ঘটনার ভিডিও দেখিয়ে রেনু হত্যার রায় ঘোষণা
গণপিটুনির নামে হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে: আদালত
গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বহুল আলোচিত ঢাকার বাড্ডায় ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি দিয়ে তাসলিমা বেগম রেনু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ মোরশেদ আলম একথা বলেন।
রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, “এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি। এ মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ফুটেজ, এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ। আমি দেখাতে চাই। এরপর আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদতে দেখা যায় রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে।
এর মাঝে বিচারক বলেন, “আসামি আবুল কালাম কে?”
তখন হাত তোলেন আবুল কালাম। বিচারক বলেন, “দেখছেন আপনাকে।” আবুল কালাম বলেন, দেখা যায়নি।”
কামালকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, “আপনি দেখেন তো কি করছেন।”
কামাল বলেন, “আমি সবাইকে বলেছি থামো। দয়া করে থামো। শোনো সে কি বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।”
এরপর বিচারক বলেন, “তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে।”
আসামি হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, “দেখবে তোমাকে চিনতে পারো কি না?”
ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, “বেশির ভাগই একজন মেরেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ নেই। আসামি রিয়া ও হৃদয় ছেলেধরা গুজব ছড়ায়। আজাদের নেতৃত্ব ও নির্দেশে ২য় তলা থেকে বোরখা পরা মহিলাকে টেনেহিঁচড়ে নামায়। এসময় রিয়া ডিজিস্টের (রেনু) চুল টানাটানি করে। স্কুলের মাঠে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলে কামাল মাথায় চাপ দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আসাদ ঘুষি মারে। হৃদয় কাঠের লাঠি দিয়ে পেটায়। পেটাতে পেটাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে যায়। বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার পেটায়। হৃদয় নির্দয়, নির্মমভাবে পেটায় মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু তার মাঝে ছেলেধরার কোনো আলামত বা পরিস্থিতি ছিল না। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র। আসামিরা নিষ্ঠুরভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্দোষ প্রমাণে তাকে কোনো সুযোগ দেয়নি। বাঁচার আকুতি উপেক্ষা করে। আঘাতের তীব্রতা এতো বেশি ছিল, ঘটনার দিনই সে মারা যায়।
বিচারক আরও বলেন, কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায় আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, উরু ও পায়েসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকেন। রেনুকে হত্যা বিভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে রেনুকে হত্যা করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
বিচারক বলেন, আসামি ইব্রাহিম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছেন এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছেন। নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নাই, কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধ সংগঠনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংগঠিত অপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়। বর্ণনা দিতে দিতে এক পর্যায়ে বিচারক কেঁদে ফেলেন। বর্ণনা শুনে আদালতে উপস্থিত আইনজীবী, সংসাদ কর্মী, আদালতের কর্মচারী- সকলের চেখের কোণে পানি চলে আসে।
শেষে বিচারক বলেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
এরপর তিনি আসামিদের দণ্ড ঘোষণা করেন।
(ঢাকাটাইমস/৯অক্টোবর/আরজেড/এফএ)