বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

তদারককারী কর্তৃপক্ষ কেন পার পেয়ে যায় বারবার

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৬ | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০৮:২২

বেইলি রোডের গ্রীন কোজি কটেজ ভবনের অগ্নিকাণ্ডে যেন এক মৃত্যুপুরী দেখেছে দেশবাসী। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আর সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে ৪৬ জনের প্রাণ গেলেও এখন পর্যন্ত এই ঘটনার দায়ে কোনো কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলা এবং গাফিলতির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সরেজমিনে ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, এই ভবনটি অনেক আগে থেকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল- তা জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত দুই কর্মকর্তা। এমনকি ভবনটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতেও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি তারা। শুধু লোক দেখানো নোটিশ চালাচালি করেই দায়সারা ভূমিকা পালন করেছে এই কর্মকর্তারা।

২০১১ সালে গ্রীন কোজি কটেজ ভবনটি নির্মাণে বেইজমেন্টসহ ৮ম তলা আবাসিক-কাম বাণিজ্যিক হিসেবে অনুমোদন দেয় রাজউক। এর মধ্যে নিচতলা থেকে পঞ্চমতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক এবং বাকি ৩ তলা আবাসিক হিসেবে অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৩ সালে। তবে নির্মাণের পর ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউক থেকে কোনো অকুপেন্সি সনদ নেয়নি মালিক কর্তৃপক্ষ।

তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি রাজউক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে গ্রীন কোজি কটেজ ভবনটির মালিকের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। জরিমানার রসিদে বলা হয়েছে, ইমারতের অবৈধ অংশ ভাঙা অপসারণ কাজে ব্যবহৃত পে-লোডার ভাড়া ও জ্বালানি বাবদ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

৫ বছরেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি রাজউক:

এদিকে অভিযানের পর ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ভবনটি ভাঙা বা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি রাজউক। শুধুমাত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কর্মকর্তারা। বেইলি রোড এলাকার দায়িত্বে ২ বছর যাবত নিয়োজিত আছেন রাজউকের অথরাইজ অফিসার প্রকৌশলী জোটন দেবনাথ। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা নিয়মিতই তাদের সতর্ক করেছি। এছাড়াও সেখানে ২০১৯ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানাও করা হয়েছিল। এরপরেও যখন তারা ভবনটি ব্যবহারে অকুপেন্সি সনদ না নিয়েই কার্যক্রম চালিয়েছে তখন আমরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।

২০১৯ সালের পর আর কোনো অভিযান বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের পর রাজউক আর কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। তবে আমরা গণবিজ্ঞপ্তির পাশাপাশি দেশে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ভবনের বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। তবে কেউই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফায়ার সার্ভিসও অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে আমাদের অবগত করেনি। এই আগুনের দায় শুধু রাজউকের নয়, আরও অনেকেরই দায় রয়েছে। রাজউক তো তাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপর আমরা বারবার তাদের সতর্ক করার পরও মালিকপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অভিযানের পর ৫ বছর যাবত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন ভবনটি ভাঙার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজউকের পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি ঠিকই তবে আমরা প্রতিবছরই গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।

ঝুঁকির কথা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানায়নি ফায়ার সার্ভিস:

আগুন লাগার ৬ মাস আগেই ভবনটিতে অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি জানতে পেরেছিল ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক অধীর চন্দ্র হাওলাদার। গত বছর শুধু দুইটি নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন তিনি। তবে সেই অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি সিটি করপোরেশন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে রহস্যজনক কারণে জানাননি তিনি।

জানা গেছে, ভবনটি তৈরির সময় ফায়ার সেফটি প্লান ছিল না, এমনকি ফায়ার সেফটি প্লানের কার্যকারিতা সনদও ছিল না। ছিল না ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি ছাড়পত্র। তাছাড়া ভবনটির বৈদ্যুতিক ওয়ারিং কখনো পরীক্ষা করা হতো না। অগ্নিঝুঁকি এড়াতে ভবনটিতে ফায়ার পাম্প হাউজ এবং ফায়ার পাম্প বসানো হয়নি ।

বেইলি রোড এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) অধীর চন্দ্র হাওলাদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, বেইলি রোড ও এর আশপাশের এলাকার দায়িত্বে তিনি নিয়োজিত আছেন। গত বছর মার্চ মাসে তিনি এই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি বলেন, তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার ভবনগুলোতে অগ্নিঝুঁকি আছে কি না জানতে তিনি পরিদর্শন করেন এবং সেই অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরি করেন। অগ্নিঝুঁকি থাকা ভবনগুলো চিহ্নিত করার পর সেই ভবন মালিককে অগ্নিঝুঁকি এড়াতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশের পরও যদি তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন না করেন তাহলে আমরা সেই ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিটি কর্পোরেশন ও রাজউক এর কাছে চিঠি দিয়ে থাকি। এছাড়া ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ভবনটি অগ্নিঝুঁকিতে আছে মর্মে ব্যানার টানিয়ে রাখি।

বেইলি রোডের আগুন লাগা গ্রীন কোজি কটেজে অগ্নিঝুঁকি ছিল কি না এবং সেখানে ফায়ার সার্ভিস কী ভূমিকা পালন করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে অধীর চন্দ্র বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আমি সেখানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে অনেক অনিয়ম ও অগ্নিঝুঁকি থাকার প্রমাণ পেয়েছি। তাদের বারবার সতর্ক করার পরও ভবন মালিক ও রেস্তোরাঁর মালিকপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

তিনি আরও বলেন, গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভবন মালিককে এবং একই মাসের ৫ তারিখ আমব্রোসিয়া রেস্টুরেন্ট এবং মিউজিক ক্যাফের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নোটিশ করা হয়েছিল। নোটিশে তাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে জবাব দিতে বলা হলেও তারা নির্দেশনা মানেননি।

ভবনটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন না করায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছিল কি না এবং সেখানে অগ্নিঝুঁকির ব্যানার টানানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৯০ দিন পার হলেও সেখানে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ব্যানার টানানো হয়নি, এটা ভুল হয়েছে।’ এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দপ্তর সিটি কর্পোরেশন বা রাজউক কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়নি বলেও স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তাদের সকল কর্মকাণ্ড ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক অবগত ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল বাশারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। তিনি বলেন, বেইলি রোডে এমন অনেক ভবন আছে অগ্নিঝুঁকির। তবে জনপ্রতিনিধি হয়েও আমাদের কিছুই করার থাকে না। ১৯ নং ওয়ার্ডে অনেক ভবনে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট আছে, শুনেছি অনেকগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিনে ঝুঁকিপূর্ন রেস্টুরেন্ট ও লাইসেন্সবিহীন রেস্টুরেন্ট আছে কি না তা তালিকার কাজ শুরু করেছি। তবে এই তালিকা করলেও আমরা কিছুই করতে পারব না। কারণ, ভবনের দায়িত্ব রাজউকের। তারা মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব অবহেলা না করলে এমন অঘটন ঘটে না। রাজউকের অবহেলায় এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অ.দা.) মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডেই সিটি কর্পোরেশনের জনবল রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে যদি সিটি কর্পোরেশন নগরীর ভবনগুলো তদারকির দায়িত্ব পায় তাহলে ভবন নির্মাণ ও নির্মাণের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করতে পারবে। তদারকির অভাবেই বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডটি ঘটেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘রাজউক থেকে বসবাসযোগ্য সার্টিফিকেট নিতে হলে ইমারত বিধিমালার সব নিয়ম মেনেই নিতে হয়। তাই এই সার্টিফিকেটের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এবং সংশ্লিষ্টদের মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন ও তদারকি করতে হবে। দেশে বিধিমালা ঠিকই আছে, তবে মানার বালাই নেই। অনেকেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনেই ভবন নির্মাণ করেন।’

এ ধরনের দুর্ঘটনার পর বরাবরই মালিকপক্ষের দুয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও বিচার সম্পন্ন হয় খুব কম। তবে এসব ঘটনায় তদারককারী কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর বিষয়টি কখনোই সামনে আসে না। দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা বরাবরাই পার পেয়ে যান। প্রশ্ন উঠছে, তদারককারীরা কেন পার পেয়ে যান বারবার।

(ঢাকাটাইমস/০৪মার্চ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারীর শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :