এইচএসসির খাতা মূল্যায়নে দায়িত্বহীনতা: পরীক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:০৭ | প্রকাশিত : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৫২

একজন শিক্ষার্থীর এক যুগের সাধনার সুফল নির্ভর করে এইচএসসি পরীক্ষার খাতার সঠিক মূল্যায়নের উপর। সেই এইচএসসি পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর বাড্ডার ন্যাশনাল কলেজের শিক্ষক মো. আবু তাহেরের বিরুদ্ধে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিষয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজির পরীক্ষক। তার কাছ থেকে খাতা ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

নিজের কোচিং সেন্টারে পড়তে আসা রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের দিয়ে চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার খাতায় ওএমআর বৃত্ত ভরাট ও খাতা মূল্যায়ন করিয়েছেন, এমন অভিযোগ উঠে শিক্ষক তাহেরের বিরুদ্ধে। নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে এই অভিযোগ তোলেন।

বিষয়টিকে দায়িত্বের প্রতি চরম অবহেলার বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। এছাড়া এমন ঘটনা পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ভয়াবহ আস্থাহীনতা তৈরি হয়ে শিক্ষার্থীরা মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে পারে বলে আশঙ্কা মনোবিদদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করেন বাড্ডার ন্যাশনাল কলেজে কর্মরত মো. আবু তাহের। তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজির পরীক্ষক। তাই বাসা এবং কোচিং সেন্টারে বসে এইচএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেন। ঘটনার দিন খাতা মূল্যায়নের সময় তার কোচিংয়ে পড়তে আসা রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দায়িত্ব দেন ওএমআর বৃত্ত ভরাটের জন্য।

ওই শিক্ষার্থীরা ওএমআর বৃত্ত ভরাট করার পাশাপাশি খাতাগুলোর ছবি তোলেন এবং ভিডিও ধারণ করেন। পরে পাবলিক পরীক্ষার খাতা তাদের দখলে এমনটা উল্লেখ করে ফেসবুকে ভিডিওটি পোস্ট করেন। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। কারণ সেই শিক্ষক খাতাগুলো দেখে তাদের জানিয়েছে এগুলো নটরডেম কলেজের খাতা।

পরে নটরডেম কলেজের সেই পরীক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। ধারণা করা হয় ওএমআর বৃত্ত ভরাটের পাশাপাশি একাদশ শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীদের দিয়ে খাতাও মূল্যায়ন করিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক মো. আবু তাহেরের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। তিনি বলেন, ‘আমি এবার সাড়ে ৪০০ খাতা পেয়েছি মূল্যায়নের জন্য। সেগুলো বাসায় বসে দেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থী পড়াবার আমার একটা নিজস্ব জায়গা রয়েছে। সেখানেও খাতাগুলো দেখি। সেদিনও খাতা দেখছিলাম। তখন আমার কাছে পড়তে আসা কয়েকজন ছাত্রীকে ওএমআরের বৃত্ত ভরাট করার জন্য দিই। তারা বৃত্ত ভরাটের পাশাপাশি কখন ছবি এবং ভিডিও করে তা আমার জানা নেই। তবে ছাত্রীদের দিয়ে এ কাজ করানো মোটেও উচিত হয়নি আমার।’

শুধু ওএমআর বৃত্ত ভরাটই করিয়েছেন। কিন্তু ছাত্রীদের দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করেননি দাবি শিক্ষক মো. আবু তাহেরের। তিনি বলেন, ‘ আমি ভীষণ সৎ এবং সত্যবাদী একজন মানুষ। আমি কোনোভাবেই ছাত্রীদের খাতা মূল্যায়ন করতে দিইনি। ছাত্রীরা শুধু ওএমআর বৃত্ত ভরাট করতে দিয়েছি। আমি ২০১৫ সালেও খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তখন ৭০০ খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব ছিল আমার। মা আমার বাসায় ছিলেন। মায়ের মৃত্যুও সেই সময়টায় আমার বাসায় হয়েছিল। সেই মানসিক অবস্থা নিয়েও আমি খাতা মূল্যায়ন নিজে করেছি। সেজন্য প্রধান পরীক্ষক আমাকে সাধুবাদও জানিয়েছিলেন। আর এখন সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে আমি কীভাবে ছাত্রীদের দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করাতে পারি? এছাড়া এটি তদন্ত হচ্ছে। শোকজ করেছেন বোর্ড। তখন জানা যাবে খাতা মূল্যায়ন করেছি কি না।’

আবু তাহের বলেন, এগুলো নটরডেম কলেজের পরীক্ষার্থীদের খাতা যে তা আমি নিশ্চিত করে বলিনি। কারণ সেখানে রোল নাম্বার নেই। খাতাগুলো দেখে মনে হয়েছে এগুলো নটরডেম কলেজের খাতা। তাদের লেখার পদ্ধতি ভিন্ন রকম। আমার ভালো লাগে। তোমরাও এভাবে লিখবে এটা বলেছি।’

বোর্ড পরীক্ষার খাতা পরীক্ষকের হাতে দেওয়ার আগে শিক্ষাবোর্ড থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয় যথাযথ নিরীক্ষণসহ গোপনীয়তার বিষয়ে। কিন্তু পরীক্ষকের এই মাত্রায় অবহেলা করাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতি অবহেলা বলে মনে করেন খাতাগুলোর মূল্যায়নে প্রধান পরীক্ষকের দ্বায়িত্বে থাকা ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যাপক ড. মো. ইহলাম হোসাইন।

ঢাকা সিটি কলেজের এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রধান পরীক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো পরীক্ষক খাতা দেখা শেষ করে আমার কাছে পাঠাবেন। কিন্তু খাতা দেখা শেষ হওয়ার আগেই ওই পরীক্ষক আমাকে জানালেন কিছু অসুবিধা হয়েছে ফলে খাতাগুলো বোর্ড নিয়ে নিয়েছেন বিধায় আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না।’

‘পরে বোর্ড থেকে আমি ঘটনাটি শুনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। কারণ খাতাগুলো দেওয়ার সময় গোপনীয়তার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। খাতাগুলোর প্রতি সুবিচার করা আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পরীক্ষকের এমন অবহেলা কোনভাবেই কাম্য নয়।’বলেন ইহলাম হোসাইন।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. জাহিদ বক্ত চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, এই অভিযোগ যাচাই করে দেখেছি এবং দায়িত্বরত পরীক্ষকের কাছ থেকে খাতা নিয়ে আনা হয়েছে। এটা খুবই গোপনীয় বিষয়। অভিযুক্ত পরীক্ষককে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।

পরীক্ষকের নিজে খাতা মূল্যায়ন না করা, ভালোভাবে উত্তরপত্র না পড়ে অনুমানের ভিত্তিতে নাম্বার দেওয়া, অদক্ষ পরীক্ষক, কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বোর্ড পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় দিনের পর দিন অবহেলা করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই ঘটনাটি করুণ এজন্য যে একজন দায়িত্বরত শিক্ষক তো এটা করতেই পারেন না। এটা খুবই গর্হিত একটি কাজ করেছেন ওই শিক্ষক।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, এরকম ঘটনা হয়তো আরও ঘটছে যা আমরা জানি না। এটা হাস্যকর এই কারণে যে সেই শিক্ষার্থীরাই ছবি এবং ভিডিও করে তা জাতিকে জানিয়ে দিয়েছে। ফলে এই ঘটনা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার করুণ এবং হাস্যকর দিকটি উন্মোচন করলো।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, এই ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণও বটে। কারণ দায়িত্বরত শিক্ষককে তার শিক্ষার্থীরা কোন দৃষ্টিতে দেখেন। শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীরা যে শ্রদ্ধা রাখে না সেটিও প্রমাণিত। যদিও এমন শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার কারণও নেই। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শিক্ষকের যতটুকু সম্মান বেঁচে ছিল তা নষ্ট করে দিলো শিক্ষার্থীরা। এখানে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন শিক্ষক। শিক্ষকদের কাছে এটা মোটেই প্রত্যাশিত নয়।

এমন ঘটনা শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট করে দেবে উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট না হলেও দুর্বল হবে। তাদের এই ভাবোদয় হবে যে আমি এত কষ্ট করে পরীক্ষা দিবো কিন্তু মূল্যায়ন তো যথার্থভাবে হবে না। ফলে শিক্ষার্থীরা আস্থাহীনতায় ভুগবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ এই ঘটনা কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমে ঘটছে না। এটি ঘটছে কেবল মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায়। ফলে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করা হচ্ছে এবং ইংরেজি মাধ্যমকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। এছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে সিলেবাস পরিবর্তন হয় না, কারিকুলাম বদল করে না, প্রশ্নফাঁস হয় না। ফলে অভিভাবকেরা ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি উৎসাহী হবে। সেই শিক্ষক জানেন না তিনি কতবড় অন্যায় করেছেন। নৈতিক অন্যায় তো বটেই ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও অন্যায় হয়েছে। এটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম আঘাত।’

মনোবিদ মেখলা সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ এটা খুব অন্যায় করেছেন ওই শিক্ষক। এটা এই বয়সী শিক্ষার্থীদের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। কারণ এই বয়সে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায় না। এই ভিত্তি তৈরির সময়েই সেই জানল যে এ ধরনের ভুল হয়। অথচ শিক্ষকদের যেখানে আদর্শ মনে করে তারা। শিক্ষার্থীদের নৈতিক অনুভূতির জায়গা নষ্ট হলো। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর নৈতিক জায়গাটিও নষ্ট হলো।

এই মনোবিধ বলেন, এ ধরনের নেতিবাচক বিষয় তারা স্বাভাবিকভাবে দেখতে শুরু করবে। কাজেই অভিভাবকদের তাদের বোঝাতে হবে যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা যেন কোনভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। শিক্ষকের প্রতি সম্মানের জায়গা সমুন্নত রাখার দায়িত্বও শিক্ষকদের।’এমন ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এবং ঘটনাটির বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও জোর দেন মেখলা সরকার।

(ঢাকাটাইমস/২২সেপ্টেম্বর/টিএ/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :