মন্ত্রীর আহাজারি এবং পুলিশপ্রধানের হুঁশিয়ারি

আলম রায়হান
  প্রকাশিত : ১০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৫| আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৪, ১৩:১৪
অ- অ+

‘ধান ভানতে শিবের গীত’ বলে একটি প্রবচন আছে। তবে এখন আর আগের ধারায় ধান ভানা হয় না। কিন্তু শিবের গীত চলছেই। এবং শিবের গীত যেনো সর্বব্যাপী। পেঁয়াজ-আলু থেকে আন্ডা- কিসে নেই শিবের গীত! শিবের গীতই যেনা আমাদের জাতিগত ধ্যানজ্ঞাণে পরিণত হয়েছে! আর এটি সীমা ছাড়ায় বিভিন্ন ইস্যুতে, বিশেষ করে ঈদের সময়। এ ক্ষেত্রে নাম্বার ওয়ান হচ্ছে সড়ক পরিবহন। প্রতি ঈদের প্রাক্কালেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তারা শিবের গীতে মনোনিবেশ করেন। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কারন এটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। আমরা তো ঐতিহ্যপ্রাণ!

টানা ১২ বছর দায়িত্ব পালনকারী সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ মার্চ বিআরটিএ'র সদর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্জনের ও উন্নয়নের যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই দেশের রাজধানীতে বাসগুলোর দিকে তাকানো যায় না। মফস্বলের গাড়িও এরচেয়ে অনেক ভালো। এটি আমাদের উন্নয়ন, অর্জনকে লজ্জা দেয়। এসব গাড়ি চলে চোখের সামনে। বাংলাদেশে এখন অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিত্তশালীরা যানজট এড়াতে সাঁই সাঁই করে চলে যায় এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। আর সব মানুষের জন্য আছে মেট্রোরেল। বিশ্বাস করেন, মেট্রোরেলে উঠলে এখনও মাঝে মাঝে বিভ্রম হয়, বাংলাদেশেই আছি তো! কিন্তু মেট্রো থেকে নামলেই, সেই আগের বাংলাদেশ, মেলানো কঠিন। এ যেন বাংলাদেশের ধনী-গরিবের বৈষম্যেরই ছবি। পরিবহন নেতাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা বলছেন, লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি বাইরে থেকে সিটিতে আসে। এই সিটিতেই লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির অনেক কারখানা আছে। আমি নিজেও ভিজিট করেছি। দেখেছি রং লাগাচ্ছে। এমন রং, যা ১০ দিন পরে উঠে যায়। রং থাকে না। আমাদের দেশ এত এগিয়ে গেলো, আর আমাদের গাড়ির গরিব চেহারা। রং দিয়ে লাভ নেই, ফিটনেস না থাকলে। এর একটি সমাধান নেতাদের কাছেই আমি চাই। এভাবে চলতে পারে না।’

মননীয় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ‘এভাবে চলতে পারে না।’ কিন্তু চলছে তো! মন্ত্রীর আসনে থেকে তিনি যতই অভিমান করুন, ক্ষোভ প্রকাশ করুন, লক্কড়-ঝক্কড় বাসকে লজ্জা বলে কথার ফানুস রচনা করুণ- তাকে কী অবস্থার কিছুমাত্র হেরফের হবে? হবে না। এর দায় সরকারের, আরও পরিষ্কার করে বললে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। এ ক্ষেত্রে পরিবহন নেতাদের দুষলে চলবে না। আর ‘শাজাহান ভাইর’ দিকে তাকিয়ে মন্ত্রীর কাঁতর আহাজারির তো কোনোই উপযোগ নেই! তাছাড়া তিনি সমাধান নেতাদের কাছে চাইবেন কেন? তার বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, জুজুর ভয় দেখিয়ে ভারত বিরোধিতার কার্যকারিতা যেমন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে তেমনই এর ওর দিকে তাকিয়ে চাতক পাখি হয়ে শিবের গীতের কোনো উপযোগ এখন আর নেই। এ বাস্তবতায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর উল্লিখিত কথামালা মানুষ আসলে গ্রহণ করেনি। বরং বিরক্ত হয়েছে।

