নাসার বিজ্ঞানী হুমায়ুন কবির ও তার বাবা সাংবাদিক ‘দাদু ভাই’, অজানা কিছু অধ্যায়

আবদুল মান্নান
| আপডেট : ২৬ মে ২০২৪, ২০:৩১ | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০২৪, ২০:০৩

মরহুম হেদায়েত উল্লাহ। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী পদে চাকরি করতেন। আমি ছিলাম তার কলিগ। আমিও সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী পদেই চাকরি করতাম দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায়। সময়টা ছিল ১৯৯০ থেকে ২০০২ সাল। দীর্ঘ ১২ বছর একইসঙ্গে একই টেবিলে চাকরি করেছি আমরা দুজন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। অফিসের সবাই তাঁকে ‘দাদু’ বলেই ডাকতেন। আমিও ‘দাদু’ বলেই ডাকতাম। তিনি ইনকিলাব পত্রিকায় ‘দাদু’ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। কারণ, তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ লোক ছিলেন। উনি ছিলেন আমাদের কাছে জীবন্ত ডিকশনারি। তাঁকে যেকোনো সময় যেকোনো শব্দের অর্থ ও বানান জিজ্ঞেস করলে চট করে নির্ভুলভাবে বলে দিতেন। ওই সময় মোবাইল ফোনের এতটা বিস্তার ছিল না। আমাদের সেকশনে মাত্র একটি ইন্টারকম ছিল। প্রায় প্রতি শনিবারই আমেরিকা থেকে দাদুর ফোন আসতো। তিনি অনেক সময় নিয়ে কথা বলতেন। দাদু তাঁর ছেলে, ছেলের বউ ও নাতির সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি তাঁর নাতির সঙ্গেই বেশি কথা বলতেন।

‘দাদু’ মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে বলতেন, ‘আমার ছেলেকে একসময় বাংলাদেশের সব মানুষ চিনবে, রাষ্ট্র তাঁকে সম্মানিত করবে। কিন্তু আমি দেখে যেতে পারব না। কারণ, ততদিন আমি বাঁচব না।’ দাদু খুব মানবেতর জীবন যাপন করতেন। দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে ইয়াহিয়াকে নিয়ে অফিসে আসতেন। ইয়াহিয়া ছিল কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী।

যাহোক, ২০০২ সালে আমি আবার ইনকিলাবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় যোগদান করলাম। এরপর বেশকিছু দিন দাদুর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না। দুজন দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। হঠাৎ একদিন ইয়াহিয়া আমাকে ফোন করে বললো, ‘কাকা, আব্বু খুব অসুস্থ, ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন।’ আমি রাতেই দাদুকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম দাদু খুবই অসুস্থ। দাদু আমাকে দেখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে কেঁদে দিলেন। আমি দাদুর হাতে ৫০০ টাকা দিলাম। উনি খুব খুশি হলেন।’ হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে দাদু বললেন, ‘মান্নান ভাই, আমার ছেলের নাম ড. হুমায়ুন কবির। সে নাসার বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মরত। অথচ আমি বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছি।’ আমি দাদুকে বললাম, ‘আপনি আপনার ছেলের ফোন নম্বর দেন। আপনি যে অসুস্থ সেই খবরটি তাকে জানাই।’ দাদু বললেন, ‘না ভাই, তা আর জানানোর দরকার নাই। এই জীবনে আমি তার কোনো সহযোগিতা পাই নাই, মৃত্যুর আগে আমি আর তার সহযোগিতা চাই না।’ সপ্তাহখানেক পর দাদু না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন।’ দাদুর মৃত্যুর ২২ বছর পর আজ ড. হুমায়ুন কবির হেলিকপ্টারযোগে মাতৃভূমিতে আসলেন। আমি যখন এই প্রতিবেদনটি লিখছি, তখন ড. হুমায়ুন কবির কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসে অবস্থান করছেন। সাংবাদিকরা তার ছবি তুলছেন, দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। অভ্যর্থনা জানানোর যৌক্তিক কারণও আছে। কারণ, তিনি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আজ আমেরিকার আকাশ জয় করে আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন বিমান আর হেলিকপ্টার। তিনি এখন বিশ্ববিখ্যাত একজন বিজ্ঞানী। জনাব হুমায়ুন কবির অস্টিনের টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল মহাশূন্যযান ও রকেট বিজ্ঞান। বর্তমানে ড. হুমায়ুন কবির যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বোয়িং কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। এই দায়িত্ব থেকে তিনি আমেরিকার সরকারের প্রতিরক্ষা প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিচিত্র সাময়িকী গ্রন্থে একক এবং যৌথ বিজ্ঞান বিচিত্রা নামে বিজ্ঞানী হুমায়ুন কবিরের ৩৫টিরও বেশি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

বিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন কবির আমেরিকার আকাশে আমেরিকার হেলিকপ্টার সোসাইটির একজন বিজ্ঞানী এবং আবিষ্কারক। আমার প্রশ্ন হলো, তিনি তার বাবার জন্য কী করেছেন, তার আপন ভাই প্রতিবন্ধী ইয়াহিয়ার জন্য কী করেছেন, তিনি কিশোরগঞ্জের জন্য কী করেছেন, সর্বোপরি তিনি বাংলাদেশের জন্য কী করেছেন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :