প্রতিহিংসার রাজনীতি, মামলা-বাণিজ্য এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
![](/assets/news_photos/2024/12/31/image-375969.jpg)
মামলার কথা এলে অবধারিতভাবে আদালত ব্যবস্থার কথা মনে পড়ে। কিন্তু মামলা মানে শুধু আদালত নয়, বাদী-বিবাদী, ভুক্তভোগী ও আইনজীবীর পাশাপাশি প্রতিহিংসার দলীয় রাজনীতি, সুযোগসন্ধানী উকিল, মামলাবাজ মক্কেল ও অসাধু পুলিশের ছবিও চলে আসে। মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানান ছকে রাজনীতিবিদ নামধারী কিছু মানুষের মিথ্যা উক্তিতে মামলা দেওয়ার প্রবণতা এখন খুবই দেখা যায়। বেড়েই চলেছে এসব মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমা । চলছে রমরমা মামলা-বাণিজ্য। এর সঙ্গে কারা জড়িত, কেন জড়িত, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে বিচার বিভাগের দায় ও ভূমিকা কী, তা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব এই নিবন্ধে।
মোটা দাগে মামলা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে কিছু রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবী একটা গোষ্ঠী। মামলা-বাণিজ্য প্রতিরোধ একেবারে শুরু থেকে কাজ করতে হবে। একটা মামলা রুজু হয়ে গেলে সেটা নিষ্পত্তি হতে আইনি প্রক্রিয়ায় এগুতে হয়। তাই বিচার ব্যবস্থার ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই।
বাড়িতে গিয়েছিলাম শীতকালীন ছুটিতে। এক চাচা, বয়স ষাটোর্ধ্ব, তিনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে আসেন আইনি পরামর্শ নিতে। কাগজপত্র দেখানোর আগে বললেন, ‘জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় সৌদি আরবে হজে ছিলাম। আগস্টের ১৪ তারিখ বাড়িতে আসি। তার আগে দেশ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা ফেঁসে গেছি।’
কীভাবে ফেঁসে গেলেন জিজ্ঞেস করতে চাচা জানান, তার ও ছেলেদের নামে আদালতে ও থানায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। দুটো হত্যা মামলা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে মামলা করার ধুম পড়ে যায়। স্থানীয় নেতারা পূর্বশত্রুতার জেরে এসব মামলায় আসামি বানিয়ে দিয়েছে তাদের। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আপোষের প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে।
মামলা-বাণিজ্য এখন গ্রাম-শহর সর্বত্র। আইনসংশ্লিষ্টরা দিশেহারা। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না তা। শুধু এই আমলে নয়, পতিত হাসিনা সরকারের আমলে মিথ্যা মামলার প্রবণতা ছিল আকাশচুম্বী। বলা যায় হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা বা বিরোধী দল দমনে নাশকতার মামলা দায়েরে এক নম্বরে ছিল বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার।
কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের স্পিরিট অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ছিল সুনির্দিষ্ট অপরাধ ছাড়া মিথ্যা মামলা বা হয়রানিকর মামলা হবে না। কোনো মামলা-বাণিজ্য চলবে না বা কেউ মামলা-বাণিজ্য করতে চাইলে ছাত্র-জনতা তা রুখে দেবে। মোটা দাগে বলা যায়, এ যাত্রায় তা হয়নি। বরং মামলা-বাণিজ্যের পারদ ঊর্ধ্বমুখী।
চাচাকে জিজ্ঞেস করি, মিথ্যা মামলা হচ্ছে কেন? চাচার উত্তর ছিল জমিজমা নিয়ে পূর্বশত্রুতা। কোনো এক সময় ঝগড়া হয়েছিল। বাদীপক্ষকে কাজে লাগিয়ে নেতা গোছের কিছু লোক প্রতিটি এলাকায় মামলা বাণিজ্য করছে। যাকে-তাকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করছে তারা। পাশাপাশি টাকা-পয়সা নিয়ে আপোষ-মীমাংসার জন্য চাপ দিচ্ছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধে মামলা হলে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু নিরপরাধ কেউ মামলায় জড়িয়ে যাক তা চাই না।
মূল কথায় আসি। হয়রানিমূলক মামলা হওয়ার পেছনে পূর্বশত্রুতা অনেকাংশেই দায়ী। পূর্বশত্রুতা রাজনৈতিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েরও হতে পারে। কেউ কারও ঈর্ষা থেকেও স্থানীয়ভাবে মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক শত্রুতাবশত মামলা-বাণিজ্য চলছে হরহামেশা। এর সাথে জড়িত পাড়ামহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন বা থানার বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা নেতাকর্মীরা। এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বা চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় রাজনীতিতে এখন যারা সক্রিয় তাদের অঙ্গসংগঠনের লোকজন।
এটাও অনেকে বলছেন যে বিএনপি এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ায় সেটার প্রতিশোধ নিতে চাইছেন এখন। প্রতিশোধ হিসেবে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে জব্দ করা হচ্ছে প্রতিপক্ষকে। জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের কিছূ নেতা নেতাকর্মী মিথ্যা মামলা দায়ের করতে তথাকথিত উকিল নামধারী আইনজীবীর সহযোগিতায় পিটিশন লিখে মামলা দাঁড় করাচ্ছে। পরবর্তীতে কিছু অসাধু পুলিশের সহযোগিতায় থানায় ও আদালতে মামলা-বাণিজ্যের মহোৎসব করছে, যা ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং করছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা, অন্যায়ভাবে জেলে আটকিয়ে রাখা, নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, ওপরের নেতার মনোযোগ আকর্ষণে মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে বলে রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আবার ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেও মামলা বাণিজ্য হচ্ছে।
সম্প্রতি মাননীয় আইন উপদেষ্টা দেশে মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এবং কীভাবে ভুয়া মামলা ও মামলা-বাণিজ্য ঠেকানো যায়, সে বিষয়ও তুলে ধরেন। কারা মামলা-বাণিজ্য করছে এবং কেন করছে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন মাননীয় উপদেষ্টা।
বিচার ব্যবস্থা বলতে সাধারণ অর্থে বাংলাদেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচারকে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান আইন-কানুন ব্যবহার করে বিচার বিভাগ পরিচালিত হয়। বিচার প্রক্রিয়ায় নানা অনুষঙ্গ বা উপাদান থাকে। সরকার চলে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। বর্তমানে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকলেও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছে, যাদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার। বিগত আমলে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারের কারণে কার্যকরতা হারানো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব তা সময়ই বলে দেবে। সে পর্যন্ত ছাত্র-জনতার উচিত হবে কেউ যেন মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করে এবং মামলা-বাণিজ্য করার সুযোগ না পায় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া।
যাই হোক, বৃদ্ধ চাচাকে যে আইনি পরামর্শ দিয়েছিলাম মিথ্যা ও হয়রানিকর মামলা থেকে বাঁচতে, সেটা পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি।
মিথ্যা মামলা হলে যা করবেন
প্রথমে মামলাটি থানায় নাকি আদালতে হয়েছে তা জেনে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আইনি সহায়তা নিতে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার কপি সংগ্রহ করতে হবে।
তৃতীয়ত, জামিনের বিষয় অগ্রগামী হওয়া; যেমন মামলা জামিনযোগ্য হলে নিম্ন আদালতে জামিন চাইতে হবে, নয়তো উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে।
চতুর্থত, আদালতে হাজিরা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট তারিখে হাজিরা দিতে হবে, না হলে জামিন বাতিল হতে পারে।
মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করতে এজাহারের কপি সংগ্রহ করতে হবে। থানায় মামলা হলে এজাহারের কপি সংগ্রহ করে আইনজীবীর সাথে আলোচনা করুন এবং জেলা আদালতে জামিন চাইতে পারেন।
অতঃপর চার্জশিট হলে জেলা বা উচ্চ আদালতে জামিন চাইতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে হবে।
যদি গ্রেফতার হয়ে থাকেন, তাহলে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে জামিনের আবেদন করতে হবে।
পঞ্চমত, এরপর আসে আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের বিষয়। আদালত থেকে সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেলে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে।
মিথ্যা মামলা ও সাক্ষ্যের শাস্তি
মামলা-বাণিজ্যের ইতিহাস দেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। প্রতিপক্ষকে দমন করার হাতিয়ার হলো মামলা-বাণিজ্য।
মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তি কী তা অনেকে জিজ্ঞেস করে থাকেন। মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ২১১ ধারামতে মিথ্যা মামলার জন্য দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। মিথ্যা মামলায় যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তাহলে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে।
কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া দুনিয়ার আইনে শুধু নয় সৃষ্টিকর্তার আইনেও মারাত্মক পাপ। মিথ্যা ও হয়রানিকর মামলা-মোকদ্দমার সাথে জড়িত বাদী ও সাক্ষী পরকালে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে বলে কোরান-হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য দেশীয় আইনেও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন হলে, পৃথক প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু হলে এবং স্বতন্ত্র তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আলাদা পুলিশিং সিস্টেম কার্যকর হলে হয়রানিমূলক মামলা কমবে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার করা অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তো হবেই, পাশাপাশি মামলা-বাণিজ্য কমাতে প্রতিহিংসার রাজনীতি রোধ করতে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। মিথ্যা মামলা করা হয়েছে প্রমাণিত হলে শাস্তিসহ বিদেশের বিচার ব্যবস্থার মতো অধিক জরিমানা আরোপ করতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: পিএইচডি ফেলো, আইন গবেষক ও কলামিস্ট।
(ঢাকাটাইমস/৩১ডিসেম্বর/মোআ)
![google news](https://www.dhakatimes24.com/templates/web-v3/images/google-news.png)
মন্তব্য করুন