এদিকে সড়ক পরিবহন নিয়ে শিবের গীত কেবল সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ কাতারে শামিল হয়েছেন, পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি ২৯ মার্চ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের কাছ থেকে গণপরিবহন বা ট্রেনে বাড়তি ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে হয়রানির চেষ্টা করলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ অথবা সংশ্লিষ্ট থানায় ফোন করে সহায়তা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রায় শেষ প্রান্তে থাকা আইজিপি। এসময় তিনি যাত্রীদের প্রতিও কিছু নসিয়ত করেছেন। কিন্তু তাকে কে প্রশ্ন করবে, বাড়তি ভাড়া কোনটি? তা কে নির্ধারণ করবে? এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ১ এপ্রিল যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিশ্চয়ই পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন শুনেছেন। শাজাহান খান বলেছেন, বাস মালিকরা সারাবছর যাত্রীদের যে ডিসকাউন্ট দেন সে কারণেই ঈদের সময় বাসভাড়া বাড়ান। বিভিন্ন সময় পাঁচশ টাকা ভাড়া হলে হয়ত একশ টাকা ডিসকাউন্ট সারা বছর চলে। তিনি বলেন, বিমানের ভাড়া বাড়ছে নাকি কমেছে? বিমান কি যানবাহন না? অবশ্যই বিমান গণপরিবহন। ঢাকা থেকে যাচ্ছে, সেই গাড়িটা কিন্তু ফাঁকা আসছে। সেখানে অনেক সময় তারা ভাড়া কিছুটা বাড়ায়, তাও খুব বেশি না। ডাবল নেয় না। আমরাও চাই ভাড়া বাড়ুক। মালিকরা যতই বলুক তারা ভাড়া বৃদ্ধি করবে না, কিন্তু দেখা যায় মালিকরা ভাড়া বেশি নিয়েই থাকে। শাজাহান খান বলেন, ওই যে সারা বছর যেটা ডিসকাউন্ট করে সেটাই বাড়ে। তিনি বলেন, তেলের দাম কমায় বাস ভাড়া সমন্বয় করা হবে, সেটি নিয়ে আজকে কথা হয়েছে। মালিকরাও বলেছেন, মন্ত্রীও বলেছেন এটি নিয়ে কথা বলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। টিকিট কালোবাজারি হয় না? সেখানেই কিন্তু বাড়তি ভাড়া হয়ে যায় অনেকক্ষেত্রে। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিতিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রকারন্তরে বাড়তি ভাড়া প্রসঙ্গে শাজাহান খানের বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর কি পুলিশপ্রধানের শিবের গীতের আর কোনো উপযোগ থাকে? থাকে না।

উপযোগ থাকুক আর নাই বা থাকুক শিবের গীত তো বন্ধ হবার নয়। বিশেষ করে ঈদের সময়। যেমন পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ১ এপ্রিল বলেছেন, ঢাকায় ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস চলবে না। রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চলাচল করা পুরোনো বাস বন্ধ করা হবে। এসব বাসের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। বায়ুদূষণ রোধসংক্রান্ত পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতবিনিময় সভায় ৩১ মার্চ এ কথা বলেন পরিবেশমন্ত্রী। তিনি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে কোনো আপস করা হবে না! পরিবেশ মন্ত্রী খুবই দামি কথা শক্ত করে বলেছেন, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে কোনো আপস করা হবে না।’ কিন্তু খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রীয় প্রকাশ্য অসহায় দশা কি পরিবেশমন্ত্রী বিবেচনায় নিয়েছেন? না নিয়ে থাকলে নেয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে অনেকেই কিন্তু হাতি-ঘোড়া-জল-মশা মিলিয়ে বহুল উচ্চারিত প্রবচনটি আওড়াচ্ছেন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে কিশোর খুন
ভৈরবে আগুনে দোকান পুড়ে ছাই, দেড় কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা
সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল যুক্তরাষ্ট্র
যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ সদস্য নিহত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা