নাগরিক যেমন হবে, রাষ্ট্রও তেমন হবে: প্রসঙ্গ রাষ্ট্র সংস্কার
বাংলাদেশে এখন ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ শব্দগুচ্ছটি বেশ ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। বিরোধী অবস্থানে থাকা কিছু রাজনৈতিক দল অনেকদিন যাবৎ রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলে আসছিলেন। সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সে কথার থোরাই কেয়ার করেছে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। ছাত্রসমাজের এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে গেলে যেকোনো অবকাঠামো যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মজবুত করার জন্য সংস্কারের প্রয়োজন হয়, তেমনি যেকোনো আইন-বিধি বা ব্যবস্থা দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে তার ভেতরে নানা দুর্বলতা এসে যুক্ত হয়। তখন সেই বিধি বা ব্যবস্থা বাতিল করা জরুরি হয়ে পড়ে। পুরো বিধি বাতিল করা সম্ভব না হলেও তার প্রয়োজনীয় সংস্কার অবশ্যই করতে হয়। এ কথা সংবিধান থেকে শুরু করে পারিবারিক আইন- সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সময়ের প্রয়োজনে দেশের সংবিধান অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। প্রয়োজন দেখা দিলে ভবিষ্যতেও করা হতে পারে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার যে বিধি- সেগুলোও সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়েছে। সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে অনেক কিছু। রাষ্ট্র যতদিন থাকবে ততদিন এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। পরিবর্তনই চিরন্তন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস বলেছিলেন, একই নদীতে দুইবার অবগাহন করা যায় না। তার মানে দ্বিতীয়বার অবগাহন করার সময় সে নদী আর আগের নদী থাকে না।
তবে পরিবর্তনটা ইতিবাচক হওয়া জরুরি। নেতিবাচক পরিবর্তন হলে তা মানবসমাজের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইন ও বিধি-ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রাষ্ট্র সংস্কার করা যতটা সহজ সে সংস্কার অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা ততটা সহজ নয়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মনোজাগতিক সংস্কার হলেই কেবল রাষ্ট্র সংস্কারের সুফল ভোগ করা যায়। তাই মানুষের মনোজাগতিক সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার বড়ো বোন গৃহিণী। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব বেশি নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান কথা বলতে শোনা যায়। দেশের অস্থিরতার কথা শুনে তিনি প্রায়ই বলেন, শুধু রাজা ভালো হলে হবে না, প্রজাকেও ভালো হতে হবে। এখন রাজা-প্রজা নেই, রাজা-প্রজার স্থানে এখন সরকার ও জনগণ। তবে সম্পর্কটা রাজা-প্রজার সম্পর্কের মতোই আছে। সংবিধান অনুসারে জনগণ রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার উৎস বা রাষ্ট্রের মালিক হলেও জনগণ মালিকের মর্যাদা কোনোকালেই পান না। নির্বাচনের পরে উল্টোটাই সত্য হয়ে ওঠে। সরকারকেই জনগণের মালিক হয়ে যেতে দেখা যায়। এই মালিকানা ফিরিয়ে আনার জন্য আবার সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রাম করতে করতে রক্ত দিতে হয়, জীবন দিতে হয়। গণমানুষের সংগ্রামের ইতিহাস মানেই জীবন দেওয়ার ইতিহাস। কিন্তু জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের সুফল গণমানুষের ঘরে ওঠে না কখনো। বিজয়ের সুফল গড়ে তোলে নতুন শাসকগোষ্ঠী। মানবজাতির ইতিহাসে সে কথা সত্য হতে দেখা গেছে বারবার।
এই গল্পের শিক্ষাটা হলো মানুষ ভালো হয়ে গেলে রাষ্ট্রে কোনো বিচারকের প্রয়োজন পড়ে না। আবার মানুষ যদি নিজে থেকে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারী হয়ে ওঠে তাহলে সে আইন ও বিচারের ফাঁকফোকড় দিয়ে অপরাধ করেই যাবে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের সমান্তরালে নাগরিকের মনোজাগতিক সংস্কার করতে হবে। আশার কথা হলো আন্দোলনকারী ছাত্ররা সেদিকেও মনোযোগ দিয়েছে। সরকার পতনের পর ছাত্ররা মাঠ ছাড়েনি। দুষ্কৃতকারীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাস থেকে যারা গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে বিভিন্ন ধরনের মালামাল হাতিয়ে নিয়েছিল সেগুলো ফেরত আনার ব্যবস্থা করেছে। গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে শুরু করে সারা দেশে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। রাস্তার পাশের দেওয়ালগুলো পরিষ্কার করে দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় পাহারা দিয়েছে। এ সবই মানুষের মনোজাতিক পরিবর্তন প্রচেষ্টার অংশ। এ পরিবর্তন স্থায়ীরূপ না পেলে কোনো লাভ হবে না। ছাত্ররা ক্লাসরুমে ফিরে গেলে সব যদি আগের চেহারায় ফিরে আসে তাহলে এসব পণ্ডশ্রম হয়ে যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি এ পরিবর্তনটা স্থায়ী রূপ লাভ করুক। অন্তর্বর্তী সরকার এগুলোকে টেকসই করে দিয়ে যাক। ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবেন তারা যেন পরিবর্তিত ব্যবস্থায় নিজেদেরকে আত্তীকরণ করে নেয়।
নাগরিক যেমন হবে, রাষ্ট্র তেমন হবে। এ কারণে প্রথমে নাগরিকদেরকে সুনাগরিক করে গড়ে তুলতে হবে। আর সুনাগরিক করে গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুশিক্ষা। বিগত দিনগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। একটি জাতির শিক্ষা নিয়ে তামাশা করা চলে না। প্রাথমিক থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণকে সরকারিভাবে নিয়োগ দিতে হবে। অযোগ্য বা পক্ষপাতদুষ্ট ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির হাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষমতা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাসহ নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার করে যোগ্য ও মেধাবীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার আয়োজন করা জরুরি। কোথায় ময়লা ফেলতে হবে, কীভাবে রাস্তা পার হতে হবে, কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে- এগুলো শুধু মুখে বলা নয়, ব্যাবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে না পারলে তাত্ত্বিক বা তত্ত্বীয় শিক্ষা কোনো কাজেই আসবে না। সুনাগরিক হতে হলে অর্জিত জ্ঞান ব্যাবহারিক জীবনে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। গণপরিবহণে প্রবীণ ব্যক্তিকে সিট ছেড়ে না দিলে প্রচলিত আইন কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। কিন্তু নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা থাকলে একজন যুবক বিবেকের আদেশেই প্রবীণ ব্যক্তিকে সিট ছেড়ে দিয়ে বসতে দিবে। এই বিবেকের আদেশ বা বিবেকের শাসনটা খুবই জরুরি। বিবেকের শাসন কোনো আইন প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই আইনের বাইরেও এমন কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন যে কর্তৃপক্ষ সাধারণ নাগরিককে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা দিয়ে সচেতন করে তুলবে।
সরকার পতনের পর প্রশাসনের সকল স্তরে যে পরিবর্তন হচ্ছে তা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটা সাবেক সরকারের অনৈতিক অবস্থানকেই প্রমাণ করে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন তাঁর সকল প্রশাসনিক ইউনিটের সবাইকে নিয়ে একযোগে পদত্যাগ করেন তখন তো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এঁরা কোন বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ছোটোবেলায় পড়েছিলাম ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন?’ এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও হয়তো পড়ে থাকবেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের এই কথাটি নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য একটি আদর্শ শিক্ষা। অতীত যদি অন্ধকার হয় তাহলে বর্তমানকে আলোকিত করাই প্রথম কাজ হওয়া উচিত। অতীত যদি অনৈতিক ও অমানবিক হয় তাহলে বর্তমানকে নৈতিক ও মানবিক করে তোলাই উচিত। অধমকে বারবার অধম না বলে নিজেকে উত্তমরূপে উপস্থাপন করি। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব সততা, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন করি। তাহলেই আসবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য নাগরিকের মনোজাগতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নাগরিকরাই মূলত রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তাই নাগরিক বা গণমানুষ আদর্শনিষ্ঠ ও মানবিক হয়ে উঠলে রাষ্ট্রও সেদিকেই অগ্রসর হবে।আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়