing talents of a producer.’ বলা যেতে পারে দলগত আন্তরিক উপস্থাপনাই একটি নাটকের সফলতার চাবিকাঠি।
সাহিত্যের প্রধান বাহন গদ্যরীতি। গদ্যরীতি উৎকর্ষের পর্যায়ে উন্নীত হবার পর নাটক রচনার সূত্রপাত হয়। এ দেশের লোকজীবনে বহুপূর্ব থেকে প্রচলিত যাত্রা, কবিগান, পাঁচালি, কথকতা, টপ্পা, কীর্তন ইত্যাদির যে কোনোটি থেকেই নাটকের উৎপত্তি-বিকাশের সূত্র হতে পারতো, তেমনটি হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল, কিন্তু তা হয়নি; বরং আধুনিক বাংলা নাটক এবং নাট্যসাহিত্য উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিকশিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে নাটকের প্রচুর সম্ভাবনা থাকার পরও এ দেশের মঞ্চে ১৭৯৫ সালে রুশ দেশীয় আগন্তুক হেরাসিম লেবেডফ প্রথম বাংলা নাটক অভিনয় করান এ দেশীয় পাত্র-পাত্রীদের দ্বারা। লেবেডফ কলকাতায় ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে একটি রঙ্গালয় স্থাপন করেন এবং ‘The Disguise’ নামে একটি বিদেশি নাটক বাংলায় রূপান্তর করে অভিনয়ের আয়োজন করেন। বাংলা রূপান্তরিত নাটকের নাম ছিল ‘কাল্পনিক সংবদল’ (ছদ্মবেশী)। অবশ্য ইরেজি নাটক অভিনয়ের জন্য কলকাতায় অনেক আগেই রঙ্গালয় স্থাপন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে নাট্যচর্চা ও নাট্যসাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে একটি কথা পরিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন, আমার আলোচনার বিষয় বাংলা নাট্য সাহিত্যের বিবর্তন, কিছুতেই নাট্যচর্চার বিবর্তন নয় এবং এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনার জন্য আমাদের জেলা-থানা বা গ্রাম পর্যায়ে যে নাট্যচর্চা হয়, তার ওপর আদ্যোপান্ত একটি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; আমার তা করা হয়নি। সংগতকারণে আমার রচনা আলোকিত-আলোচিত নাট্য রচনার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের নাটক বলতে স্বাধীনতা-উত্তরকালের নাটক হলেও স্বাধীনতা-পূর্বকালের নাট্যচর্চা ও নাট্য সাহিত্য সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা আবশ্যক; কেননা সে সময়ের নাট্যকারদের পরম্পরা নিয়েই বাংলাদেশে নাট্যচর্চার পথচলা। ভাষা আন্দোলনের সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুনীর চৌধুরীর নাম সে সময়ের প্রেক্ষাপটে অগ্রগণ্য। বেশকিছু অনুবাদ ও রূপান্তর নাটক রচনার পাশাপাশি মুনীর চৌধুরী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৌলিক নাটকও রচনা করেন। তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে কবর, নষ্ট ছেলে, মানুষ, দণ্ডধর, দণ্ড, দণ্ডকারণ্য, পলাশী ব্যারেক, মর্মান্তিক, ফিট কলাম, আপনি কে?, একতলা-দোতলা, মিলিটারী, বংশধর, একাংকিকা, রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি, একটি মশা, নেতা, গুন্ডা, বে-শরিয়তি, গতকাল ঈদ ছিলো, নওজোয়ান কবিতা মজলিশ ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। মুনীর চৌধুরীর অধিকাংশ নাটকই একাংকিকা; তাঁর পাশাপাশি আরও যাঁদের নাম ও নাট্যসৃষ্টির কথা উল্লেখ করা যায় তাঁরা হলেন-
ক) সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ: তরঙ্গভঙ্গ, বহিপীর, সুড়ঙ্গ।
খ) নূরুল মোমেম: নয়া খান্দান, কাল-মাত্রা-ইতিহাস, রূপান্তর, নেমেসিস, যদি এমন হতো, শতকরা আশি।
গ) আবুল ফজল: কায়েদে আজম, প্রগতি, আলোকলতা, স্বয়ম্বরা।
ঘ) সাঈদ আহমদ: কালবেলা, তৃষ্ণায়।
ঙ) আসকার ইবনে শাইখ: বিদ্রোহী পদ্মা, রক্তপদ্ম, অগ্নিগিরি, লালন ফকির, প্রচ্ছদপট, বিরোধ, পদক্ষেপ, দুরন্ত ঢেউ, অনুবর্তন, প্রতীক্ষা, এপার-ওপার, তিতুমীর।
চ) ফয়েজ আহমদ: মুক্তাহার, শেষ ফল।
ছ) কল্যাণ মিত্র: কুয়াশাকান্না, দায়ী কে?, সাগর সেচা মানিক, সূর্য মহল, টাকা আনা পাই, শুভ বিবাহ, অনন্যা, অতএব, পাথরবাড়ি, রাস্তার ছেলে, চোরা গলি মন (বাইজী), প্রদীপশিখা, নিহত শতাব্দী, ত্রিরত্ন, লালন ফকির (স্বাধীনতার পর রচিত), সোনা রূপা খাদ।
জ) ইন্দু সাহা: বেকার নিকেতন, টার্মিনাল, একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ, শেষ আবিষ্কার, টুনী সোনাপুর যাচ্ছে (স্বাধীনতা-উত্তর), এজনমুন্সীর পোস্টার (স্বাধীনতা-উত্তর), বাস্তুত্যাগ।
ঝ) প্রসাদ বিশ্বাস: পাকা রাস্তা, অবিচার, জবাবদিহি, ভোরের স্বপ্ন, অদ্ভুত পৃথিবী, ফেরিওয়ালা, পরাজয়, নাজেহাল, বিচার।
ঞ) আলাউদ্দিন আল আজাদ: ইহুদির মেয়ে, মরোক্কোর যাদুকর, মায়াবী প্রহর।
ট) বন্দে আলী মিয়া: বৌদিদি রেস্টুরেন্ট, জোয়ার ভাটা, উদয় প্রভাত, যুগ-মানব, মসনদ, টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার, আলাদীন।
ঠ) আলাউদ্দিন: কাঁচ মহল, বোবাকান্না, একটি তিলের জন্য, চরিত্রের সন্ধানে নাট্যকার, পৃথিবী ঘোরে, রক্ত গোলাপ, নকল মানুষ, হারজিৎ, মন্টুর পাঠশালা, চাঁদের ছেলে, পুতুলের ঘর, কাগজের ফুল, আপট্রেন, সেনাপতি।
ড) নীলিমা ইব্রাহিম: দুয়ে দুয়ে চার।
ঢ) ফররুখ শিয়র: সামনের পৃথিবী।
ণ) খান জয়নুল: ঘর মন জানালা।
ত) মো: জালালউদ্দীন: দুই ভাই, গাঁয়ের বুকে।
থ) আ. ন. ম. বজলুর রশীদ: উত্তর ফাল্গুনী, ত্রিমাত্রিক, মনকমল, সংযুক্তা, সুর ও ছন্দ।
দ) ইব্রাহিম খলিল: সখীনা, মুসা, ফিরিঙ্গিরাজ, কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা।
ধ) এম. এস. হুদা: তালেব মাস্টারের হালখাতা, এই যদি হয়, বই চোর, দরবারে আম, কার দোষে?, কালোছায়া।
ন) শওকত ওসমান: তস্কর লস্কর, আমলার মামলা, বাগদাদের কবি, কাঁকরমনি।
প) আকবর উদ্দিন: সিন্ধু বিজয়, নাদির শাহ, মুজাহিদ।
ফ) আমজাদ হোসেন: ফিফটি ফিফটি।
ব) আনিস চৌধুরী: এ্যালবাম, মানচিত্র।
ভ) এস. এম. হাবিবুর রহমান: গাঁয়ের বধূ।
ম) মাজহারুল ইসলাম: অগ্নিস্নান, দিল্লীর মসনদ, অগ্নিবিষাণ, কবি সমাচার, শেষ দান, বিচারকের ফাঁসি।
য) সিকান্দর আবুজাফর: সিরাজ-উদ-দৌলা, মহাকবি আলাওল।
র) আজিম উদ্দীন আহমদ: মহুয়া, মা, অহংকার, কাঞ্চন।
ল) আলী মনসুর: পোড়াবাড়ি, বোবা মানুষ।
ব) ওবায়দুল হক: দিগি¦জয়ী, চোরা কারবারী, এই পার্কে, রুগ্ন পৃথিবী।
শ) জসীম উদদীন: পদ্মাপার, বেদের মেয়ে।
ষ) অন্নদামোহন বাগচী : মুক্তি, ঝড়, শেষ প্রহর, সূর্যমুখী, মসনদ, কাদামাটির দুর্গ, মেঘের পরে মেঘ, বন্ধন, কে?, দুই পক্ষ, দেশের মাটি।
স) ইবনে শায়ের: পথে বিপথে, কেন?, বেলা যায় বেলা আসে, টিপু সুলতানের যোগ বিয়োগ।
নাটকের বিশ্লেষণে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘জাতীয় জীবনে মাহেন্দ্রলগ্ন উপস্থিত না হইলে নাটক রচনা সহজ হয় না।’ উক্তিটি ভেবে দেখবার মতো। প্রাচীন গ্রিসের মাহেন্দ্রলগ্নেই গ্রিক নাটকগুলো রচিত। ইংল্যান্ডের মাহেন্দ্রলগ্নেই Elizabethian যুগের নাটকগুলো রচিত। অবশ্য একথা ঠিক মাহেন্দ্রলগ্নে কেবল নাটক নয়, অন্যান্য মাধ্যমেও প্রচুর কাজ হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন; কিন্তু মহৎ নাটক সে সময় খুব একটা রচিত হয়নি। ভাষা আন্দোলনের সামান্য কিছু ফসল আমরা পেয়েছি, কারাগারের অভ্যন্তরে রচিত ও অভিনীত হয়েছে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’; ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সৈনিক ও প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের কর্মী সোমেন চন্দের ‘সংকেত’ গল্পের নাট্যরূপ গণনাট্যরূপে পরিবেশিত হয় ঢাকার এক উত্তাল জনসমুদ্রে, ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ড্রামা সার্কেল; ড্রামা সার্কেল প্রতিষ্ঠাও নাটকের জন্যে তখন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানিদের হাতে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে অবরুদ্ধ। সংগত কারণেই এখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আসেনি কোনো প্রবহমানতা, বাতাসে কখনো সামান্য নড়ে উঠেছে মাত্র। পেশাদারি নাট্যচর্চা বা নবনাট্যচর্চা কোনোটাই এখানে বিকশিত হতে পারেনি। যেটুকু হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তা নিতান্তই বিলাসিতা বা বিনোদনচর্চা মাত্র। যাঁরা সে সময় নাট্যকর্মের জন্য শ্রম ব্যয় করেছেন, প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁদের প্রতিকূল পরিবেশ আর বৈরী পরিস্থিতির সাথে। সুতরাং সে দুঃসময়ে যাঁরা যেভাবেই হোক নাটকের জন্য নিজেদের শ্রম-মনন-মনীষা দিয়েছেন, তাঁদের অবদানকে খাটো করে দেখার সামান্য অবকাশ নেই।
বাঙালির জীবনে শ্রেষ্ঠতম অর্জন আমাদের স্বাধীনতা, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লব কতটা সাধিত হয়েছিল তা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও যুদ্ধোত্তর সময়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লব ঘটে যায়, এ কথা কেউ অস্বীকার করেন না।
শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, নাট্যাঙ্গনের অগ্রগতিটাই ছিল সবার চেয়ে বেশি দৃশ্যমান।
স্বাধীনতা-পূর্বকালের নাট্যচর্চা আর পরবর্তীকালের নাট্যচর্চার ফারাক চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নবনাট্যান্দোলনের যে সুবাতাস বয়ে যায়, সেই বাতাস যে কেবল রাজধানী ঢাকার নাট্যাঙ্গনে লেগেছিল তা কিন্তু নয়, বরং নাটকের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল সারাদেশে। দেশের বিভিন্ন অংশে গ্রুপ-থিয়েটারের চেতনায় নাটক মঞ্চায়ন শুরু হয়। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষ দিকে যখন নাট্যকর্মীদের দাবির মুখে বঙ্গবন্ধু ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাতিল করে ‘সেন্সরশিপ’ প্রথা বিলোপ করেন, তখন সারাদেশে নাট্যচর্চা প্রবল হয়ে ওঠে। তারও আগে বঙ্গবন্ধু যখন নাটকের ওপর প্রমোদ কর রহিত করেন, তখনও একবার বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে আনন্দ বন্যা বয়ে গিয়েছিল। সারাদেশের মঞ্চে কেবল নতুন নাটকের মঞ্চায়ন নয়, বরং প্রচুর নাটক রচিতও হয়। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের স্থূলতা, অর্থহীনতার থাবা থেকে উদ্ধার করে নাটককে নির্মল সৃজনশীলতার সঠিক প্রবাহে প্রতিস্থাপন করার সচেতন ও সুসংগঠিত উদ্যোগকে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সুযোগে আমাদের নাট্যসাহিত্য নতুন এক গতি খুঁজে পায়। তাই যথার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে একাত্তরের পর থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাটকের যে জোয়ার আসে, সে জোয়ার থেকে সারাদেশের সব নাটকের সমস্ত তথ্য আমরা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে পারিনি। তারপরও বাংলা নাটকের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক মঞ্চস্থ হয় ময়মনসিংহে। ১৯৭১-এর ১০ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় ময়মনসিংহ; ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের টাউন হল ময়দানে মঞ্চস্থ হয় শেখ আকরাম আলী রচিত ‘সংগ্রাম চলবেই’ নাটকটি। এম এন আলম তোতা নির্দেশিত সে নাটকে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল। ১৯ ডিসেম্বর নতুন বাজারের পাশে মাঠে মঞ্চস্থ হয় ফরিদ আহমদ দুলাল রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘অত্যাচারের চরম সীমায়’। সদ্য বিজয়ের উন্মাদনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিশ্চয়ই আরও নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। সব তথ্য আজ আর আমাদের জানা নেই; কিন্তু নবনাট্যচর্চায় নাটকে প্রাণচাঞ্চল্য তখন থেকেই অনুভূত হয় সে কথা জোর দিয়ে বলা যায়। এ কথা স্বীকার করতে কেউ দ্বিধা করবেন না যে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একমাত্র নাটকের ক্ষেত্রেই বৈচিত্র্য এসেছে সবচেয়ে বেশি। নাটকের আঙ্গিকে, বিষয়বস্তুতে, নির্মাণকৌশলে, মঞ্চায়নে, মঞ্চনির্মাণে এবং অভিনয়কলার ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রচিত ও অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক এবং নাট্যকারের নাম নিচে উপস্থাপিত হলো-
আব্দুল্লাহ আল মামুন: উজান পবন, সুবচন নির্বাসনে, চারিদিকে যুদ্ধ (প্রফুল্ল রায়ের কাহিনি অবলম্বনে), এখন দুঃসময়, এবার ধরা দাও, ক্রস রোডের ক্রস ফায়ার, সেনাপতি, জীবন বারে বারে, আয়নায় বন্ধুর মুখ, অরক্ষিত মতিঝিল, এপিঠ ওপিঠ, এখনো ক্রীতদাস, শাহজাদীর কালো নেকাব, তোমরাই ইত্যাদি।
মামুনুর রশীদ: গন্ধর্ব নগরী, ওরা আছে বলেই, ওরা কদম আলী, ইবলিশ, শেষ যুদ্ধের শুরু, গিনিপিগ।
নূরুল করিম নাসিম: মানুষের জন্যে, সোনার হরিণ, বিজন বাড়ি নেই।
আবদুন নূর: মৃতরাত্রির ছায়া, বিবিসাব।
সাযযাদ কাদির: সাড়ে সাতশ সিংহ, অপচয়ের যন্ত্রপাতি।
সেলিম আল দীন: জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুন্তাসীর ফ্যান্টাসী, চরকাকড়ার ডকুমেন্টারী, সংবাদ কার্টুন, শকুন্তলা, আততায়ী, কীত্তনখোলা, এক্সক্লুসিভ ও মূল সমস্যা, আতর আলীদের নীলাভ পাট, কেরামত মঙ্গল।
সিরাজ হায়দার: আলো একটু আলো, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিন, পাগলা কুকুর, আদম বেপারী, শয়তানের ব্লাডপ্রেসার, বেয়াদপী মাফ করবেন।
মুহম্মদ আবদুশ শাকুর: বক্তৃতার পরবর্তী ঘটনা, দি পেট্রিয়ট, পাগলী ইসাবেলা ও কাক।
সাঈদ তারেক: কংক্রিট, সিনথিসিস, আক্কেল আলীর স্বাধীনতা, হায়বৎ জং বাহাদুর, সিন্দাবাদের ভূত।
সৈয়দ শামসুল হক: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা।
মমতাজ উদ্দিন আহমদ: স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, হরিণ চিতা চিল, ফলাফল নিম্নচাপ, কী চাহ শঙ্খচিল, রাজা অনুস্বরের পালা, বর্ণচোরা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, চয়ন তোমার ভালোবাসা, বিবাহ।
শেখ আকরাম আলী: সংগ্রাম চলবেই, লাশ ’৭৪, বিক্ষুব্ধ অতীত এবং নজরুল, এখনো যুদ্ধ, সখের সিঁড়ি, ঘুম নেই, মাদারীর খেল।
আলাউদ্দিন আল আজাদ: জোয়ার থেকে বলছি, সংবাদ শেষাংশ, হিজল কাঠের নৌকা, ধন্যবাদ, নিঃশব্দ যাত্রা, নরকে লাল গোলাপ।
এস. এম. সোলায়মান: কাক্সিক্ষত সূর্যের প্রার্থনায়, শিকল পরিয়ে দাও, ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল, তিন রুস্তমের গল্প, ইংগিত, এলেকশান ক্যারিকেচার।
গোলাম আম্বিয়া নূরী: কুমারখালীর চর, প্রতীক্ষিত মানুষ, বাঁকতলীর পরী।
সাঈদ আহমদ: একদিন প্রতিদিন, মাইলপোস্ট।
হাসনাত আবদুল হাই: সামনে যাই থাক ট্রেন চলবে, ঘুম নেই, সিসিফাসে একদিন।
রবিউল আলম: সমাপ্তি অন্যরকম, আকাক্সিক্ষত একজন, জননীর মৃত্যু চাই, এক যে ছিল দুই হুজুর, কখনো সৈকতে।
হাবিব আহসান: তরুণ এবং বহমান ক্ষত, সাক্ষাৎকার, ক্রান্তিকালীন গল্প।
আনোয়ার তালুকদার: উৎস থেকে সমুদ্দুর, ডেডলাইন ঢাকা।
আল মনসুর: রেভুলিউশন ও খ্রিস্টাব্দ সন্ধান, হে জনতা আরেকবার, বিদায় মোনালিসা।
নাজমা জেসমিন চৌধুরী: আলোটা জ্বালো, যেমন খুশি সাজো, অন্যরকম অভিযান, এপার ওপার।
সৈয়দ মাহিদুল ইসলাম: সত্য অবাস্তব, আয়নার সামনে চড়ুইপাখি, ঈশ্বর এবং আমি, মহারানী আসছেন, এখন কি করি, কৃষ্ণচূড়া এখনো লাল।
কাজী জাকির হাসান: প্রেক্ষিত শাহজাহান ও একাল, দিকচিহ্নহীন, জনৈকের মহাপ্রয়াণ, শরবিদ্ধ যন্ত্রণা, রণক্ষেত্র, রাজায় রাজায়।
আবদুল মতিন খান: মাননীয় মন্ত্রীর একান্ত সচিব, শতাব্দীর পালা, ঊষার দুয়ারে, লালু, পিস্তল, সম্মেলন।
আব্দুল্লাহেল মাহমুদ: সাত পুরুষের ঋণ, নানকার পালা।
ফরিদ আহমদ দুলাল: ফুলজান সমাচার, মানিক বাউলের পালা, এবঙ লাঠিয়াল, সামনে দেখা হবে, মশা-৮৪, সুবিধাবাদী, দীর্ঘ দুঃসময়, দরিয়ায় শেষ রাত্রি, তিমির বিনাশী, মানুষ, কোঁচ, লড়াই, জরিবিবির পালা, নৃ-বোধ, খাঁচা, রজব আলীর নৈশ অভিযান, উন্মোচন রহস্য।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বেশকিছু অনূদিত নাটকও আমরা মঞ্চে অভিনীত হতে দেখেছি, উল্লেখযোগ্য কয়েকটির কথা নিচে উপস্থাপন করা হলো-
আলী যাকের অনুবাদ করেছেন বের্টল্ড ব্রেখটের সৎ মানুষের খোঁজে, কার্ল সুখ্য মায়ারের কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, মলিয়েরের বিদগ্ধ রমণীকুল, এ্যালবীর নিষিদ্ধ পল্লীতে; মমতাজ উদ্দিন আহমদ অনুবাদ করেছেন আন্তন শেখভের যামিনীর শেষ সংলাপ, এই রোদ এই বৃষ্টি, হাইন রিবডন ক্লাইস্টের ক্ষতবিক্ষত; আসাদুজ্জামান নূর অনুবাদ করেছেন বের্টল্ট ব্রেখটের দেওয়ান গাজীর কিসসা, মোহনগরী; আতাউর রহমান ও আসাদুজ্জামান নূর যৌথভাবে মোলনারের ভেঁপুতে বেহাগ; সৈয়দ শামসুল হক অনুবাদ করেন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার (গণনায়ক), ম্যাকবেথ; এস. এম. সোলায়মান অনুবাদ করেন নিকোলাই গোগলের ইন্সপেক্টর জেনারেল; মলিয়েরের ‘কঞ্জুস’ অনুবাদ করেন তারিক আনাম খান ইত্যাদি।
বাংলাদেশের নাটকে এই যে বিবর্তনের ধারা সে ধারায় যেমন আমরা দেখেছি নাটক নিয়ে নিরীক্ষা, তেমনি দেখেছি বাংলা নাটকের শেকড় সন্ধানের প্রয়াস। আমরা দেখেছি নাটকে আন্তর্জাতিকতার আবহ। নাটকে আন্তর্জাতিকতার আবহ সন্ধানে আলী যাকের, মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, আল মনসুর, এস. এম. সোলায়মান, সৈয়দ মাহিদুল ইসলাম, তারিক আনাম খানসহ অনেকেই যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন; তেমনি লোকবাংলার শেকড় অনুসন্ধান করে বাংলা নাটককে শেকড়ের সাথে যুক্ত করতেও সচেষ্ট হয়েছেন কেউ কেউ। শেকড়সন্ধানী নাট্যজনদের মধ্যে গুরুত্বের সাথে উচ্চারণ করতে হয় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নাম; আরও যাঁদের নাটকে সে প্রবণতা লক্ষ করা যায় তারা হলেন-মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক, গোলাম আম্বিয়া নূরী, কাজী জাকির হাসান, আবদুল্লাহিল মাহমুদ, ফরিদ আহমদ দুলালসহ অনেকেই।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রচিত ও মঞ্চায়িত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের দিকে এবার দৃষ্টি দেয়া যাক। আগেই বলেছি-স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চায়িত হয় শেখ আকরাম আলী রচিত নাটক ‘সংগ্রাম চলবেই’। ১৯৭২ থেকে শুরু হয় দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন। যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচার হতো কল্যাণ মিত্র রচিত নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটি। বিজয়ের অব্যবহিত পরই আমাদের হাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাটক আসে, সেসব নাটকের মধ্যে আমি সহজেই উল্লেখ করতে পারি কিছু নাম, যা সংখ্যাবিচারে উল্লেখযোগ্য হলেও উৎকর্ষ বিচারে অধিকাংশই অহংকার করবার মতো নয়, বরং বলা যায় ‘জোয়ারের জল’। মনে করছি, আহমেদ উল্লাহর ‘সংগ্রামী বাংলা’, এম এ মজিদের ‘জল্লাদের দরবার’, কল্যাণ মিত্রের ‘একটি জাতি একটি ইতিহাস’, ‘জল্লাদের ফাঁসি’; কালিপদ দাসের ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলার মাটি’, ‘বীর বাঙালি’, ‘সোনার বাংলা’, ‘রক্ত পতাকা’; দীলিপ সরকারের ‘বাংলার বিজয়’, ‘বাংলার বীরাঙ্গনা’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘অনেক রক্তের পর’; বাহালুল ইসলামের ‘বীর বাঙালি’; হাবিবুল্লাহর ‘রক্তের বিনিময়ে’; শহীদ আশরাফের ‘ও আমার দেশের মাটি’; শেখ নূরুল ইসলামের ‘মানুষ বাঙালি’; মোমেন খানের ‘কালরাত্রি’; মুহম্মদ আলাউদ্দিনের ‘রক্ত দিয়ে আনলাম’; এ কে এম মজিবুর রহমানের ‘মুক্ত আকাশ’ ইত্যাদি আরও অনেক। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের খোঁজ যাঁরা জানেন, তাঁরা সবাই বলবেন, এখানে নাট্যকার হিসেবে যাঁদের নাম উচ্চারিত হলো, তাঁদের প্রায় সবাই স্বাধীনতা-উত্তর নাট্যাঙ্গনের অনুল্লেখ্য চরিত্র। কল্যাণ মিত্র নাট্যকার হিসেবে স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ, আর কালিপদ দাস চলচ্চিত্রের মানুষ, অভিনেতা এবং নির্দেশক। অন্যরা কেউ কেউ ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হলেও নাট্যাঙ্গনে নন।
আগেই বলেছি স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের যে অগ্রযাত্রা, তার মূল শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশের একজন নাট্যকর্মী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে ভাবেন, এ কথা চিন্তাও করতে পারি না। শিল্পাঙ্গনের অন্য যেকোনো শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মানুষ থাকলেও নাট্যাঙ্গনে একজনও নেই। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আজ পর্যন্ত যতো নাটক রচিত হয়েছে, অভিনীত হয়েছে, অঙ্গুলিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া তার সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে; সে বিবেচনায় বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের প্রায় সবই মুক্তিযুদ্ধের নাটক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নাটক এবং নাট্যকারের নাম স্মরণ করে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক'’ রচনার ইতি টানতে চাই, তার আগে অবশ্যই অন্য এক তালিকা উপস্থাপন করতে চাই, যে তালিকায় সেইসব নাটক এবং নাট্যকারের নাম থাকবে, যেসব নাটকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। আসুন আমরা আমাদের স্মৃতি ঘেঁটে খুঁজে নিই সেইসব নাম।
মমতাজউদ্দিন আহমদের সেই কণ্ঠস্বর, বর্ণচোর, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, কী চাহ শঙ্খচিল, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বকুলপুরের স্বাধীনতা; আবদুল্লাহ আল মামুনের বিবিসাব, আয়নায় বন্ধুর মুখ, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই; রণেশ দাশগুপ্তের ফেরী আসছে; নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই; হাসনাত আবদুল হাইর ঘুম নেই; আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দযাত্রা, নরকে লাল গোলাপ; মামুনুর রশীদের জয়জয়ন্তী; এসএম সোলায়মানের খ্যাপাপাগলার প্যাঁচাল; মোহাম্মদ এহসানউল্লাহর কিংশুক যে মরুতে; এম এ বাকীর একাত্তরের ইউলিসিস; কাজী মাহবুবুর রহমানের সাত আসমানের সিঁড়ি, বধ্যভূমিতে শেষ দৃশ্য, স্বর্ণ তোরণ, চাঁদ পোকা ঘুণ পোকা; শামস উল হকের সূর্য উঠছে; শেখ আকরাম আলীর এখনো যুদ্ধ; ফরিদ আহমদ দুলালের দীর্ঘ দুঃসময়, নৃ-বোধ; সারোয়ার চৌধুরীর এখনো মীরজাফর, ফেরারী জবানবন্দী; মান্নান হীরার ফেরারী; হুমায়ূন আহমেদের ১৯৭১; হাসানুল বান্নার শেখ মুজিব; দীপক চৌধুরীর স্বাধীনতার ময়নাতদন্ত, একাত্তরের শকুন, আবার যুদ্ধ, ইনফর্মার ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের এতসব নাটকের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক নাটক রচনা করে যিনি মুক্তিযুদ্ধের নাটক রচনায় অন্যতম প্রধান নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হলেন তিনি কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ হক তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ এবং ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ রচনা করে নাট্যকার হিসেবে এমন এক উচ্চতায় উঠে গেলেন যে, বাংলা নাটকের ইতিহাসে তিনি হয়ে উঠলেন অনিবার্য নাম। সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরও যেসব নাটক রচনা করেছেন, সেগুলো হলো: বাংলার মাটি বাংলার জল, আমাদের জন্ম হলো, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, কৃষ্ণপক্ষ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক এবং নাট্যকারের নাম বলতে গিয়ে এখানে নিশ্চয়ই অসংখ্য নাটক এবং নাট্যকারের নাম অনুচ্চারিত রয়ে গেল; বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং জেলায় জেলায় যাঁরা নাটক রচনা করেছেন, কিন্তু প্রচার ও প্রকাশনার আলোবঞ্চিত হবার কারণে তাঁরা সবসময়ই অনুচ্চারিত থেকে গেছেন; যাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা যদি সততা এবং নিষ্ঠার সাথে বিভিন্ন জেলায় নাট্যচর্চার ইতিহাস সামনে এনে এ দেশে নাট্যচর্চার একটি সমন্বিত ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন, তাহলে হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সমস্ত নাটকের একটা তালিকা আমরা পেতে পারি। আমি এখানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটকের সামান্য কিছু সংলাপ উচ্চারণ করছি।
আলাল: না-না মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা! বোমা মেরেছি আমি, আমি ক্ষুদিরাম বসু, পিতা ত্রৈলোক্য নাথ বসু, নিবাস বাংলাদেশ। শিক্ষক আমার খোকন ব্যানার্জি ঠিক যেন হেমচন্দ্র দাস, ফরাসি দেশ থেকে বোমা বানাবার কৌশল শিখে এসেছে, আমাদের কানে কানে বলল, ক্ষুদি, ক্ষুদিরে পবিত্র সোনামুখীর শরীরে কলঙ্ক লেপে দিতে আসছে শত্রু-সাবধান। আমিও বঙ্গ সন্তান হয়ে দিদি, জননী আমার অপরূপা দেবীর পা ছুঁয়ে কসম করলাম, জীবন যাবে তবু বাঁচাবো স্বদেশ, বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন করব শত্রুর মস্তক!
(একাত্তরের ক্ষুদিরাম॥ মান্নান হীরা)
মইরম: ঘর! আমারে তুই ঘরে যাইবার কস? কি আছে আমার ঘরে? সোয়ামী আছে? জুয়ান পোলারা আছে? কেউ নাই। আমার দুই পোলা স্বাধীনের যুদ্ধে গেছিলো। ফিরা আসে নাই। পোলারা যুদ্ধে গেছে বইলা অগো বাপেরে ধইরা নিয়া গেল বদর বাহিনী। সেও ফিরা আসে নাই। এই দ্যাশের লাইগা আমি সোয়ামী দিছি। পোলা দিছি। আমি দুশমনেরে হারা জনম দুশমনই কমু। দোস কমু না। বিল্লালরে, আমার কইলজায় আগুন জ্বলে। যহন দেহি শান্তি কমিটির মেম্বার, বদর বাহিনীর বাপ বসিরুদ্দি মোল্লা সিনা টান কইরা বাজারের মধ্যে দিয়া হাটে, দাড়ির মধ্যে আঙুল চালায় আর চোটপাট করে, তখন আমার দিমাগ চইরা যায়। আমি বুইজ্যা পাই না এইডা কুন দ্যাশে আছি? বসিরুদ্দি মোল্লা মাপ পায় ক্যামনে ? কে অরে মাপ দেয়? তয় তুই দেইখা লইস বিল্লাল, যার যা খুশি করুকগা, আমার হিসাব আমি পাই পাই বুইজ্যা লমু।
(বিবিসাব॥ আবদুল্লাহ আল মামুন)
গ্রামবাসী: মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা
মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা
মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান
মানুষ আসতে আছে মহররমে ধুলার সমান
মানুষ আসতে আছে ছিপ ডিঙি শালতি ভেলায়
মানুষ আসতে আছে লাঠি ভর দিয়া ধুলা পায়
মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা বিধবা বইন
মানুষ আসতে আছে আচানক বড় বেচইন
আম গাছে আম নাই শিলে পড়ছে সব
ফুল গাছে ফুল নাই গোটা ঝরছে সব
সেই ফুল সেই ফল মানুষের মেলা
সন্ধ্যার আগেই য্যান ভরা সন্ধ্যাবেলা
কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই
একদিক ছাড়া আর কোনোদিক নাই
বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া
খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া
........ ............. ...............
গ্রামবাসী: বিচার, বিচার চাই, বিলম্ব কীসের?
............ ............. ............
বেলা যায়, পায়ের আওয়াজ ঐ পাওয়া যায় টের।
কও বিলম্ব কীসের?
মেয়ে: আপনেরা বিচার চান, কারণ সামনে আছে দিন, আরো দিন
আরো শস্য, আরো কত হালখাতা, তারাবাজি, আহলাদের দিন।
আপনেদের দুঃখেরও দিন আছে, আরো কত কষ্টের অদিন,
বান, খরা, সাপের ছোবল, কত ব্যারাম অচিন,
সুখের দুঃখের দিন।
আমার কি আছে ? গ্যাছে সুখ
য্যান কেউ নিয়া গ্যাছ গাভীনের বাঁটে যতটুক
দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। সুখ নাই এখন সংসারে
দুঃখেরও শক্তি নাই দুঃখ দেয় আবার আমারে-
যেমন বিষের লতা, তারও জন্ম নাই কোনো নুনের পাহাড়ে।
মেয়ে: যখন আসল সত্য ওঠে লাফ দিয়া
তখন দুনিয়া
আচানক মনে হয় সোনার শিকল কাটা পাখির লাহান
দেখে যায় জমিন ও আসমান।
দেখেন, দেখেন, তবে, একবার ডানা ঝাপটায়া
এখনি উড়াল দিবে সমস্ত ফালায়া।
(মেয়ে হঠাৎ বিষপান করে এবং মাটিতে পড়ে যায়। গ্রামবাসী রমণীরা তাকে কোলে নেয়)
গ্রামবাসী: আহা! ইস, ইস
ধুতুরার বিষ।
মাতবর: মা, মা, মা আমার শোন, কথা শোন,
এভাবে নিজের হাতে দিলি তাই নিজের জীবন?
যাইস না, যাইস না, অরে মানিক আমার
যমুনার পার হয়া তবে আমি বাঁচাবো আবার
যমুনার হাত থিকা, একদণ্ড দাঁড়া।
(গ্রামবাসী রমণীরা বিলাপ করতে থাকে)
(পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়॥ সৈয়দ শামসুল হক)
হাফিজ: ঝড় কইরে রেশমী! কান্দে, আসমান কান্দে! গাছপালা কান্দে আমার সিরাজের লাইগ্যা! কিন্তু আমি কান্দি না। রেশমীরে সিরাজ মইরা গিয়া আমারে কি কইয়া গেল জানস? কইয়া গেল- বাজান তুমি না একজন মুক্তিযোদ্ধা? তুমি না স্বাধীন করছো দেশ! তাইলে কেন তুমি স্বাধীন হইতে পারো না! আইজও মহাজন আমার সামনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়া মসকরা করে! রেশমীরে আমার মাতাডা এতদিন বান্দা আছিলো মহাজনের কাছে; কিন্তু আর না! আমার পুলা আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিয়া গেছে! মহাজন আইজ সমাজের নেতা অইতে চায় আবার! আবার মহাজন সবার উপরে লাডি ঘুরায়! আমার পুলা আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিছে! পুলা আমারে কানে কানে কইয়া গেছে- আমি স্বাধীন! আমি স্বাধীন!
(কোঁচ॥ ফরিদ আহমদ দুলাল)
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যদি বলি, তাহলে কি আমরা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নাটককে বাদ দিতে পারি? মমতাজ উদদীন আহমদ রচিত ফলাফল নিম্নচাপ, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, সাত ঘাটের কানাকড়ি; আবদুল্লাহ আল মামুনের সুবচন নির্বাসনে, এখন দুঃসময়, সেনাপতি; সেলিম আলদীন রচিত কীত্তনখোলা, সংবাদ কার্টুন, মুনতাসীর ফ্যান্টাসী ইত্যাদি নাটককে বাদ দিতে পারি? এমনি সহস্র নাটকের নাম মাথায় ভিড় করছে; অনেক নাম স্মৃতি থেকে হারিয়েও গেছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সেইসব নাটকের নাম খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
দুঃখের সাথে বলতে হয়, সংস্কৃতির সংগ্রামে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম ফসল নাটক আজ কিছুটা বিপন্ন, আমরা যদি দেশের জেলায় জেলায় নাট্যচর্চার বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ নিতে চাই, সেখানে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবো, গোপন কান্নার শব্দ শুনতে পাবো। সমাজের অন্যান্য মানুষের মতো নাট্যকর্মীদের চরিত্রে যখন স্খলনের দুর্গন্ধ টের পাই, তখন হতাশায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় বুক; বিষাদের দীর্ঘশ্বাস শুনি অন্তরাত্মায়! মনে মনে প্রার্থনা উচ্চারণ করে বলি- ‘তোমরা তো সমাজের প্রাগ্রসরজন/ কেন হয় তোমাদের আস্তাকুঁড়ে জঘন্য পতন!/ তোমাদের ব্রত ছিলো সততার নদী/ নদীতে জোয়ার আসে যদি পলি দেবে মাঠে/ কেন তবে তোমাদের লালসা নরক ঘাঁটে!/ মাথায় বসেছো তুমি নাট্য অধিকারী/ মোহের আগুন কেন নিচ্ছে তোমার সততা কাড়ি?/ তবে কি তুমিও হলে আজ নব্য-মহাজন? তোমার পতনে কাঁদে অগণন নাট্যজন!’ নাট্যকর্মীদের সেই গোপন কান্না থেকে মুক্তি দিতে; কেবল নাট্যকর্মীদের মুক্তি দিতে নয় বরং মানুষের অগ্রযাত্রার স্বার্থে জাগাতে হবে সংস্কৃতিকর্মীদের-সাধারণ মানুষকেও; যেমন মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে নূরলদীন ডাক দিয়ে যায়-
নূরলদীন: আব্বাস, ছুটিয়া আয়, তুই মোর ভাই।
একবার-একবার-জানুতে হামার
এই ঠাঁই-
হাত দিয়া দ্যাখ, অগ্নি মোর ধরিয়া না রাখা যায়,
অন্তর ছাড়িয়া মোর অংগেতে জড়ায়।
সর্বাঙ্গে নামিয়া সূর্য অগ্নি ঢালি যায়,
ঝটাত শকুন পড়ি মাংস খুলি খায়,
কোনকালে, কত না অতীত কালে, সেই একদিন,
একদিন, একদিন,
দেখিল নূরলদীন-
পড়ি আছে, বাপ তার নোয়ায়,
মুখ দিয়া রক্ত উঠি বলদ পড়িয়া আছে মানুষ নোয়ায়।
উঠিল চিৎকার করি, একবার নূরল তখন,
তখন নূরলদীন, শুনিল তখন,
তখন সে শুনিবার পায়
নিজেরও গলার স্বর বদলিয়া গেছে তার গরুর হাম্বায়।
.......... ......... .........
হামার জানুতে দ্যাখ বলবান পেশী আসি যায়,
হামার শরীলে দ্যাখ শক্তির তরঙ্গ লাফায়,
যায়, এই ছুটি যায়,
ডাক ভাংগি যায়,
পশু নয়, মানুষের কণ্ঠের ভাষায়-
‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়।’
(নূরলদীনের সারাজীবন॥ সৈয়দ শামসুল হক)
স্বাধীন বাংলাদেশে নাটক নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজও চলমান আছে; আজও আমরা দেখছি আমাদের নাটকে নতুন নতুন অনেক নাটক সংযোজিত হচ্ছে; যা, আমাদের নাটককে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে তেমনটিই আশা করা যায়; অবশ্য এর জন্য চাই নাট্যচর্চায় সরকার ও সচেতন জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা।
আগামীতে যাঁরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস রচনা করবেন, নিশ্চয়ই তাঁরা বাংলা নাট্যপ্রপঞ্চে আরও নতুন নতুন তথ্য যোগ করে বাংলা নাটকের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস উপস্থাপন করতে পারবেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :