পিপির ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ নিয়ে আদালতে হট্টগোল, আইনজীবীকে মারধর, ‘এই পরিবেশ’ নিয়ে যা বললেন আমু
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ড শুনানিতে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন- এমন মন্তব্য করায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর আইনজীবীকে আদালত থেকে মারধর করে বের করে দিয়েছেন বিরোধী আইনজীবীরা। এ ঘটনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আদালত আমির হোসেন আমুর বক্তব্য জানতে চান। আমু তখন আদালতের ‘এই পরিবেশ দেখে’ দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, “এই পরিবেশে কিছু বলা উচিত নয়।”
এছাড়া আদালতে আরও কিছুক্ষণ কথা বলেন আমির হোসেন আমু, যদিও সেসব মামলার বিষয়ে বক্তব্য নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমুর ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিপ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন।
শুনানিকালে তদন্ত কর্মকর্তার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করে আমুর বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দেন।
শুনানিতে ফারুকী বলেন, “আমির হোসেন আমু ১৪ দলের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও সমন্বয়ক। তিনি কখনো চিন্তা করেননি হেলমেট পরে, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ক্ষমতায় থাকার আমরণ ট্যাবলেট খেয়েছিলেন বলে মনে করতেন। কিন্তু বিধাতা তা মানেননি।”
ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “তিনি (আমু) সবকিছু ঠিক করে দেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবকে বুঝিয়ে বাকশাল কায়েম করেন। দল থেকে সিরাজুল ইসলাম, আ স ম রবদের বের করতে আমু-তোফায়েলের ভূমিকা ছিল। তাদের কারণে স্বাধীনতার পর দেশে জনগণের মধ্যে বিভাজন বিরাজ করে। তারা শেখ মুজিবকে স্বৈরাচার করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। এক দলীয় বাকশাল কায়েমের মূল হোতা আমু-তোফায়েল। বাংলার বাণী পত্রিকা ছাড়া আর কোনো পত্রিকা বের হতো না। জাসদ রাজনীতি করতে না পেরে অভ্যন্তরে চলে যায়। সিরাজ শিকদার বাম রাজনীতি করতেন। তাকে হত্যা করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হয়। এরপর কী ঘটে সবাই জানে। তবুও ষড়যন্ত্র থেমে নেই।”
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, “১৯৯১, ৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে ক্ষমতার একটা পালাবদল চলে আসছিল। এরপর কী এমন হলো ১৫ বছর ভোটবিহীন থাকতে হবে। বাপকে যেভাবে বিপথে নিয়েছে, মেয়েটাকেও সেভাবে নিয়েছে আমু-তোফায়েলরা। হাসিনাকে বোঝাতেন, যতদিন বেঁচে থাকবেন ক্ষমতায় থাকবেন। ফ্যাসিস্ট তৈরিতে তাদের ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার লোক খুন, গুম হয়েছে। অনেকে দেশে থাকতে না পেরে মালয়েশিয়াসহ ইউরোপে চলে গেছে। দেশের স্বাধীনতা অন্যের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে। দেশের রাজনীতি নষ্ট করার কুশলীদের একজন আমু।”
তিনি আরও বলেন, “ছাত্র আন্দোলনের সময় তারা গণভবনে মিটিং করেন। যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের গাজায় যেভাবে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়, আন্দোলনকারীদের ওপরও এভাবে গুলি চালায়। গত ৫ আগস্টের পর তার এলাকা ঝালকাঠিতে নিপীড়িত জনতা তার অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরেছে। নিপীড়িত মানুষ তার বাড়িতে আগুন দেয়। সেখানে পাঁচ কোটি টাকা পাওয়া যায়।”
ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “(আমু) টাকার জাজিম বানিয়ে ঘুমাতেন। যেখানে যেতেন স্বর্ণের নৌকা ছাড়া উপহার নিতেন না। দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন। তার সহযোগীরাও পালিয়ে আছেন। হয়তো আস্তে আস্তে বের হয়ে আসবেন। তাদের শাস্তি হোক। তাহলে আর ফ্যাসিস্টের জন্ম হবে না।”
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর আমির হোসেন আমুর পক্ষে আইনজীবী স্বপন রায় চৌধুরী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন।
শুনানিতে এই আইনজীবী বলেন, “পিপির বক্তব্যে আমি আনন্দিত। তবে এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক মঞ্চে দিলে ভালো হতো।”
স্বপন রায়ের এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হন বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের অপর প্রসিকিউটরা। তারা তাকে (স্বপন) ডায়াসের সামনে থেকে টেনেহেঁচড়ে আদালতের বাইরে নিয়ে যান। বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই আইনজীবী দরজার সামনে পড়ে যান। তখন তাকে লাথি মারা হয়। এরপর কয়েকজন আইনজীবী তাকে তুলে আদালত থেকে বের করে দেন। এসময় আদালতের মধ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। পরিবেশ শান্ত হলে আমুর পক্ষে অন্য আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। এরপর আদালত আমুর বক্তব্য শুনতে চান।
আমির হোসেনন আমু আদালতে বলেন, “আমি একজন আইনজীবী। আমি ঢাকা বারের সদস্য, হাইকোর্ট বারের সদস্য। এখানকার পরিবেশ দেখে দুঃখিত। এই পরিবেশে কিছু বলা উচিত নয়। মামলা চলবে, ভবিষ্যতে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করব। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনেক কথা বলেছেন। আমি একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গেলে দুই ঘণ্টা লেগে যাবে। আমরা একে অপরের ভাই ভাই। মিলেমিশে থাকা উচিত। আমরা এক সঙ্গে থাকব। কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো? আশা করছি, এ পরিবেশ থাকবে না।”
তখন বিএনপির আইনজীবীরা চিৎকার শুরু করেন। তারা বলেন, তিনি (আমু) ভয় দেখাচ্ছেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষের পিপি আইনজীবীদের শান্ত করেন।
এরপর আমু বলেন, “আমরা যার যার পক্ষ অবলম্বন করব। নিজেরা নিজেরা কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো।”
এরপর পিপি ফারুকী বলেন, “যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন তখন কি খবর নিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা বারের। আইনজীবীরা তো ভালোই ছিল। কিন্তু নির্বাচনের সময় সিল মেরে ভোট নিয়ে গেছে, আইনজীবীদের মারধর করেছে। তখন তিনি কী ভূমিকা নিয়েছিলেন?”
এর জবাবে আমু বলেন, “প্রথমবার যখন গোলমার হয় আমি এর বিরোধীতা করি। ভোট দিতে আসিনি, বয়কট করেছি।”
এরপর আদালত আমির হোসেন আমুর ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
(ঢাকাটাইমস/০৭নভেম্বর/এফএ)
মন্তব্য করুন