নয়নাভিরাম কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সৌন্দর্য

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ মে ২০২৩, ১১:২০ | প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২৩, ১১:০৩

কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের অতি পরিচিত ফুল। বাঙালির কবিতা, সাহিত্য, গান ও বিভিন্ন উপমায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের কথা নানা ভঙ্গিমায় এসেছে। ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়ার তাৎপর্য।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে কৃষ্ণচূড়ার মনকাড়া গাছ। সবুজ সবুজ চিকন পাতা। ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। দেখলেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। মন নেচে ওঠে আনন্দে।

এই গাছ চমৎকার পাতা পল্পব এবং আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া-ফুলের জন্য প্রসিদ্ধ । কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল-কমলা-হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা একে অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন করে তোলে ।

কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি সিসালপিনিয়েসি গোত্রের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ অনেকে দেশেই এর বিস্তৃতি। কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। যদিও তা কম লোকই জানেন, কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দায়। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া লাল, হলুদ ও সাদা রঙেরও হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে লাল ও হলুদ রঙের ফুল দেখা গেলেও সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়া দেখাই যায় না। ভিনদেশি হওয়ার পরও কৃষ্ণচূড়া আমাদের দেশি ফুলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য দায়ী আর এই বিভিন্ন রং মূলত ক্লোরোফিল, কারোটেনোয়েডস ও অ্যানথোসাইনিন নামক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই হয়ে থাকে।

কৃষ্ণচূড়া ফুল বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিবেশ ও ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে কৃষ্ণচূড়া। গাছের ডালে ডালে সবুজ পাতার ফাঁকে উকি দেয়া টকটকে লাল রঙের বাহারী ফুলে ভরে যায় গাছ। ফুল গন্ধহীন, পাপড়ি পাঁচটি, নমনীয় কোমল, মাঝে লম্বা পরাগদ- অবস্থিত। ফুল ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া গাছের মনোরম দৃশ্য দেখে যে কেউ থমকে দাঁড়াবে ও মনে আনন্দের ঢেউ জাগাবে।

কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া তিনটি রঙের হয়। লাল, হলুদ ও সাদা। কম হলেও চোখে পড়ে হলদে রঙের কৃষ্ণচূড়া আর সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে কালেভদ্রে। তিন রঙের কৃষ্ণচূড়ার গাছ উঁচু। অনেকটা জায়গাজুড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। তিন রঙেরই ফুল ফোটে প্রায় একই সময়ে।

বসন্তের আগমনে গাছে নতুন পাতা গজায়। পাতা ক্ষুদ্র, যৌগিক ও চিরুনির মতো সাজানো থাকে। ফুল শেষে গাছে ফল ধরে। ফলের আকার চ্যাপ্টা লম্বা, দেখতে তলোয়ার শিমের আকৃতির, ফলের রঙ প্রথমে সবুজ ও পরিপক্ক হলে কালচে রঙ ধারন করে। ফলের অভ্যন্তরে বীজ হয়, বীজের রঙ কালো। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয়। গাছ দ্রত বর্ধনশীল, সাধারণত বীজ/চারা রোপনের ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে গাছে ফুল ফুটে। গাছের কাঠ মাঝারি শক্ত মানের, খুব বেশী শক্ত মানের নয় বলে জ্বালানির লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অন্য কাজে তেমন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়না। উঁচু ভূমি কৃষ্ণচূড়া গাছ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান। আমাদের দেশে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, সড়ক-মহাসড়কের ধারে ও অন্যান্য স্থানে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছোট-বড় এবং কোন কোন স্থানে সুউচ্চ কৃষ্ণচূড়া চোখে পড়ে।

জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে শুরু করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাতিরঝিলে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া রাজধানীর ‘গ্রীষ্ম’কে করে তুলেছে লাবণ্যময়। গাছে গাছে আগুন রাঙা কৃষ্ণচূড়ার সাজানো দীপ্তি, আপনা থেকেই দৃষ্টি টেনে নেয় নগরবাসীর। আর কৃষ্ণচূড়ার এ বর্নাঢ্য সাম্রাজ্য দেখতে অবসর পেলেই নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে সৌর্ন্দয পিপাসু মানুষ।

আমাদের দেশে পত্রঝরা এই কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদটির পাতা শীতকালে ঝরে যায় আর বসন্তকালে ফুল ফোটে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় ভিন্ন। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে। এই গাছ বাংলাদেশ সহ ভারত, ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, আফ্রিকা, হংকং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীনে জন্মে।

কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অপরূপ সৌন্দর্য ছাড়াও এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থ্রাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।

কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়, বাকল এবং ফুল সবই পরজীবী সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনি এই গুঁড়া ২ গ্রাম, যা শুকিয়ে এবং গুঁড়া করা হয়েছে, হালকা গরম পানির সাথে একত্রে নিতে পারেন।

শ্বাসকষ্টের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়: রস বের করার জন্য আপনি একটু জল দিয়ে ফুলগুলিকে ম্যাশ করতে পারেন। তারপরে, এই রসটি প্রতিদিন দুবার পান করুন শ্বাসকষ্ট এবং হাঁপানির আক্রমণ সহ শ্বাসকষ্ট কমাতে।

জ্বর নিরাময়: কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার রস মিশিয়ে ২০ মিলিলিটার দুবার পান করলে জ্বর ভালো হয়।

পেটের সমস্যা নিরাময় করে: কৃষ্ণচূড়ার ছাল ধুয়ে পাচন সমস্যা সমাধান করে, যা চিনির মিষ্টির সাথে খেলে রক্তাক্ত ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাতার নির্যাস দেওয়া হয়।

কলেরা নিরাময় করে: এই গাছের শিকড় ম্যাশ করা হয় এবং তারপর পানিতে সিদ্ধ করে একটি ক্বাথ তৈরি করে যা কলেরার চিকিত্সা করে। প্রতিদিন তিন ঘন্টার জন্য, কলেরার চিকিত্সার জন্য এই পানির ২০ সিসি পান করুন।

খিঁচুনি নিরাময় করে: খিঁচুনি নিরাময় করা হয় শিকড় গুলিয়ে এবং চিনির মিছরি দিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে।

মাড়ির সমস্যার চিকিৎসা করে: মাড়ির চিকিৎসা করে দাঁতের ক্ষয়, মুখের ঘা এবং মাড়ির রক্তপাতের চিকিৎসার জন্য কৃষ্ণচূড়া ফুল থেকে তরল বের করে এবং এটি দিয়ে গারগল করার মাধ্যমে সমস্যা।

ম্যালেরিয়া চিকিৎসা: একটি ফুলের ক্বাথ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় কার্যকর।

কিডনিতে পাথরের চিকিৎসা করে: কৃষ্ণচূড়া পাতা সিদ্ধ করে নির্যাস তৈরি করে কিডনিতে পাথরের চিকিৎসা করা যেতে পারে, যা ৫০ মিলি ডোজে দিনে দুবার খেতে হবে।

চোখের জন্য: চোখ পরিষ্কার রাখতে এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ মুক্ত রাখতে পাতার ক্বাথের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

মাসিক সমস্যার জন্য: ফুল এবং বীজ নিয়মিত ঋতুস্রাব অর্জন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং যদি আপনার মাসিকের সমস্যা থাকে তবে ক্র্যাম্প কমাতে পারে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো খুবই কার্যকরী উপায়। কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য অমর হয়ে বেঁচে থাকুক যুগের পর যুগ। আপন মায়ার চাদর আকাশে ছড়িয়ে মেলে ধরুক স্বপ্নময় নয়নাভিরাম কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সৌন্দর্য।

(ঢাকাটাইমস/৮ মে/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :