ক্ষোভে, দ্রোহে শান্ত থাকায়ই মনুষ্যত্বের পরিচয়
শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ পরবর্তী পরিস্থিতি দেশকে বড়ো ধরনের সহিংসতার ভেতর ফেলেছে। এ সহিংসতা কারো কাম্য ছিল না। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দায়িত্ব রয়েছে এ সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে। সহিংসতা বন্ধ হওয়া জরুরি। আরও জরুরি একটি সহনশীল ও সহঅবস্থানমূলক সমাজের জন্য।
আমরা জানি, শেখ হাসিনা সরকারের গণতন্ত্রহীন শাসন এ তীব্র ক্ষোভের বীজবপন করেছে। তার শাসনামলে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন, পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, চাকুরিচ্যুত হয়েছেন এবং কারাগারে গেছেন। সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- ক্ষোভে, দ্রোহে শান্ত থাকায়ই মনুষ্যত্বের পরিচয়।
ছাত্র-জনতা যে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আন্দোলন করেছেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে শান্তির পথে যেতে হবে। ভিন্নমতের মানুষদের ঘরবাড়ি ভাঙা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট, সর্বোপরি জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সেই লক্ষ্যে পৌঁছার পথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। সবাইকে সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে, সংযমের পরিচয় দিতে হবে।
দেশবাসী এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ভেতর এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদী মনোভঙ্গি দেখেছে। তারা জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, তাদের কাছে মৃত্যু হয়েছিল খুব সাধারণ উপলক্ষ্য। প্রতিবাদকারীরা জেনে গিয়েছিল বুলেট ধেয়ে আসবে তাদের উদোমবুক ঝররা করতে তারপরও তারা অনড় ছিল।
যে লড়াই মানুষকে মরতে শেখায় সেই লড়াইয়ে জয় আসন্ন। এমন আত্মত্যাগের মনোভঙ্গি জাতি কি ’৭১-পরবর্তী দেখেছে? সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির গভীর ক্ষত এ জায়গায় টেনে এনেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গতিধর্মের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। সেখান থেকে তার কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরা হলো-অচেনা ঐক্য ঘিরে নতুন অনুভব কাঠামা:
যেকোনো গণ-আন্দোলনে অদেখা মানুষের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠে। এটি মানবীয় যোগাযোগের এক বিশেষ দিক। সখ্য ও পরিচিতি কম থাকে। কিন্তু এ অচেনাটা কোনো বিষয় নয়, এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতাও কোনো বাধা নয়। তারা কেবল চেনে অভিলক্ষ্য। ইস্পাত কঠিন হৃদ্যতা থাকে যেকোনো গণ-আন্দোলনে, থাকে নতুন অনুভব কাঠামো।
অনুভব কাঠামোর ধারণাটি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ তাত্ত্বিক রেমন্ড ইউলিয়াম। তিনি সংস্কৃতি ও সমাজ অধ্যায়নে বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক। তিনি মনে করেন, অনুভব কাঠামো সংস্কৃতির সকল ধরন ও বিন্যাস তৈরি করে। গণ-আন্দোলন সংস্কৃতি বিযুক্ত কোনো বিষয় নয় বরং সংস্কৃতির সঙ্গে দারুণভাবে যুক্ত।
অনুভবের ঐক্য হলো ইস্পাত কঠিন বুনন- যাকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্প্রতি বলেছেন ‘জ্বলন্ত ইস্পাত’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গড়ে উঠা ঐক্য সূক্ষ্ম একটি বুনন। এ কাঠামো বিশেষ মূল্যবোধ সংযোজিত- যাকে ভাঙা অত সহজ নয়। গণ-আন্দোলনকারীদের কাছে এ ঐক্য বা অনুভব কাঠামো ছাড়া হারানোর কিছু ছিল না। এখন এ ঐক্য কতটা ফলদায়ক হবে তা পরীক্ষার সময় এসেছে।গণ-আন্দোলন ও জনমালিকানাবোধ:
এ গণ-আন্দোলনের ওপর তৈরি হয়েছে জনমালিকানাবোধ। সবার ক্ষোভ, দ্রোহ, ভালোবাসা ও সংহতি মিলিয়ে এই গণ-আন্দোলন সার্বিকতা পেয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রিকশায় দাঁড়িয়ে যখন একজন রিকশাওয়ালা মিছিলকারীদের স্যালুট দেয় তখন বুঝতে হবে এ আন্দোলন কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না?
অথবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজলা গেটের সামনে শতাধিক রিকশাওয়ালা যখন মিছিল বের করে ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে স্লোগান দেয়- ‘‘মামা তোমাদের ভয় নাই, তোমাদের ছাড়ি নাই’’ তখন তা ভিন্ন বার্তা দেয়। এ গণ-আন্দোলনের বিশেষ দিক হলো এটি নিছক ক্ষমতার পালাবদল নয়। এটি গণতান্ত্রিক সমাজ রূপান্তরের এক বিশেষ দ্রোহ, বিশেষ প্রকাশ। এর সফলতা নির্ভর করছে আগামী দিনগুলোর ওপর। এ আন্দোলনের স্পিরিট যেন নষ্ট না হয়, লাইনচ্যুত না হয় সেটি হলো এ মুহুর্তের সবেচেয়ে বড়ো চাওয়া। কারণ আহমদ ছফা একটি বই লিখেছেন নাম ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’। বিভিন্ন কারণে, বিপ্লব অনেক সময় বেহাত হয়ে যায়।
এ আন্দোলনের যে গতিধর্ম বুঝি তা হলো রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন। এমন গণজাগরণ যত এগুতে থাকে তত পরিশীলিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে। চলতে চলতে শিখে নেয় ও শিক্ষা দেয় এ ধরনের আন্দোলন। এ আন্দোলনের ফল নিশ্চয়ই উদার ও গণতান্ত্রিক হবে এবং এই রাষ্ট্র বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কিন্তু শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের পর আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকে স্থিরভাবে বোঝা যাচ্ছে না। কিছুটা এদিক-ওদিক মনে হচ্ছে। বহুরূপিতা বেরিয়ে আসছে। ন্যায্য, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন যেন অধরা না হয়- সেটা খেয়াল রাখতে হবে। কোট সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তারপর গণতান্ত্রিক সমাজ রূপান্তরের রূপরেখায় প্রণয়েনের চেষ্টা চলছে। যার অংশীদার সংবেদনশীল, যৌক্তিক, ন্যায্যবোধসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিক। এমন জনমালিকানাবোধ-সর্বস্ব গণ-আন্দোলন পরাস্ত করা সহজ না।
যদিও সরকারি পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে এ আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রদের রাজনৈতিক ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে, ক্ষমতার আকাক্সক্ষা দেখা যাচ্ছে। দিন শেষে সবকিছুই তো রাজনীতির বিষয়। ছাত্ররা যদি রাজনীতি করে তাহলে মন্দ কী? পরিণতি তো সেই দিকে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ছাত্রদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে তো মন্দ কিছু দেখি না।অহিংস পথ সহজ নয়, সেই পথ উপেক্ষারও নয়:
এ গণ-আন্দোলন সহিংসতামুক্ত রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ, এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাগরিক সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তির সমর্থন মিলেছে। তারা যদি সত্যি সত্যি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মর্মবাণী বুঝে থাকে তাহলে অহিংস পথেই এগুতে হবে।
এ গণ-আন্দোলনের মর্মবাণীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। সহিংসতা একদম অপ্রয়োজনীয়। এ গণ-আন্দোলন অহিংস রাখতে না পারলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।গণ-আন্দোলনের ভাষা ও সৃজনশীলতা:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা ও ভঙ্গির নিজস্বতা দেখা গেছে- যা নতুন ও সৃজনশীলতায় পূর্ণ। এখানে সহিংসতা নয়, প্রতিবাদের সভ্য ও রুচিশীল প্রকাশ দৃশ্যমান। প্রতিবাদকারীদের স্লোগানের বড়ো অংশ শ্লেষ মাখানো ও ব্যাঙ্গবিদ্রুপে ভরা। উত্তর-প্রজন্ম রক্ত দিয়ে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন আঁকছে। কিন্তু ৫ই আগস্ট পরবর্তী প্রকাশে হিংসা বেড়েছে, বেড়েছে রুচিহীন প্রকাশ। শালীনতা বজায় রাখতে হবে। বিক্ষুব্ধ বা দ্রোহ মানে কোনোভাবেই উন্মক্ততা নয়।
আন্দোলন থেকে উৎসব:
ঘাত-প্রতিঘাত ও শোকের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা এ আন্দোলন উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছিল। মিছিলে, মিটিং-এ বেজে উঠেছে গান, ঢোল-বাঁশি এবং কার্নেট । রঙ-বেরঙের পোশাক, বুকে জাতীয় পতাকা নিয়ে সারিসারি মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা আশ্রয়ী হয়েছে একাত্তরের কালজয়ী গানের দেশে। অসংখ্য মজার মজার ডিজিটাল রিলে শাসকগোষ্ঠীকে হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
শোকে ও প্রতিরোধের মুহুর্তে মানুষ সেগুলো বিনোদন হিসেবে উপভোগও করছে। কিন্তু ৫ই আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন স্রোতে বইছে। এখানে কোনো নান্দনিকতা নেই, দেখা যাচ্ছে ক্লেদ আর ঘৃণার ছড়াছড়ি। ধ্বংস ও অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া জঘন্য লিপ্সা। আমজনতা কি এমন পরিস্থিতির জন্য এ গণ-আন্দোলন সমর্থন করলো। তা কিন্তু কোনোভাবেই নয়।রাস্তা যখন গন্তব্য:
প্রতিবাদকারী ছাত্ররা নিশ্চয়ই উপলদ্ধি করছে রাস্তা কত আপন। শিক্ষার্থীদের কাছে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে রাস্তা অনেক বড়ো পাঠশালা হয়ে উঠছে। শ্রেণিকক্ষ যা শেখাতে পারেনি, রাস্তা তা শিখাচ্ছে। রাস্তা হয়ে উঠছে জীবনের এক মহান পাঠাশালা। রাস্তা কেবল যানচলাচলের পরিক্ষেত্র নয়- এর বিটুমিনের পরতে পরতে থাকে অবিস্ফোরিত প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা। মানুষ বিক্ষুদ্ধ হলেই সে বুক উদোম করে দেয়। আালিঙ্গন করে। আন্দোলন-সংগ্রামে রাস্তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
যেমন, স্পেনের ক্যাটেলানিয়ার মানুষ স্বাধীনতার জন্য রাস্তায় নেমেছিল, ফরাসি বিপ্লবে রাস্তা ছিল বড়ো জনপরিসর। রাস্তা না থাকলে মুক্তি আসে না। রাস্তায় পথ দেখায়, আপন করে, সংগঠিত করে, গতি দেয়। রাস্তাকে কেবল আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সূচক হিসেবে দেখলে হবে না; এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যও বিবেচনায় আনতে হবে। মানুষ আজ সেই রাস্তা ধরেছে। যেমন, ’৭১-এ ধরেছিল মানিক মিয়া এভিনিউ ও সোহরাওয়াদী উদ্যান।বিশ্বমনে বাংলাদেশের সংযুক্তি:
তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে এ গণ-আন্দোলন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দুনিয়ায় পৌঁছে গেছে। প্রতিবাদ ও সংহতি প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে। রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন ইউক্রেনের এক বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে বিবিসির এক সাংবাদিক লাইভ করছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন- ‘‘এ বোমাবর্ষণ কেবল ইউক্রেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে না, মিডিয়ার কল্যাণে তা সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে তুলছে।’’ কোটা-সংস্কারের এ গণ-আন্দোলন কেবল বড়োদেরই প্রভাবিত করেনি, শিশুদের ওপরও গভীর অভিঘাত তৈরি করেছে এ আন্দোলন।
আমাদের উত্তর-প্রজন্ম আগামীর নিশানা:
অনেকে ভেবেছিলেন প্রযুক্তিনির্ভর যে উত্তর-প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তারা বুঝি কেবল প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মমুখী। বাইরের ঘটনাপ্রবাহ হয়তো তাদের সেভাবে স্পর্শ করে না। কিন্তু সেই অনুমিতি অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। পাবলিক-প্রাইভেট সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছে। এত উৎসর্গপ্রবণ উত্তর-প্রজন্ম আমরা পেলাম সৌভাগ্যক্রমে। কথা হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্দোলন-সংগ্রামে অংশীদারত্বের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠছে।
ন্যায়বোধহীন শিক্ষা কোনো শিক্ষা নয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করতে অক্ষম শিক্ষাও শিক্ষা নয়। শিক্ষা হলো এক গভীর অনুভুতির নাম ও বোঝাপড়ার ব্যাপার। দ্রোহী ও প্রতিবাদী চরিত্র নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছে। এটি আশার জায়গা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা এত যে প্রতিবাদী হয়ে উঠলো তার পেছনে কাজ করেছে মূলত তাদের দেখে ফেলা বৈষম্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী সকল শাসকগোষ্ঠী এ বৈষম্যের চাষ করেছেন। জনবান্ধব রাষ্ট্র গড়তে কোনো উদ্যোগ নেননি। অথচ জনবান্ধব রাষ্ট্র গড়ার অনুসরণীয় নির্দেশনা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে; সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। চাই, সবার জন্য শান্তিপূর্ণ, সহাবস্থানপূর্ণ মানবিক মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ।লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক