এডিস মশার জীবাণু ধ্বংস করবেন যেভাবে

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০২৩, ০৯:২০

ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে উদ্বিগ্ন মানুষ। মশা অতি ক্ষুদ্রকায় পতঙ্গ হওয়ায় তার রূপ-প্রজাতি বিশ্লেষণ করে চিনে ওঠা বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ৩,৫০০ এর বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে এডিস মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণু সংক্রমণের বাহক হিসেবে কাজ করে। ডেঙ্গুর মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে। এমন কি ঘটতে পারে মৃত্যুও।

বাংলাদেশ ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু আসে তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে ৫,৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৫৫০ জন মারা যায়। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে নানাভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু সব সময় রক্ষা পাওয়া সহজ হয় না। কোনো কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গেলে তখন নিজের প্রতি হতে হবে আরও বেশি যত্নশীল।

এডিস ইজিপ্টাই নামের মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীরে ব্যাথা হয়, লাল গুটি দেখা দেয়, মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়াতেও ব্যাথা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে রক্তক্ষরণের ফলে এ রোগে মৃত্যুও হতে পারে। প্রথমবারের ধাক্কা সামলে উঠলেই যে মুক্তি তা কিন্তু নয়। ডেঙ্গু রোগে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে৷।

ডেঙ্গু, এডিস মশা বাহিত একটি ভাইরাস ঘটিত জ্বর রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন (ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪) এর যেকোনো একটি দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। আর এই ভাইরাস বহন করে এডিস প্রজাতির মশা।

ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা খালি চোখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব। এই জাতীয় মশার দেহে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে, যে কারণে এটিকে টাইগার মশা বলা হয়। এই জাতীয় মশা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে এবং এর অ্যান্টেনা বা শুঙ্গটি কিছুটা লোমশ দেখতে হয়। পুরুষ মশার অ্যান্টেনা স্ত্রী মশার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি লোমশ দেখতে হয়।

ডেঙ্গু মশা দিনের বেলায় সব চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। বলা হয় যে সকাল ও বিকেলে সংক্রমণের সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি। গবেষণা অনুসারে, মশা দিনের বেলায় সব চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে, সূর্যোদয়ের প্রায় ২ ঘন্টা পরে এবং সূর্যাস্তের কয়েক ঘন্টা আগে। যদিও, এডিস ইজিপ্টাই মশা সূর্যাস্তের পরেও মানুষকে কামড়াতে পারে। ডিম পাড়ার সময়কালে এডিস মশা একাধিক বার কামড়াতে পারে। ডিম পাড়ার পর ডিমগুলো বেশ কয়েক মাস ধরে পড়ে থাকে। জলের সংস্পর্শে এলেই সেগুলি থেকে বাচ্চা বের হয়।

ডেঙ্গু মশার কামড়ের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল সেই জায়গা, যেখানে মশা একজন মানুষকে কামড়ায়। ডেঙ্গু সংক্রমিত মশা শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন পায়ের গোড়ালি, কনুইয়ের চারপাশে কমড়ায়।

এডিস মশার একটা বিষয় হলো, তারা সাধারণত একাধিক ব্যক্তিকে কামড়ায়। তাই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির শরীর থেকে এডিস মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর ঐ মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়।

এডিস মশার দুটি প্রজাতি ঢাকা শহরে দেখা যায়, তার মধ্যে একটি হলো এডিস ইজিপ্টি আরেকটি হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে নগরের মশা বা গৃহপালিত মশা বলা হয়ে থাকে। এ মশা নগরীর বাড়ি এবং বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে জন্মায়।

ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গুর প্রধান বাহক। আমাদের দেশে ৯৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগ ছড়ায় ইজিপ্ট প্রজাতির এডিস মশা। ডেঙ্গুর সেকেন্ডারি বা এপিডেমিক বাহক হচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস। অ্যালবোপিকটাস মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালি যুক্ত এলাকায় গাছের কোটর, কলাগাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচুর পাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোঁড়ায় জমে থাকা পানিতে জন্মায়।

ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো জেনে রাখা জরুরি। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দিলেই যাতে সতর্ক হওয়া যায়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর, র‌্যাশ, গায়ে ও হাত-পায়ে ব্যথা ইত্যাদি হলো প্রাথমিক লক্ষণ। এই রোগে আক্রান্ত হলে শরীর অনেকটাই দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে বা ডেঙ্গু ধরা পড়লে দিনে অন্তত তিন লিটার পানি পান করতে হবে। সেইসঙ্গে খেতে হবে তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি। সেই সঙ্গে খেতে হবে মাছ ও ডিম, মুরগির মাংস, শাকসবজি।

এডিস মশা খুব অল্প পানিতে (৫ মিলি বা ১ চা চামচ পানি) ডিম পাড়ে যা পানি ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এই জন্যই লার্ভা ধ্বংসে টেমিফস ১ গ্রাম/১০ লিটার পানিতে খুব কার্যকরী, যা ব্যবহার পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। নির্মাণাধীন ভবনের প্রজননস্থল ধ্বংস করে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।

এডিস মশার জন্ম হয় পাত্রের জমে থাকা পানিতে। সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজের বাড়ি এবং বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখুন, কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমে আছে কি না। যদি থাকে তাহলে তা ফেলে দিন বা পরিষ্কার করুন। যদি পাত্রটি এমন হয় যে, পানি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না তাহলে সেখানে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার বা লবণ দিন।

গাড়ির অব্যবহৃত টায়ার বাসায় রাখবেন না কারণ এখানে এডিস মশার জন্ম হয় যদি রাখতেই হয় তাহলে ছাউনির নিচে রাখুন যেন পানি জমা না হয় । দই বা যেকোনো খাবারের পাত্র বাইরে ফেলবেন না। বাথরুমে যদি পানি ধরে রাখতে হয় তাহলে পানির পাত্র সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আবার পানি ভর্তি করুন।

এডিস মশা পানির পাত্রের কিনারে ডিম পাড়ে এবং পাত্রের গায়ে আটকে থাকে। যে কারণে পানি ফেলে দিলেও ডিম নষ্ট হয় না। তাই এটাকে ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

আপনার বাড়ির পাশে কোন নির্মাণাধীন ভবন থাকলে, এটার বেজমেন্ট, লিফটের গর্ত, ইট ভেজানোর চৌবাচ্চা, ড্রাম পরীক্ষা করুন। যদি এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে ছোট ছোট পোকা দেখতে পান তাহলে বুঝবেন সেটি এডিস মশার লার্ভা বা বাচ্চা। নির্মাণাধীন ভবনের মালিককে সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করুন যেন সে তার বাড়িতে মশা জন্মানোর স্থান তৈরি না করেন। নির্মাণাধীন ভবন যদি আপনার হয় তাহলে সেখানে জমে থাকা পানিতে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রাখুন।

আপনার বাড়ির আশেপাশে যদি মশা জন্মানোর মতো কোনো সরকারি বেসরকারি স্থাপনা থাকে তাহলে ওই অফিসকে জানান। বাড়ির আশেপাশে গাছের গর্ত বা কাটা বাঁশের গোঁড়া মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিন। কারণ গাছের কোটর বা বাঁশের গর্তে এডিস মশার জন্ম হয়।

মশা তাড়ানোর যে সমস্ত মশার কয়েল, ধূপ বা তেল ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলোই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। এগুলোর ধোঁয়া সিগারেটের ধোঁয়ার চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু রান্নাঘরেই রয়েছে এমন কয়েকটি উপাদান, যা সহজেই তাড়িয়ে দিতে পারে মশা।

মশা তাড়ানোর জন্য লাগবে কিছুটা রসুন, তেজপাতা গুঁড়া আর কর্পূর। আর একটু সরিষার তেল।

কীভাবে বানাবেন মশা তাড়ানোর মিশ্রণটি?

প্রথমে, একটি মাটির প্রদীপ নন। এক চামচ রসুন বাটা দিন। এর সঙ্গে সামান্য তেজপাতা গুঁড়া আর কর্পূর মেশান। গোটা মিশ্রণটির উপর এ বার সরিষার তেল ঢেলে দিন। এমন ভাবে তেল দেবেন, যেন পুরোটা তেলে ডুবে যায়। এর পরে এতে একটি সলতে যোগ করে দিন। সলতেটিতে আগুন জ্বালিয়ে দিন। দ্রুত পালাবে মশা। এটি আপনার শরীরেরও কোনও ক্ষতি করবে না।

একটি লেবু চার টুকরো করে কেটে, কাটা অংশে পাতিলেবুর শাঁসের মধ্যে কয়েকটা লবঙ্গ গুঁজে দিন। এমন ভাবে গাঁথবেন, যাতে লবঙ্গর মাথাগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকে।

এই ভাবে বাড়ির নানা কোণে বা জানালার কাছে প্লেটে করে রেখে দিন লেবু-লবঙ্গের এই মিলমিশ। এতে ঘরে মশা প্রবেশ করবে না। লেবু ও লবঙ্গের যৌথ গন্ধে মশা পালাবে আবার রাসায়নিকের সংস্পর্শ নিতে হবে না।

কর্পূরের গন্ধ সহ্য করতে পারে না মশারা। কর্পূর উদ্বায়ী বলে একে খোলা জায়গায় ফেলে রাখা যায় না। সে ক্ষেত্রে কর্পূরের ট্যাবলেট কিনে এনে তাকে একটা পানিভর্তি পাত্রে ফেলে রাখুন। এতে কর্পূর উবে যাবে না আবার মশাও দূরীভূত হবে সহজে।

মশা নিধনের জন্য ধোঁয়া দিয়ে হয়তো উড়ন্ত মশা মেরে ফেলা যাবে। কিন্তু যে পানিতে লার্ভা থাকে সেখানে যদি সরাসরি স্প্রে না করা হয় তাহলে এডিস মশা জন্মাবেই। তাই এডাল্ডিসাইডের পাশাপাশি লার্ভিসাইডও করা দরকার। অর্থ্যাৎ ধোঁয়া দিয়ে মশা নিধনের পাশাপাশি স্প্রে করতে হবে। জেনে নিন যেভাবে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করবেন-

সাবান

বিভিন্ন নার্সারিতে কীটপতঙ্গ মারার জন্য এক ধরনের সাবান ব্যবহার করা হয়। তবে মশার লার্ভা ধ্বংসে যেকোন ধরনের সাবানই কার্যকর। মশার লার্ভা ধ্বংসে বাসন মাজার সাবান, শ্যাম্পু সবই ব্যবহার করতে পারেন। এক গ্যালন পানিতে এক মিলিলিটার সাবান মিশিয়ে মশার উৎসস্থলে দিতে পারেন লার্ভা ধ্বংসের জন্য।

ব্লিচিং পাউডার

ব্লিচিং পাউডার যদিও পরিবেশবান্ধব নয় তারপরও এটি মশার লার্ভা ধবংসের জন্য কার্যকর। যখন অন্য কোনও উপায় থাকবে না তখনই শুধু এটা ব্যবহার করুন।শুধুমাত্র নিশ্চিত হয়েই লার্ভার উৎসস্থলে এটি ব্যবহার করুন। এমন স্থানে এটি ব্যবহার করুন যেখানে অন্য কোনও পানিপ্রবাহের উৎস নেই। বৃষ্টির জমে থাকা বদ্ধ পানিতে এটা ব্যবহার করতে পারেন। প্রতি গ্যালন পানিতে এক চামচ ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করতে পারেন।

বিভিন্ন রকম তেল

এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের তেল বেশ কাজে দেয়। বিশেষ করে অলিভ অয়েল, ভেজিটেবল অয়েল এবং কেরোসিন তেল দিয়ে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করা যায়। জমে থাকা পানিতে এই ধরনের তেল দিলে লার্ভা নষ্ট হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন মাছ আছে এমন পানিতে এইসব তেল ব্যবহার না করাই ভালো।

অ্যাপেল সিডার ভিনেগার

স্থির পানিতে আপেল সিডার ভিনেগার ঢেলে মশার লার্ভার ধ্বংস করা যায়। তবে এর ফল পেতে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এই মিশ্রণটি তৈরি করতে ৮৫ ভাগ পানির সঙ্গে ১৫ ভাগ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মেশাতে হবে। তবে এই মিশ্রনটি এমনভাবে তৈরি করতে যাতে ভিনেগারের পরিমাণ বেশি থাকে ।ভিনেগারের পরিমাণ কম হলে লার্ভা ধ্বংস করা যাবে না। ভিনেগার পরিবেশের জন্য নিরাপদ। এডিশ মশার লার্ভা ধ্বংসে এটা ব্যবহার করতে পারেন।

(ঢাকাটাইমস/১৩ জুলাই/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :