বিদেশি শক্তির চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী তৎপরতায় অস্বস্তি বিরাজ করছে সর্বস্তরে। ভূরাজনৈতিকভাবে ঝুঁকি বাড়ছে বলে আশঙ্কা করছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। শঙ্কা গড়িয়েছে দেশের জনগণের মাঝেও।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বরাবরই বাংলাদেশ ঘিরে আগ্রহ ছিল পশ্চিমাদের। রাজনৈতিক অস্থিরতায় হুট করেই ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের সবচেয়ে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এমন যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছে। স্বাধীন দেশের ভূখণ্ডে বিদেশিদের তৎপরতা এবং চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রতিনিয়ত দেশের জনগণকে ভাবিয়ে তুলছে।
ভারত, চীন এবং রাশিয়া মনে করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন করতে সক্ষম। এই ৩টি পক্ষই বলছে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ একইসঙ্গে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চায় বলে বারবার স্পষ্ট করেছে ভারত। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে নির্বাচন চায় বলেও উল্লেখ করেছে চীন ও রাশিয়া। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে বারবার। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তাদের সমর্থন নেই বলেও জানিয়েছে পশ্চিমারা। অর্থাৎ বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিদেশিদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস বংলাদেশে সরকারবিরোধী পরিকল্পনা করছে- এমন অভিযোগ এনেছেন রুশ মুখপাত্র। দেশটির এমন মন্তব্যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে।
নাগরিক উৎকণ্ঠা এবং বিশ্লেষকদের মত
এমন বাস্তবতায় বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য সমর্থন করে না ঢাকা। এ থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।
বিশ্বে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় গত ১৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন ‘শ্রম নীতি’র আলোকে ঐতিহাসিক ‘মেমোরেন্ডাম’ ঘোষণা করে হোয়াইট হাউজ। সেসময় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বানের পাশাপাশি মেনে না চললে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০ নভেম্বর দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটনের ঢাকা দূতাবাস। গত বুধবার এই সতর্কতার বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এলে ঢাকায় আলোচিত বিষয় হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি।
এর আগে গত ২৪ মে বাংলাদেশের উদ্দেশে ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এর আওতায় রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকারপন্থি ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা, এবং বিচার বিভাগের কর্মকর্তারাও। গত ২২ সেপ্টেম্বর এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।
এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের মাঝেও উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। ৫০ থেকে ৭০ বছরের দেশের নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাক াটাইমস। দেশের অভ্যন্তরে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন না বলে জানিয়েছেন এই জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ৭০ বছর বয়সী মো. ইউসূফ। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাইরের হস্তক্ষেপ তো কামনা করি না। আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে অন্যদেরকে মাথা ঘামাতে কেন দেব? আমি আপনি ভাই-ভাই। আমরা মারামারি করব, পরে আবার মিলব।
তিনি আরও বলেন, ‘অন্যরা আইসা তো পরে আবার তাদের স্বার্থ দেখবে। আমাদেরকে বাধায় দিয়া তো তাদের স্বার্থ হাসিল করবে। বিদেশিদের আমরা চাই না। আমি চাই, ঝগড়া বিবাদ যা বাঁধছে, সেটার মীমাংসা আমরাই করব।’
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যের চাকরি শেষে দেশে ফিরেছেন ৬০ বছর বয়সী শফিকুর রহমান। বিদেশিরা হস্তক্ষেপ কেন করবে এটাই তার প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘নিজেরা যদি ন্যায়ের পথে হাঁটতাম, তাহলে বিদেশিরা ঢুকতে পারত না। আমরা সঠিক কাজটা করলে, নিজেরা শক্ত থাকতাম। কেউই নাক গলাতে পারত না।’
জনগণের মাঝে এই উদ্বেগের বস্তুগত ভিত্তি আছে বলে মত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে তো ঝুঁকি থাকবেই। আমরা যদি মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারতাম এবং তাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন এবং এক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারতাম তাহলেই কিন্তু বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমে যেত।’
আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন জাতির জন্য বিদেশিদের এই হস্তক্ষেপ দুঃখজনক, অপমানজনক এবং খুব বিপজ্জনক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সর্বজন কথা’র সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা টাইমসকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থায় শক্তিশালি হয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি। এই রাজনীতিকরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চায়। ক্ষমতার যদি বদলও হয় সমস্ত কিছু ক্ষমতার কাছেই কুক্ষিগত থাকবে। এখন ক্ষমতায় থাকতে হলে বিদেশি শক্তিগুলোকে খুশি রাখতে হয়। বর্তমান সময়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়ার বিনিয়োগ যদি আমরা লক্ষ্য করি এতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে। তাদেরকে খুশি রাখতে গিয়ে দেশের সম্পদ ও মানুষের ক্ষতি হচ্ছে।’
তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ। তার মতে, বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে আলাদা নয়। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই আলাদা টিকে থাকতে পারে না। পারস্পরিক স্বার্থ বজায় রেখেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুরাষ্ট্রদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়েছে বলেই আমাদের প্রতি তাদের নজর বেড়েছে বলে জানান তিনি।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বিগত কয়েকবছর ধরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করেছি। আমরা হয়তো সবজায়গাতেই সফল হয়নি। তবে অনেকাংশেই সফলতা এসেছে। সরকার জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই সতর্কতার সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘সংবিধানে লেখা আছে দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু সর্বজনের মত উপেক্ষা করে সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে। আবার দেশের আইন-আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয় যেখান থেকে চিন্তার উৎপত্তি হওয়ার কথা ছিল। এরাই তো একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিল।’
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মহলের স্বার্থ
গত ১০ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের (২+২) বৈঠকেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আলোচনায় উঠে আসে। বৈঠক শেষে সেসময় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভারত।
ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির বৈঠকের পর সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। ভোটের আগে পররাষ্ট্রসচিবের দিল্লি সফর নিয়ে আলোচনায় সরব হয়ে উঠে বিভিন্ন মহল। গত ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। সে রাতেই নয়াদিল্লিতে অবস্থিত প্রায় ৫০টি দেশের কূটনীতিককে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিষয়ে ব্রিফ করেছেন পররাষ্ট্রসচিব। ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানান, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের অঙ্গীকারে আস্থা রেখেছে ভারত।’
বাংলাদেশে নয়াদিল্লির স্বার্থ বিশ্লেষণ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির জানান, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায়, নয়াদিল্লির প্রধান বিষয় নিরাপত্তা এবং অর্থনীতি। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্যই নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের অন্যতম বাজার বাংলাদেশ।
প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে দিনে দিনে বাড়ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগও ভারতের। অন্যদিকে রাশিয়ার বিনিয়োগে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপরেই বাংলাদেশ নির্ভরশীলতা অতিমাত্রায় লক্ষ্যণীয়। মোটাদাগে ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকের জন্যই একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকদের মতে, দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ এখন আর ভূরাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতাতে মেতে আছে ওয়াশিংটন ও বেইজিং।
বাংলাদেশে ওয়াশিংটনের স্বার্থ প্রসঙ্গে এম. হুমায়ুন কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওয়াশিংটনের অন্যতম কারণ বাণিজ্য এবং দেশে জ্বালানি খাতেও সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। তারা বাংলাদেশকে মনে করে একটা বর্ধিষ্ণু ও মধ্যবিত্ত বাজার যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় সুযোগ। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে মার্কিনিরা। তাই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের একটি বিশেষ মনোযোগ রয়েছে’।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গতিবিধি যদি লক্ষ্য করি তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমাদের বক্তব্য তাদের মুখের কথা। এটাকে তারা সবসময়ই কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। প্রকৃত অর্থেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের এজেন্ডা ভিন্ন।’
এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে নিকট ভবিষ্যতে জিএসপি প্লাস অর্জনে ইউরোপের সঙ্গে আলোচনাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির।
বাংলাদেশের ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুপক্ষই শঙ্কিত তবে সক্ষমতার তফাৎ সম্পর্কে এই কূটনীতিক বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন এত সক্রিয়? কারণ মার্কিনিরা বুঝে ভারতকে দিয়ে চীনকে ঠেকানো যায় না। চীন ভারতের চেয়ে পাঁচ গুণ শক্তিশালী হওয়ায় ঠেকানোর সক্ষমতা নয়াদিল্লির নেই। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে।’
ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি স্পষ্ট করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা যদি ভূরাজনৈতিকভাবে আমাদেরকে শক্তিশালী করতে পারতাম তাহলে সেভাবেই নেগোশিয়েট করতে পারতাম। সেটা হলো যে আমাদের প্রয়োজনে আমরা কাদের সঙ্গে কতটুকু কাজ করব। কাজেই আমার যদি মাটিতে পা না থাকে, জনগণের মত প্রকাশের জায়গা থেকে যদি শক্তি না আসে তবে সেটা অবশ্যই দুর্বলতা।’
এই সংকটের দায় কার এবং চাপ মোকাবিলায় করণীয় কী
শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে গত ১৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির জবাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, ‘সংলাপের পর্যাপ্ত সময় নেই।’
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ খুব দুর্বল এবং অপরিণত ব্যবস্থায় আছে উল্লেখ করে ‘সর্বজন কথা’র সম্পাদক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে যারা বিরোধিতায় থাকেন তারা বরাবরই এই পথেই যান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী ছিল তারাও বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছিল। এখনও বিদেশিদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা নির্ধারণের কাজ চলছে। দেশের সম্পদ ও মানুষের কী হবে তা নিয়ে খোদ দেশের মানুষের কাছে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, এবং ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। বিদেশিরা ঠিক করছেন এ দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ।’
দেশের মানুষের উদ্বেগ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনো কিছু পাত্তা না দিয়ে সরকার নিজের পরিকল্পনাতেই হাঁটছে বলে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ তো আন্তর্জাতিক মহলের সদস্য। সেসব বিবেচনায় আচরণ নির্ধারণ করতে হবে। বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক যদি পুনরায় তৈরি করতে হয়, এই চাপ সামলানোর সক্ষমতা আমাদের আছে কি না, সেটা ভেবেই কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের গোটা অর্থনীতি পশ্চিমের সাথেই সংযুক্ত।’
ওয়াশিংটন বা নয়াদিল্লি বিদেশি কোনো পক্ষকেই দেশের জনগণ চায় না তা উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রাজনীতিবিদরাই দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি চাপের জন্য দায়ী।
ঢাকা টাইমসের এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিবিদরাই এর জন্য দায়ী। কিছু হলেই মিশনে গিয়ে ধরনা দেয়। একশ’টা চিঠি লিখে। দ্বিতীয়ত দেশের সংবাদমাধ্যম এর জন্য দায়ী। যারা বিদেশে আছেন প্রধানত তারা দায়ী। এই প্রত্যেক দিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্পোকসপারসন, তাকে ত্যক্ত করেন এই বাংলাদেশি সাংবাদিকরা। আবার কিছু প্রবাসী বাংলাদেশিও রয়েছেন। এই কয়েকটি গোষ্ঠীর কারণে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি কথা বলতে পারছে’।
বিদেশিদের হস্তক্ষেপে নির্বাচনে তেমন প্রভাব পড়বে না জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘বিদেশিরা তো চেষ্টা করবে এবং নির্বাচন চলে আসায় এটা নিয়ে এত কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিদেশিদের চাপ এর আগেও ছিল, টানাপোড়েন হয়তো এখনও আছে, থাকবে। তবে আমি আশাবাদী তা পেরিয়ে যাব’।
২০২১ সালের সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসে বাংলাদেশে। র্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি।
(ঢাকাটাইমস/০১ডিসেম্বর)