২০ বছরে পদার্পণ ঐতিহ্যের ধারক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের

২০ অক্টোবর- ঐতিহ্যে মুখরিত পুরান ঢাকায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব অল্প সময়ে গড়ে তুলেছে বেশ গৌরবময় বিভিন্ন অর্জন। মূলত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু জগন্নাথ কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে।
শিক্ষা, ঈমান, শৃঙ্খলা এই নীতিবাক্যকে ধারণ করে ১৯ বছর ধরে নিজ স্বাক্ষরতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০০৫ পাশের মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়।
ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) আজকের মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর পূর্বনাম জগন্নাথ কলেজ। ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ১৮৭২ সালে নাম বদলে রাখা হয় জগন্নাথ কলেজ।আর এই নামটি রাখা হয় মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী এর বাবার নামে।
১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই কলেজটি ১৮৮৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত করা হয়। ১৯৬৮ এই কলেজটিকে সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছরই আবার বেসরকারিকরণ করা হয়।
১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হয় তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই-পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী, ৯৬০ জন একাডেমিক কর্মী, ৮৫০ জন প্রশাসনিক স্টাফ এর সমন্বয়ে মোট ৬ টি অনুষদের অধীনে ৩৬ টি বিভাগ ও ২ টি ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমে তাদের শ্রেণি কার্যক্রমপরিচালনা করছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে নানারকম মহান ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু ইতিহাস। জবি ক্যাম্পাসে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া সেই গৌরবময় ইতিহাসকেই নির্দেশ করে। সম্প্রতি স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশন র্যাঙ্কিং-২০২২ এর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রসায়ন বিষয়ক গবেষণা সূচকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার দিকে অধীর জোর দিচ্ছে এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছে ইমদাদুল হক। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. এ. কে.এম সিরাজুল ইসলাম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০ বছরের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ১৬ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে আঁকড়ে ধরে আছে নানারকম সীমাবদ্ধতা। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সীমাবদ্ধতা গুলো কাটিয়ে উঠবার জন্য তৈরি হচ্ছে নানারকম রূপরেখা।
২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এক আনন্দ ও উল্লাসের দিন। ২০২০ সালে এই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল উদ্বোধন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় এর জন্য এক অধীর আগ্রহের একটি দিন। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী সকলেই প্রতিবছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সাথে চলে আসে সেই বিশ্ববিদ্যালয় এর পূর্ববতী সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি খুবই ছোট একটি ক্যাম্পাস, আবার এই ক্যাম্পাসের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলালেই দেখা মেলে নানারকম অন্তরায় এর। তবুও ক্যাম্পাসটিতে একটু উৎসব আমেজ যেন লেগে থাকে মাসব্যাপী। উৎসব শেষ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের প্রাণের জোয়ার কাটে না বরং আরো শক্ত হয়। উৎসবের রেশ ও কাটে না, লেগে থাকে প্রতিটি তরুণ শিক্ষার্থীর মনে।
জবি দিবসে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ যেন পুরো পাল্টে যায়। চারদিকে শুধু উৎসবের আমেজ, চারপাশে তাকালেই দেখা যায় মেয়েদের গায়ে রঙ- বেরঙের শাড়ি, ছেলেদের গায়ে রঙিন পাঞ্জাবী। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মুখে একরাশ হাসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যেন প্রাণ ফিরে পায় এই দিনটিতে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় সেজে ওঠে এক অপরূপ সাজে। আর এই সৌন্দর্যের কাজে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বেশ কিছুদিন পূর্বে থেকেই শিক্ষার্থীরা তাদের কাজে লেগে পরে। হাসিমাখা মুখ রঙ, পেন্সিল কিংবা রঙিন কাগজ নিয়ে; তাদের এদিক-সেদিক ছুটে চলা। উদ্দেশ্য একটিই নিজ ক্যাম্পাসকে অপরূপা হিসেবে সাজানো। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের দিন দেখা যায়, সেই সৌন্দর্যে মুখরিত হয়ে থাকে পুরো ক্যাম্পাস। কোথাও কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত, কোথাও বন্ধুদের সাথে হাসিতে মেতে উঠেছে শিক্ষার্থীরা, আবার কোথাও কেউ উপভোগ করছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গুলো। এই দিনটিকে শিক্ষার্থীরা খুবই আনন্দের সাথে উপভোগ ও পালন করে। সকল শিক্ষার্থীর খুব শখের ও আকাঙ্ক্ষার দিন এটি।
জবি দিবস কেবলমাত্র বর্তমান শিক্ষার্থীদের আনন্দের কোনো দিন নয় বরং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ও দেখা যায় এই আনন্দে গা ভাসাতে। তারা কেউ কেউ পুরোনো বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসে এই দিবস উপভোগ করতে, আবার কেউবা ছুটে আসে নিজ পরিবারের সাথে। অনেকসময় দেখা মেলে কোনো প্রাক্তন বা বর্তমান শিক্ষার্থী তার পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যটিকে জানাচ্ছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প, ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে অপরূপা সাজে সেজে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির সৌন্দর্য।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারের জবি দিবস পালনের চিত্রটি হবে ভিন্ন। জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে এবার উদযাপন করা হবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'বিপ্লবে বলীয়ান নির্ভীক জবিয়ান'। জুলাই বিপ্লব ও শহীদদের চেতনাকে ধারণ করে অনুষ্ঠিত হবে সভা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও বরণ করে নেওয়া হবে এই দিনটিতে। তাই নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীদের ও এই দিনটিকে কেন্দ্র করে উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি নেই। জবি দিবস জানান দেয় জবিয়ানদের অস্তিত্বের। আর এই অস্তিত্ব ও ইতিহাসের পিছু ধরেই সামনের দিকে ও উচ্চ শিখরে এগিয়ে যেতে চায় জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে এবছরও গৃহীত হয়েছে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সারা দিনব্যাপী করা হয়েছে নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন। উক্ত দিনে জবির উপাচার্য মহোদয় সকাল ৮.০০ ঘটিকায়; জবি শহীদ মিনার চত্বরে জাতীয় পতাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে জবি দিবসের অনুষ্ঠানিকতা শুরু করবেন। তারপর একে একে সকাল ১০.৩০ ঘটিকায় জবি মুক্তমঞ্চে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম। সকাল ০৯:০০ টা থেকে শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চারুকলা প্রদর্শনী ও চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠান।
অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আনন্দ র্যালি শেষে বেলা ১১.৩০ ঘটিকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষনা ফলক উন্মোচন করা হবে (পুনঃস্থাপনা)। ঘোষণা ফলক উন্মোচন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ রেজাউল করিম। পরবর্তীতে বেলা ১১:২০ ঘটিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম দিবস উপলক্ষ্যে নবীন শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয়ভাবে মুক্তমঞ্চে স্বাগত জানানো ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর বেলা ১:২৫ ঘটিকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্বরণে ও আহতদের সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এরপর ক্রমান্বয়ে বিকেল ৩.০০ টা থেকে জুলাই বিপ্লব-২০২৪ এর থিমকে ধারণ করে মুক্ত মঞ্চে; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও জবির বিভিন্ন সংগঠনের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সকল কার্যক্রম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি ছোট ক্যাম্পাসে আবদ্ধ এক বিশাল প্রাণের জোয়ার। মাত্র ৩০ একর জমির ওপর নির্মিত এই ক্যাম্পাসটিতে যেকোনো আয়োজন এক অন্যরকম আমেজের সৃষ্টি হয়। আর এখন আমেজ যখন দিবস নিয়ে তাই এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মুখের জন্য এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস।
সাফা আক্তার নোলক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন