ডেঙ্গুর মূল ভয় আগস্ট-সেপ্টেম্বর ঘিরে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৩, ১১:৩৭ | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:২২

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে হাসপাতালের মেঝেতেও ঠাঁই পাওয়া দায়। বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের ডেঙ্গু শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভয় ডেঙ্গুর মূল মৌসুম আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস ঘিরে। আক্রান্তের ভয়াবহতা এমনভাবে বাড়তে থাকলে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে ডেঙ্গু।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুই সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা ধরন পাল্টেছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মোট ৬৫ জন মারা গেছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২ হাজার ১৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ৬৩৭ জন ঢাকা বিভাগের বাইরের। এ বছর মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ২৯৮ জন।

গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ জন এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বাইরের ছিলেন ২৩ হাজার ১৬২ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম একটি ওয়ার্ড হলো বাড্ডা এলাকা। সরেজমিনে পূর্ব বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলির রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। এলাকাগুলোতে বসবাসরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদিন বৃষ্টি হলে এক সপ্তাহেও রাস্তাঘাটের পানি সরে না। এমনকি গত দুই মাসে এসব এলাকায় এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি।

সরেজমিনে ডিআইটি প্রজেক্টের খেলার মাঠ, বাগানবাড়ি, কৃষি ব্যাংক রোডসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে তিন থেকে চার দিনের পানিও জমে আছে। এছাড়া বাসাবাড়ির পাশে বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানি জমে আছে। এগুলোতে কোনো নজর নেই সিটি করপোরেশনের।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম পূর্ব জরিপ পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকা উত্তরের ৪০টি এবং দক্ষিণের ৫৮টি ওয়ার্ডে পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বহুতল ভবনে, ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ সাধারণ বাসাবাড়িতে এবং ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিপে দুই সিটির ৫৫টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবেও চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড- ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮।

এছাড়া মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরের বাগ, মনিপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ার সাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, তেজতুরি বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন, বাড্ডা পড়েছে এসব ওয়ার্ডের আওতায়।

দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড- ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭। এর ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। গোরান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, রাজারবাগ, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, শাঁখারিবাজার, রায় সাহেব বাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সায়েদাবাদ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, গেন্ডারিয়া, জুরাইন ও কামরাঙ্গীরচর এসব ওয়ার্ডের আওতায় পড়েছে।

রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি আছে ১০১ জন। এর মধ্যে ৮৯ জন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং বাকি ১২টি শিশু। গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত) হাসপাতালে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ৩২ জন। এর আগের দিন ২৮ জন এবং তারও আগের দিন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল ২১ জন।

ডেঙ্গু রোগী প্রসঙ্গে মিটফোর্ড পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশীদ-উন-নবী বলেন, ঈদের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে গত তিনদিনে ভর্তির সিকুয়েন্স যদি দেখি তাহলে মনে হচ্ছে সংক্রমণ কিছুটা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় নয়শো রোগী। এর মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন।

ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়া রোগী কেমন আসছে— জানতে চাইলে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক বলেন, অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় মৃদু উপসর্গ নিয়ে। যে কারণে অনেক রোগী বুঝতে পারেন না যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি যদি দ্বিতীয়বারও আক্রান্ত হন, বুঝতেই পারবেন না। কিছু রোগী এসে বলেন যে আমি এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে তো আমরা বলতে পারছি না, শুধু তারাই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন।

ডেঙ্গুরোগী যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের ৮০ শতাংশই পরীক্ষার আগে জানতেন না যে তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এখনও যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই রোগের সাধারণ সিমটম (উপসর্গ) থাকছে না। দেখা গেল কারও পেটব্যথা শুরু হয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই কমছে না। হাসপাতালে আসার পর ডেঙ্গু পরীক্ষায় তার পজিটিভ আসে। এজন্য আমরা বলি যে শারীরিক যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দিলেই হাসপাতালে চলে আসতে এবং ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে।

করণীয় এবং সচেতনতা প্রসঙ্গে কাজী রশীদ-উন-নবী আরও বলেন, কোনোভাবেই এবারের ডেঙ্গুকে অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শুরুর দিকে যদি ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে দ্রুতই ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি ক্রিটিক্যাল অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তাহলে তার চিকিৎসা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ঈদ-পরবর্তীতে বিশেষ করে চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ খুবই বেড়ে যাবে। কারণ হিসেবে বিশ্লেষণ করলে আমরা আমাদের ল্যাবে যে কাজটি করি, এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত- এ কয়েকটি ফ্যাক্টর এনালাইসিস করে একটি মডেল তৈরি করি। সেখানে দেখা যায় কয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হবে।

আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তার প্রধান একটি অংশই হচ্ছে প্রদর্শনবাদিতা। অর্থাৎ তারা যতটা দেখায় ততটা কার্যকর কাজ করে না। দ্বিতীয়ত হলো- সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করলেও তাদের পক্ষে একা ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একসঙ্গে সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে। তারা যুক্ত না হলে সিটি কর্পোরেশন যতই চেষ্টা করুক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

করণীয় প্রসঙ্গে কবিরুল বাশার বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো হটস্পট ম্যানেজমেন্ট। যেসব এলাকাতে ডেঙ্গু ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সেসব এলাকার ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা ধরে ধরে ফগিং করে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশপাশের উড়ন্ত মশাগুলো মেরে ফেলতে হবে। কারণ উড়ন্ত মশাগুলো যতক্ষণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ তারা চারদিক থেকে ডেঙ্গু ছড়াবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ৪ জুলাই আমরা আমাদের প্রাক-মৌসুম জরিপের ফল প্রকাশ করেছি। আমরা ঢাকা উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডের মোট ৩১৪৯টি বাড়িতে সার্ভে করেছি। এর মধ্যে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পজিটিভ পেয়েছি। এটি আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ বিষয়।

তিনি বলেন, জরিপে প্লাস্টিক ড্রাম, এসির পানি, ফুলের টব ও ছাদে জমে থাকা পানিতে এডিসের সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে। আমাদের ধারণা, পুরো ঢাকাতেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশার বিস্তার। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী মানুষের অসচেতনতা।

নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এ মুহূর্তে জনগণের যেমন অংশগ্রহণ লাগবে, এডিস মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আরও অনেক বেশি সক্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আমরা শুধু চিকিৎসার জায়গাটি দেখে থাকি। আমাদের হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ যদি আরও বাড়ে, সেই প্রস্তুতিও আমাদের নেওয়া আছে।

(ঢাকাটাইমস/০৮জুলাই/আরআর/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

স্বাস্থ্য এর সর্বশেষ

দেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা, ঢাকা কতটা ঝুঁকিতে?

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস: জানুন মশাবাহিত এ রোগ প্রতিরোধের উপায়

গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি

ঔষধি গাছ থেকে তিন শতাধিক ওষুধ তৈরি হচ্ছে ইরানে

কণ্ঠের সব চিকিৎসা দেশেই রয়েছে, বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই: বিএসএমএমইউ উপাচার্য 

এপ্রিল থেকেই ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু, মার্চের মধ্যে টিকা নেওয়ার সুপারিশ গবেষকদের

স্বাস্থ্য খাতে নতুন অশনি সংকেত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ভাতা বাড়লো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের

বিএসএমএমইউ বহির্বিভাগ ৪ দিন বন্ধ, খোলা থাকবে ইনডোর ও জরুরি বিভাগ

তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :