সুনামগঞ্জে গ্রাহকের ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো প্রতারক চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ
  প্রকাশিত : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:১০
অ- অ+

লোভের ফাঁদে পড়ে হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জের কয়েকশ মানুষ অর্থ লগ্নি করেছিল সুইজারল্যাণ্ড ভিত্তিক অক্সট্রেড.কম (oxetrade.com) নামে একটি অনলাইন কোম্পানিতে। প্রতারক এই কোম্পানির লোকজন সবার মাঝে বিশ্বাস জন্ম দিতে সুনামগঞ্জেরই নামীদামী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের টার্গেট করে যুক্ত করে। আর গ্রাহকদের বিশ্বাস স্থাপনের জন্য এক সপ্তাহ পরপর লভ্যাংশ দিতেও থাকে। এতে গ্রাহকদের মনোবল আরও বেড়ে যায় তেমনি সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

এই প্রতারক প্রতিষ্ঠানের হয়ে জেলা পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছেন মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সুনামগঞ্জের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অভিজিৎ সরকার। তিনি শহরের নতুনপাড়ার বাসিন্দা। তাকে খুঁজে পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। শহরের নতুনপাড়ার বাসভবনে কেবল তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। ঈদের পর থেকে মেটলাইফের সুনামগঞ্জ শহরের মেজর ইকবাল রোডের বিশাল অফিসে তালা ঝুলছে। লোভের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা মেট লাইফের অফিসে এসে অফিস তালা দেখে হা-হুতাশ করছেন।

অভিজিৎ সরকারের শ্বশুর দীপু তালুকদার জানান, অক্সট্রেড.কম’-এর হয়ে টাকা আরও অনেকে সংগ্রহ করেছে। এখন কেবল অভিজিৎকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের অক্সট্রেড নামের এই কোম্পানি অনলাইনে প্রচারণা চালায়। সুনামগঞ্জে এই কোম্পানির কার্যক্রম প্রথম শুরু করে নারায়ণগঞ্জের হীরাঝিলের জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, নরসিংদীর শিবচরের তরিকুল ইসলাম এবং কুমিল্লার হুমায়ুন আহমেদ। তারা সুনামগঞ্জে এই প্রতারক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগ করে মেটলাইফের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অভিজিৎ সরকারকে। জাহাঙ্গীর, তরিকুল, হুমায়ুন এবং মেটলাইফের স্টাফদের নিয়ে অভিজিৎ সরকার অক্সট্রেডের হয়ে ফাঁদ পাতেন জেলা সদরসহ আশপাশের উপজেলা জুড়ে। তারা ব্যবসায়ী, ডাক্তার, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের টার্গেট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শহরের বাঁধন আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাসও এই প্রতারক প্রতিষ্ঠানের শিকার। তার নিজের এবং আত্মীয়স্বজনের মিলে প্রায় ২ কোটি টাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

ডা. আশুতোষ দাস জানান, অনেক সাধারণ মানুষ এই কোম্পানির দেয়া লোভে পড়ে ফকির হয়ে গেছে। মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দুটি পলিসি কেবল আপডেট হয়েছিল আমার। ওখান থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা পাই, এই টাকাসহ দিরাইয়ে একটি জমি বিক্রয় করেছিলাম ব্যাংকের ঋণ দেয়ার জন্য সেখানকার টাকা, আমার আমেরিকা প্রবাসী শ্যালিকাসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়ে এখন লাপাত্তা অভিজিৎ সরকারসহ কোম্পানির দায়িত্বশীলরা। তাদেরকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্বম্ভরপুরের আরেকজন ব্যবসায়ী জানান, অভিজিৎ সরকার জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়ার কাছ থেকে ডলারের ম্যাসেজ পাঠিয়ে ক্যাশ করতেন। এ ছাড়া ‘বাইনান্স’ নামে আরেকটি হিসাবে গ্রাহক নিজেই ম্যাসেজ পাঠালে তারা বিকাশের মাধ্যমে টাকা ফেরত পাঠিয়ে দিতো। তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে বলেন, গত ৪ঠা মার্চ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে সাড়ে ৭ লাখ টাকা জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়ার হিসাবে জমা দিয়েছি। এরপর থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে লেনদেন ও সম্পর্ক বন্ধ করে দেয়। আমি প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সুনামগঞ্জ অফিসে গত বুধবার বিকালে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। তার আগের দিন গিয়েও তালা ঝুলানো পাওয়া যায়। অফিসের বীমা প্রতিনিধি লিংকন তালুকদার বলেন, আমি নিজেও ভিক্ষুক হয়ে গেছি। আমার বাড়ি-জমি সব বিক্রয় করে ২০ লাখ টাকা দিয়েছি।

আরেক স্টাফ শফিকুল ইসলাম বললেন, আমরা ‘বলির পাঁঠা’। লাভবান হয়েছে অভিজিৎ বাবু। আমিও জমি-জমা বিক্রি করে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি।

মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সুনামগঞ্জ অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পংকজ কুমার সরকার বললেন, অভিজিৎ সরকারই এই ব্যবসা করেছেন, আমরা কেউ জড়িত নই।

অভিজিৎ সরকারের শ্বশুর দীপু তালুকদার বলেন, সুমন, সাইফুল, শাহজাহান সুনামগঞ্জে এই কোম্পানি নিয়ে আসে। অভিজিত প্রথমে এতে যুক্ত হতে চায়নি, ১০-১৫ দিন তাকে বোঝানোর পর অভিজিৎ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে। সে তাদের বলেছিল, আমি ৫০০ ডলারের অ্যাকাউন্ট খুলবো। কিন্তু সাইফুল, সুমনেরা বলেছে টাকার কোনো প্রয়োজন নাই, আপনি ৫ হাজার ডলারের অ্যাকাউন্ট করেন। কিছুদিন পর অভিজিতের কাছ থেকে এরা টাকা নেয়।

তিনি বলেন, অভিজিতের নাম ব্যবহার করে এরা ব্যবসা করেছে। মানুষকেও বলেছে, অভিজিৎ অ্যাকাউন্ট করলে আপনারা করবেন না কেন। অভিজিতের নাম ব্যবহার করে অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয় তারা।

তিনি আরও বলেন, এর সঙ্গে ইসমাঈল, শফিক, স্বপন, অসিত, কাজল, শান্ত, সজল, সোহাগ, সুজিত, আনোয়ার, সুরঞ্জন, লিটন, রিপন, মিলটন, সজল (২), মৃদুল, জয়ন্ত, রিংকু, শংকর, শান্ত (ছাতক), মাহবুব, কার্তিক, আতিক, হাসান, বাবলু, ডা. গৌতম তালুকদার, ডা. আশুতোষ, পঙ্কজ (সাচনা), দেবল, রতন (পলাশ), জানকী, সমীরণ, রিপন প্রমুখ যুক্ত রয়েছে। যদিও তাদের ঠিকানা জানাতে পারেননি তিনি।

মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জিএম লুৎফুর রহমানকে বলেন, এ বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই, খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, এই বিষয়ে থানায় এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি, পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(ঢাকা টাইমস/১২এপ্রিল/এসএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এপ্রিলের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার
নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই সব দেনা পরিশোধ করল পেট্রোবাংলা
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব: অর্থ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা