আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: সাম্প্রতিক জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ) কর্তৃক জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন। ১. বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ICT Act 1973 অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই ট্রাইব্যুনাল জুলাই-আগষ্ট ২০২৪ এর বিপ্লব পরবর্তীতে মূলত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার নিয়ে কাজ শুরু করে। ট্রাইব্যুনালের কর্ম পরিধিতে প্রথমত গুম সংক্রান্ত বিচার না থাকলেও পরবর্তীতে তা যুক্ত করা হয়। এছাড়াও ICT Act এর বিচার পরিধিতে পূর্বে তিন বাহিনী না থাকলেও পরবর্তীতে নভেম্বর ২০২৪- এ আইনটি সংশোধন করে তিন বাহিনীকে এর আওতাভুক্ত করা হয়। এবং ২০০৯ সাল হতে আইনটি ভূতাপেক্ষীভাবে কার্যকর দেখানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, কোন আইন হঠাৎ সংশোধন করে তা ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকরী করার বিষয়টি কোনভাবেই আইনসম্মত নয় (যেমনঃ বিডিআর বিদ্রোহের পর বিডিআর আইন সংশোধন করে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়)। আইন সংশোধনের পূর্বে কোন সামরিক বাহিনীর সদস্য এই অপরাধে জড়িত থাকলে তার বিচার সেনা আইনে করাটাই কি যৌক্তিক ও আইনসম্মত নয়?
২. বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী একমাত্র খুন ও ধর্ষণ ছাড়া সেনাসদস্যদের অন্য সকল অপরাধ সেনা আইনে বিচার করার বিধান রয়েছে। ফলে যারা বর্তমানে আর্মি অ্যাক্টের আওতাধীন (চাকুরীরত/ LPR ভোগরত) তাদের বিরুদ্ধে আনীত গুমের অভিযোগ সেনা আইনে বিচার করা হবে নাকি আইসিটি অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী?
৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাতে ১২ জনের মাঝে সেনাবাহিনীর ৯ জন এবং তার মাঝে DGFI- এর DG ৭ জন। উল্লেখ্য, গুম কমিশনে গৃহীত ১,৬৭৬ টি অভিযোগের মাঝে উক্ত কমিশন ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৭৫৮টি কেস ভালোভাবে পর্যালোচনা করেছে। উক্ত পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে অদ্যাবধি গুমের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থাসমূহের (যেমন: RAB, DB, CTTC, DGFI, ইত্যাদি) মাঝে DGFI এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম সংখ্যক অভিযোগ গৃহীত হয়। অথচ অন্যান্য সংস্থার জড়িত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক শুধুমাত্র DGFI- এর DG দের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। জারিকৃত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ স্পষ্ট। তাদের অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন যে এই পরোয়ানা হয়রানিমূলক এবং DGFI বিশেষতঃ সেনা অফিসারদেরকে টার্গেট করে করা হয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্ভবত একমাত্র নির্ভরযোগ্য সংস্থা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন উদ্ভট সময়ে সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে জারিকৃত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কি সেনাবাহিনীতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে না?
৪. যথাযথ জিজ্ঞাসাবাদ ব্যাতিরেকে ও অসম্পূর্ণ তদন্তের ভিত্তিতে শুধুমাত্র সংস্থা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করে, অভিযোগকারী ব্যক্তিদের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে গুমের সময়কাল বিবেচনা করে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার কাজ পরিচালনা করা এবং জিজ্ঞাসাবাদ ও অধিকতর অনুসন্ধান করে তখন দোষীদের গ্রেপ্তার সমীচীন হবে না? এছাড়াও ICT Act এর সংশোধনী প্রচলিত বিধি বহির্ভূতভাবে ভূতাপেক্ষী কার্যকরী না করে, জড়িত সেনাসদস্যদের বিচার প্রচলিত বিধি মোতাবেক সেনা আইনেই করা উচিত বলে মনে করেন কি-না?
৫. অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত ৬ মাসেও জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবে শহীদদের হত্যার তদন্ত শুরু হয়নি, কবে নাগাদ এই তদন্ত শুরু হবে? যেহেতু বিষয়টি সাম্প্রতিক এবং এই সরকারের ভীতে রয়েছে জুলাই-আগষ্ট ২০২৪ এ শহীদ হাজারো ছাত্র-জনতার লাশ, তাঁদের হত্যার বিচার দিয়েই কি আইসিটি আদালতের যাত্রা শুরু করা উচিত নয়? গুম-খুনের ঘটনার প্রতিটি তথ্যই লিপিবদ্ধ আছে এবং অবশ্যই সেসবরেও যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচার হবে কিন্তু জুলাই-আগষ্টের শহীদ'দের হত্যাকারীদের বিচার তরান্বিত করা উচিত—বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লেখক: প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক

মন্তব্য করুন