অপহরণ-আটকে রেখে নির্যাতন: শেখ হাসিনাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলায় যেসব অভিযোগ
অপহরণ করে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলায় র্যাবের অজ্ঞাত আরও ২৫ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরীর আদালতে এই আবেদন করেন ভুক্তভোগী আইনজীবী সোহেল রানা।
মামলায় ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানাকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বাদী সোহেল রানা তার মামলার আবেদনে উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত কাজে তার বন্ধু মো. আশরাফুল ইসলাম রিংকুর সঙ্গে মোটরসাইকেলযোগে উত্তরার ৫নং সেক্টেরের ১নং রোডে স্মাইল গ্যাল্যালির সামনে অবস্থানকালে রাত আনুমানিক ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে একটি ছাই রঙের হাইএস গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। গাড়িতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) স্টিকারযুক্ত পোশাকে দুইজনকে গাড়ির ভিতরে দেখতে পান। সেখানে আর ১০-১১ জন বন্ধুকধারী ব্যক্তি ছিলেন যাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে অনুধাবন করতে পারেন বাদী।
বাদী ও তার বন্ধুকে হইএস গাড়িতে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুকধারী ব্যক্তিরা তাদের চোখ শক্ত করে বেধে পিছমোরা করে হাতে হাতকরা পড়িয়ে বাদীর সঙ্গে থাকা মোবাইলসহ সিম ও মানিব্যাগ নিয়ে নেয় এবং বাদীর কোমরের বেল্ট এবং প্যান্ট খুলে পুরুষাঙ্গে ক্লিপ জাতীয় কিছু লাগিয়ে কারেন্টের শক দিতে থাকে। আর্তচিৎকার যেন বাইরে থেকে শোনা না যায় সে জন্য গাড়িতে উচ্চ শব্দে ডিজে টাইপের গান চালিয়ে রাখে। একপর্যায়ে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে গাড়ির গতি খানিক কমিয়ে বাদীর বন্ধুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। ঘণ্টা খানেক গাড়িতে নির্যাতন চালানো অবস্থায় বাদী বুঝতে পারেন হাইএস গাড়িটি বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির পর কোনো একটা বিল্ডিং এর আন্ডার গ্রাউন্ডে প্রবেশ করেছে এবং বাদীকে চোখ বাঁধা অবস্থায়ই গাড়ি থেকে টেনেহিচড়ে নামানো হয়।
সেখানে একজন নতুন ব্যক্তি বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এসময় অকথ্য ভাষায় বেগম খালেদা জিয়াকে গালমন্দ করে আর বলতে থাকে, ‘এমন চরিত্রহীন মহিলার দল করছ আর তোরা সরকার উৎখাত করবি’। এসব বলে আগের মতোই উচ্চ মাত্রার বৈদ্যুতিক শক বাদীর পুরুষাঙ্গে এবং কানের লতিতে লাগানো ক্লিপের মাধ্যমে দেওয়া শুরু করে। তারও ঘণ্টাদুই পর একজন ব্যক্তির নির্দেশে অন্য আরও তিন থেকে চারজন ব্যক্তি বাদীর দুই হাত রশির সাহায্যে বেঁধে উপরের দিকে ঝুলিয়ে কোমর থেকে পা পর্যন্ত লাঠি অথবা শক্ত কোনো বস্তু ধারা বারবার আঘাত করতে থাকিলে বাদী সাময়িক সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়া পড়েন। যখন জ্ঞান ফিরে তখন তিনি বুঝতে পারেন, চোখ বাধা এবং হাত পিছমোরা করে হাতে হাতকরা লাগানো অবস্থায় বাদী মেঝের উপর পড়ে আছেন। এ অবস্থায় ফুটন্ত গরম পানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। এসময় একজন ব্যক্তি অন্য একজনকে বলছিলেন, যদি কোনো উত্তর সঠিকভাবে না দেয় তাহলে পায়ুপথে যেন গরম পাথর প্রবেশ করানো হয়।
এরপর ঐ ব্যক্তি ফেসবুকের পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয়। পুনরায় কারেন্টের শক দিতে থাকে এবং বলতে থাকে, তোকে মেরে ফেলার নির্দেশ আছে। বাদী আর সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যখন জ্ঞান ফিরে তখন তৃতীয়বারের মতো একজন ব্যক্তি ‘বাদীর পরিবারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, সামরিক বাহিনীতে কোনো আত্মীয়-স্বজন কর্মরত আছেন কি না’ জিজ্ঞাসা করে চলে যায়।
বাদীর উপর অমানবিক অত্যাচারের কারণে বাদীর কোমরের নিচের অংশের কোনো স্নায়ু কাজ করছিল না। একপ্রকার অবশ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় দুইজন ব্যক্তি তাকে ধরে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যান। ওই কক্ষে বাদীকে হাতকরা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় দুই দিন রাখা হয় এবং অল্প পরিমাণ পানি ছাড়া কোনো প্রকার খাবার দেওয়া হয়নি। তাকে আটকের আনুমানিক তৃতীয় দিন হাতকরা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গেলে বাদী চোখে বাঁধা কাপরের নিচ থেকে খানিক দেখতে পান যে, কক্ষটিতে ছোট ছোট অনেক খুপরী যা সবুজ কাপর দ্বারা বেষ্টনী করা এবং ওই কক্ষে বাদী আরও অনেক বন্দী মানুষের উপস্থিতি আছে বলে বুঝতে পারেন।
আটকের শুরু থেকেই ভুক্তভোগীর দুচোখ বাধা অবস্থায় থাকলেও ওই কক্ষে থাকা অন্য বন্দীদের গোঙানি, হাঁচি-কাশিসহ নানা আর্তনাদের আওয়াজ শুনতে পান। এছাড়া ট্রেন চলাচলের আওয়াজ, ট্রেনের হুইসেল, বিমান চলাচলের আওয়াজ শুনিতে পেতেন।
সেখানে বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে ধরে আনলে তাকে নির্যাতনের আর্তচিৎকারও শুনতে পান।
মামলার আবেদনে নির্যাতনের বর্ণনায় বাদী আরও বলেন, বাদীকে সারাদিনে শুধু এক বার বাথরুমে যেতে দেওয়া হেতো। সবসময় তার চোখ বাধা অবস্থায় ছিল এবং দুই হাত পিছমোরা করে হাতকরা লাগানো অবস্থায় থাকত।
২০১৫ সালের ৬ জুন দুপুরে জোহরের নামজের পর বাদীকেসহ আরও কয়েকজন বন্দীকে গাড়িতে করে আনুমানিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার দূরত্বে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে দ্বিতীয় অজ্ঞাত অবস্থান থেকে আনুমানকি ১৩ আগস্ট ভোর ৩-৪টার দিকে বাদীকে সিঁড়ি দিয়ে একটা গাড়িতে তোলা হয় এবং প্রায় আধা কিমি. দূরে নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।
এর মিনিট খানিক পরে গাড়ি স্টার্ট হওয়ার আওয়াজ পায় এবং অতিকষ্টে হাত ও চোখ খুলে বাদী আর চোখে কিছু দেখিতে পারছিলেন না। দীর্ঘ ৬ মাস ৩ দিন চোখ বাঁধা থাকায় বাদীর চোখ খুলে তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিল। অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আবারও বাদীর দৃষ্টি ঝলসিয়ে উঠল।
এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হলে এলাকার স্থানীয় একজন লোক বাদীকে দেখতে পেলে কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে তিনি ঢাকা যাবেন এবং ঢাকা যাওয়ার রাস্তা কোনো দিকে জিজ্ঞেস করলে ওই ব্যক্তি বলেন, এটা ভারতে যাওয়ার রাস্তা। তিনি বাদীকে ঐ রাস্তার বিপরীতে ভ্যান গাড়িযোগে রাজশাহীর গোদাগাড়ির একটি বাজারে যেতে বলেন। পরে তিনি ঢাকার গাড়িতে করে তার শ্বশুরের বারিধারার বাসায় আসেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, শেখ হাসিনার হুকুমে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমদের নির্দেশে অন্য আসামিরা দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য দেশে গুমের নামে অপহরণ এবং বিনা বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং বাদী নিজেই এ নিপীড়নের শিকার।
(ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/এফএ)