আর কত মানুষপোড়া অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অর্থলিপ্সুদের বোধোদয় ঘটবে?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
| আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৫ | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০

গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে অভিজাত বেইলি রোডস্থ গ্রিন কটেজ কোজি ভবনে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ড ঘটার খবর বিভিন্ন মিডিয়া প্রচার করতে থাকে। তখনো কেউ বুঝতে পারেনি বেইলি রোডের এই ভবনটির ভেতরে এমনভাবে মৃত্যুকূপ আগে থেকে তৈরি হয়ে আছে। যেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা মানেই হচ্ছে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য পা দেওয়া। শুধু তাই নয় ৭ তলা এই ভবনের সংকীর্ণ সিড়ি বেয়ে মানুষ উপরে উঠতেও বিপদ নিচে নামতেও বিপদে পড়েছে। গ্লাসবদ্ধ ফ্লোরগুলো মুহূর্তের মধ্যেই কার্বন মনোক্সাইডে ভরে গিয়ে যারাই ভেতরে ছিলেন তাদেরই শ্বাসনালী পুড়ে মৃত্যু ত্বরান্তিত হয়েছে। যারা কোনো প্রকারে উপরের দিকে দৌড়ে উঠতে পেরেছেন তারা অপেক্ষায় ছিলেন কখন ফায়ার ব্রিগেড এসে তাদেরকে নিচে নামিয়ে আনবেন। সেখানেও অনেক বিপত্তি ছিল। তারপরও ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীদের বদৌলতেই অপেক্ষমাণ শিশু, নারী এবং পুরুষরা অনেকেই নেমে আসতে পেরেছেন। গ্রিন কটেজ কোজি ভবনের অগ্নিকাণ্ডের ফলে ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বেশিরভাগই কার্বন মনোক্সাইডে মৃত্যুবরণ করেছেন। পুড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তারপরও প্রতিটি মৃত্যু একেকটি বিয়োগান্ত ঘটনার কাহিনি জানান দিয়ে গেছে। রাতের খাবার খেতে গিয়ে এভাবে মরতে হবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। কিন্তু ভাবতে না চাইলেও বাস্তবে এমন মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনাকে কেউ এমনি উড়িয়ে দিতে পারবে না।

বেইলি রোডের এই ভবনে কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়াও অনেক খাওয়ার রেস্টুরেন্ট, কফি হাউজ রয়েছে- যেগুলোতে সেই মুহূর্তে যারা গিয়েছিলেন তাদেরকেও পড়তে হয়েছে এমন জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণের মধ্যে। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ বেঁচে এসেছেন। বাকিরা বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। অবশেষে জানা গেল আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে নিচতলায়। চেষ্টা করা হয়েছিল আগুন নেভাতে কিন্তু ঘটেছে উল্টো। বিস্ফোরিত হলো গ্যাস সিলিন্ডার। সঙ্গে সঙ্গেই উপরের দিকে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিল সিঁড়ি এবং অধিকাংশ খাবারের রেস্তোরাঁ, কফি হাউজ ইত্যাদি। মূল ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে অনুমোদিত ছিল। কিন্তু ৭ তলা ভবনের মাত্র একটি তলাতেই রেস্তোরা ছিল না। ভবনের মালিক রেস্তোরার চাহিদা বেশি, ভাড়াও বেশি, টাকাও বেশি তাই পুরো ভবনটিতে বলতে গেলে খাবারদাবারের রেস্তোরাঁর হাট বসিয়েছেন। জানা গেছে, ফায়ার ব্রিগেড থেকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু মালিকের টনক নড়েনি। যারা রেস্তোরাঁ ও কফি হাউজ বসিয়েছেন তারাও ভবনের বৈশিষ্ট্য জানতে চাননি। তাদের একটি জায়গাই যেন হলে চলে। আর ভবন মালিকও এই চাহিদাই শুধু পূর্ণ করেছেন। বলা হয়ে থাকে এসব ভবনের অনুমোদন দিয়ে থাকেন ৫-৬টি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা কী দেখেন আর কী অনুমোদন দেন, কীভাবে দেন- সেই প্রশ্ন করার কি খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে?

এমন দায়িত্বহীনতার বিষয়টি শুধু এক্ষেত্রেই নয়। সর্বত্রই নিয়মনীতি ভেঙে মালিক এবং কর্তৃপক্ষ শুধু ঢাকাশহরেই নয় বাংলাদেশের বড়ো-ছোটো সব শহরেই এমন অবস্থা তৈরি করে রেখেছেন যে- বিষয়টিকে মগের মুল্লুক বললেও যেন কম বলা হবে। গ্রিন কটেজের মালিক ছাদেও রেস্তোরার আরো কাঠামো তৈরি করেছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ। সে কারণে ছাদে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদেরও দাঁড়ানোর জায়গা হচ্ছিল না। এই দুর্ঘটনা না ঘটলে ভবনের মালিক হয়তো আকাশ ছোঁয়ার ব্যবস্থা করতেন। এভাবেই আমাদের দেশে প্রায় সবকিছুই চলছে। সাধারণ মানুষ এমন ভবনে খেতে গিয়ে মৃত্যুকূপে পতিত হন। তাতে ভবন মালিকের অবশ্য খুব বেশিকিছু হয় বলে মনে হয় না। যারা অনুমোদন দিয়েছেন তারা তো টোনাটুনির গল্পের মতো গাছের আবডালে নিরাপদে বসে সবকিছু দেখছেন আর নির্ভয়ে নতুন নতুন স্থাপনায় একইভাবেই অনুমোদন দিয়ে আসছেন। আমাদের অনুমোদনদানকারীদের সম্পর্কে একটি কথা বাজারে খুব চালু আছে। কথাটি হলো- সবই অনুমোদন দিতে কোনো কার্পণ্য নেই যদি ডিমান্ডটা ঠিকঠাক মতো পূরণ করা হয়। ডিমান্ড পূরণ না করা হলে স্থাপনায় লালবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে মোটেও তারা পিছপা হন না। এভাবেই এই অরাজক অবস্থা শহরগুলোতে এখন ভরে গেছে। আবাসিক এলাকায় কী নেই? হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গন্সটিক সেন্টার, দোকান, মাছ, মাংস তরিতরকারি যা চান সবই ঘরে বসে পাওয়ার মতো সুলভ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঘরে বসে ফোন করলেই বাসায় এনে সবই দিয়ে যাচ্ছে। ফলে জীবন এখানে কত সুন্দর!

টাকা থাকলেই সবকিছু ঘরে চলে আসে। আবার আড্ডা দেওয়ার জন্য নামিদামি রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেখানে ভিড় লেগেই আছে। আজকাল ফুডপান্ডা খুবই সহজলভ্য ব্যাপার হয়ে গেছে। ফলে আবাসিক, অনাবাসিক এলাকা বলে কাউকে পৃথক করা যাবে না। কিন্তু এগুলোর অনুমোদন কে দিচ্ছে, কে এসব দেখভাল করছেন? যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখনই কেবল এ ওর দিকে আঙুল তোলে, চেঁচামেচি করে, হতাহত হলে কান্নাকাটি আর স্বজন হারানোর কথা শোনা যায়, হাই পাওয়ার তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও শোনা যায়। কদিন পার হলে এসবই চাপা পড়ে যায়। আবার নতুন করে কোথাও অগ্নিকান্ড ঘটলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিই যেন ঘটে। কাউকেই সাজা পেতে হয় না। অরাজকতা ঘটাতেও কারো কোনো বাঁধা থাকে না। এভাবেই তো আমরা ঢাকায় থাকি, ভাগ্যগুণে কেউ কেউ বেঁচে থাকি। কেউ কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত্যুকূপে পড়েন। সেই মৃত্যুকূপ হতে পারে রানা প্লাজার মতো ভেঙে পড়া ভবনের নিচে চাপাপড়ে মরার মতো ঘটনা। রানা প্লাজার বিষয়টি ছিল গার্মেন্টসসংক্রান্ত, বিদেশিরা ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে আমাদের গার্মেন্টস মালিকদের বাধ্য করতে পেরেছিল নিরাপত্তা বিধান রয়েছে এমন ভবনে কারখানা প্রতিষ্ঠা করার। সে কারণে এখন গার্মেন্টসের দুর্ঘটনার খবর বেশি শোনা যায় না। কিছু কিছু গার্মেন্টস বা গোডাউনে আগুন লাগার খবর শোনা গেলেও এখন আর বড়ো বড়ো দুর্ঘটনা ঘটার খবর শোনা যায় না। আমাদের গার্মেন্টস মালিকরা বিদেশিদের চাপকে আমলে নিয়েছেন। এর ফলে তাদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে এখন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করে চলেছে।

কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে মার্কেট, সুপারশপ আবাসিক-অনাবাসিক জায়গায়? কে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে? ঘণ্টা পরানোর জন্য তো অনেক প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। কিন্তু তাদের এত বছরের আইন প্রয়োগের চর্চার হাল-হকিকত যদি এমনটি হয় তাহলে এর চাইতে আর ভালো কী আশা করা যাবে? রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের অনুমোদিত ডিজাইন ৭০ শতাংশ মালিকই পরিবর্তন করে ফেলে। রাজউকের শীর্ষকর্তা যদি এই কথা বলেন তাহলে আমরা যাবো কার কাছে? রাজউকের হাতেই তো অনেক আইন রয়েছে। তারাই যদি আইনের প্রয়োগ না ঘটান তাহলে কার কী বলার আছে? রাজউক সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। আমাদের দেশে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানই খুব একটা সুনাম অর্জন করতে পারছে না। কারণ সকলরেই জানা বিষয়। কিন্তু জেনেও সবাই হজম করছেন। সেবা নিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে দেশের প্রচলিত আইনের চাইতেও সেবাদানকারী ব্যক্তিদের নিয়মটাই সবার আগে পূরণ করতে হবে- যতই আমরা মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলি না কেন? দুর্নীতির বাইরে গিয়ে জীবনযাপন করার মতো জায়গা কোথায়? সমাজে এখন সবকিছুর মধ্যে দ্বিচারিতা বড়ো হয়ে উঠেছে। মুখে ভালো কথা, কাজে ভিন্ন কথা- এভাবেই চলছে অনেককিছু। বেইলি রোডে আর যেসব ভবন আছে, সেগুলোর অবস্থাও তো প্রায় একই হবে। তারা কি তাদের প্রতিবেশী ভবনের এমন সর্বগ্রাসী অগ্নি-বিপর্যয়ের পর নিজেদের ভবনের নিরাপত্তা, কাস্টমার এবং নিজেদের নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নেবে? ৪৬ জন মানুষের প্রাণ চলে গেল। কত পরিবার এখন শোকে মাতম করছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে অনেকেই বাকি জীবন টেনে বইতে পারবেন কি না সেটি সেই পরিবারই কেবল বলতে পারবে। কিন্তু এরই মধ্যে বেইলি রোডের আশেপাশে আবার রেস্তোরা, খাবারের দোকান স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কোনো তদারককারী কর্তৃপক্ষ আশপাশের ভবনগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে এসেছেন কি না জানি না। এরই মধ্যে ঢাকার গাউসিয়াসহ কয়েকটি মার্কেটে আরো কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ছোটো আকারে হলেও সংগঠিত হয়েছে। সারা দেশে গত ৩/৪ দিনে অনুরূপ ছোটোখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সম্পদ কিছুটা পুড়েছে, মানুষ মরেনি। ভাগ্য ভালো। চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানেও আগুন লেগেছিল। মানুষের ক্ষতি হয়নি- কারণ সেখানে তেমন কেউ ছিল না। থাকলে হয়তো সেখানেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটত।

আসলে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। আমরা অর্থনৈতিক সাবলম্বী এবং সমৃদ্ধির হাতছানিতে এখন উপরে উঠে আসছি। দেশে এখন ধনী হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও নানাভাবে ধনী হয়ে উঠছেন। মাঝে-মধ্যে কোনো-না-কোনো মন্ত্রণালয়ের পিয়ন বা অধস্তন কারো বাড়িগাড়ির খবরাখবর মিডিয়ায় দেখতে পেয়ে চোখ বুজে আসে, কান গরম হয়ে যায়। দুর্নীতির কল্যাণে অনেকেই বাড়িগাড়ি আর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন, কিন্তু ঠিকমতো আয়কর দিচ্ছেন না। অনেকে নিজের আয়ের উৎস দেখানও না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদিন বিমা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় ক্ষোভের সঙ্গে সামর্থ্যবান অনেকেই যে রাজস্ব দিচ্ছেন না সে কথাটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার ক্ষোভ এবং আহ্বান সংশ্লিষ্টরা কতটা প্রতিপালন করবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র এবং সমাজ গড়তে হলে আমাদেরকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, দুর্নীতিবাজদের হাত যেন এগুতো না পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের সৎ উপায়টি থাকতেই হবে। যারা নয়ছয় করে সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে তাদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দিতে হবে। সমাজে নিয়মনীতি, আইন শৃঙ্খলা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা আধুনিক জীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সেবা যেমন পাবো- তেমনি অন্যদেরও দিতে পারব।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :