বিদ্যাসাগরের দুরন্তপনা

স্বকৃত নোমান
 | প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৭

অনেক মহৈশ্বর্যশালী রাজা রায় বাহাদুর প্রচুর ক্ষমতা লইয়া যে উপাধি লাভ করিতে পারে নাই, এই দরিদ্র পিতার দরিদ্র সন্তান সেই ‘দয়ার সাগর’ নামে বঙ্গদেশে চিরদিনের জন্য বিখ্যাত হইয়া রহিলেন।

―রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বনমালিপুরের ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের পাঁচ ছেলের একজনের নাম রামজয়। ভুবনেশ্বরের মৃত্যুর পর সংসারে ভাঙন ধরল। ভাইদের হাতে চলে গেল সংসার কর্তৃত্ব। সংসার ছেড়ে দিয়ে রামজয় হয়ে গেলেন নিরুদ্দেশ। বাড়িতে রেখে গেলেন স্ত্রী দুর্গা, দুই ছেলে ও চার মেয়ে। শ্বশুরবাড়িতে বেশিদিন টিকতে পারলেন না দুর্গা। চলে গেলেন বাপের বাড়ি হুগলী জেলার বীরসিংহ গ্রামে। উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের মেয়ে তিনি। উমাপতি মস্ত প-িত। বয়স হয়েছে তার। সংসার দেখাশোনা করে তার ছেলে আর ছেলেবউ।

অল্পদিনের মধ্যেই দুর্গা বুঝতে পারলেন, তাকে সইতে পারছে না তার ভাই ও বৌদি। কথায় কথায় বৌদি কটুকথা বলেন। মেয়ের প্রতি ছেলে ও ছেলেবউয়ের এমন আচরণ দেখে উমাপতি নিজের বাড়ির কাছাকাছি একটা কুঁড়েঘর তুলে দিলেন মেয়ের জন্য। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই ঘরে থাকতে লাগলেন দুর্গা। সুতা কেটে সামান্য কিছু আয় করেন। উমাপতি মাঝেমধ্যে কিছু সাহায্য করেন। কিন্তু এ দিয়ে তো আর সংসার চলে না।

দুর্গার বড় ছেলে ঠাকুরদাসের বয়স তখন চৌদ্দ কি পনের। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় গিয়ে টাকা রোজগার করে মা-ভাই-বোনের দুঃখ দূর করবেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে একদিন চলে গেলেন কলকাতায়। আশ্রয় নিলেন জগন্মোহন ন্যায়লঙ্কারের বাড়িতে। বেশ কিছুদিন বেকার থাকার পর জগন্মোহনের সহযোগিতায় দুই টাকা বেতনের একটা কাজ জুটিয়ে নিলেন। দু-তিন বছর কাজ করার পর বেতন বেড়ে পাঁচ টাকা হলো।

ওদিকে রামজয় তখন বাড়ি ফিরে এসেছেন। এতদিন নানা তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তার ছিল অপার সাহস আর অগাধ শক্তি। কয়েকদিন বীরসিংহে কাটিয়ে কলকাতায় গেলেন। বড়বাজারের ভাগবতচরণ সিংহের বেশ ভালো অবস্থা। রামজয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার। রামজয়ের সমস্ত ইতিহাস শুনে তিনি বললেন, ঠাকুরদাসকে আমার কাছে রেখে যান। রামজয় অমত করলেন না। বাবার কথামতো ঠাকুরদাস উঠে এলেন ভাগবতচরণের বাড়িতে। মাসে আট টাকা বেতনে ঠাকুরদাসকে আরেকটা কাজ জুটিয়ে দিলেন ভাগবতচরণ। তার বাড়িতেই দিনে দু-বেলা ভাত খান ঠাকুরদাস।

ঠাকুরদাসের বয়স তখন তেইশ কি চব্বিশ। গোঘাটের রামকান্ত তর্গবাগীশের মেয়ে ভগবতীর সঙ্গে বিয়ে হলো তার। ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। তিনি তখন কোমরগঞ্জে, মঙ্গলবারের হাটে। সুখবরটা ছেলেকে জানাতে কোমরগঞ্জে রওনা হলেন রামজয়। পথেই ছেলের সঙ্গে দেখা। বললেন, একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে।

ঠাকুরদাস ভাবলেন বাড়ির গরুটির বাচ্চা হয়েছে বুঝি। বাড়ি ফিরেই তিনি গোয়ালঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। রামজয় তখন হাসতে হাসতে বললেন, ওদিকে নয় ওদিকে নয়, এদিকে এসো। এঁড়ে বাছুর দেখাচ্ছি।

ছেলেকে নিয়ে আরেক ঘর ঢুকলেন রামজয়। নবজাতককে দেখালেন। বললেন, একে এঁড়ে বাছুর বললাম কেন জানো? এই ছেলে এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে। যা ধরবে তাই করবে, কাউকে ভয় করবে না। ও হবে ক্ষণজন্মা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রথিতযশা, দয়ার অবতার। ওর জন্য আমার বংশ ধন্য হবে। ওর নাম রাখলাম ঈশ্বরচন্দ্র।

দুই.

পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে ভর্তি করানো হলো গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। পড়াশোনার প্রতি ঈশ্বরের টান আছে, পাশাপাশি দুষ্টুমিতেও তার তুলনা নেই। তার জ্বালায় পাড়ার মানুষ অস্থির। পাড়ার বাগানে ঢুকে চুপেচুপে ফল খায়। কেউ রোদে কাপড় শুকাতে দিলে ছোট লাঠি দিয়ে তাতে ময়লা লাগিয়ে দেয়। ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাঁচাধানের শিষ খানিকটা মুখে দিয়ে চিবায়, খানিকটা ফেলে দেয়। একবার যবের শিষ খেতে গিয়ে গলায় আটকে গেল যবের কাঁটা। তার ঠাকুমা অনেক কষ্টে গলায় আঙুল দিয়ে সেই কাঁটা বের করে দিলেন।

পাঠশালায় যাওয়ার পথে প্রায় প্রত্যেকদিন পাড়ার মথুরামোহন ম-লের মা আর বউকে বিরক্ত করার জন্য মথুরামোহনের বাড়ির দরজায় পায়খানা করে রাখে ঈশ্বর। মথুরামোহনের মা পার্বতী আর বউ সুভদ্রা নিজ হাতে সেসব ময়লা পরিষ্কার করে। কোনো কোনোদিন সুভদ্রা বিরক্ত হয়ে বলত, দুষ্ট বামুন, রোজই আমার দরজায় পায়খানা করে যাবে? আর কোনোদিন করলে তোমার গুরুমশায় ও ঠাকুরমাকে বলে দেব। তারা তোমাকে শাসন করবে। তখন বুঝবে মজা।

শুনে সুভদ্রার শাশুড়ি পার্বতী বলত, ছেলেটি সহজ নয় বউমা। ওর ঠাকুরদা বারো বছর বিবাগী হয়ে তীর্থক্ষেত্রে জপতপ করে দিন কাটিয়েছেন। সাক্ষাৎ ঋষিতুল্য মানুষ। তার মুখে শুনেছি এই বালক অদ্বিতীয় শক্তিসম্পন্ন হবে। তুমি বিরক্ত হয়ো না। আমি নিজে তার মলমূত্র পরিষ্কার করব। এই বালক কে, তা ভবিষ্যতে জানতে পারবে।

দুষ্টুমি করে বেড়ালেও পড়ালেখায় কোনো ত্রুটি রাখে না ঈশ্বর। আট বছর বয়স পর্যন্ত কালীকান্তের পাঠশালায় পড়ালেখা করল। কালীকান্ত একদিন ঠাকুরদাসকে বললেন, আমার পাঠশালার পড়া শেষ হয়েছে, এবার তাকে কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতায় নিয়ে ইংরেজি শেখালে ভালো হয়।

এরই মধ্যে মারা গেলেন রামজয় তর্কভূষণ। পিতৃকৃত্য সেরে কলকাতায় যাবার সময় ঈশ্বরকেও সঙ্গে নিলেন ঠাকুরদাস। বীরসিংহ থেকে কলকাতা কাছের পথ নয়। সঙ্গে আরো চলল আনন্দরাম গুটি ও কালীকান্ত। পথ চলতে চলতে ঈশ্বর ক্লান্ত হয়ে পড়লে আনন্দরাম তাকে কাঁধে তুলে নেয়।

হাঁটতে হাঁটতে সিয়ালখালার কাছে সালিখার বাঁধা রাস্তায় উঠে এলো সবাই। ঈশ্বর খেয়াল করে দেখল, রাস্তার একপাশে মরিচ বাটার পাটার মতো একটা পাথর পোঁতা। কিছুদূর পর পর একেকটা পাথর পোঁতা মাটিতে। তার মনে প্রশ্ন জাগল। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এই শিলাগুলো কী বাবা?

ঠাকুরদাস বললেন, শিলা নয়, এগুলোকে বলে মাইলস্টোন।

মাইলস্টোন কী বাবা?

মাইলস্টোন ইংরেজি শব্দ। এক মাইল হলো আমাদের আধক্রোশের সমান। স্টোন অর্থ পাথর। কলকাতা থেকে প্রত্যেক এক মাইল অন্তর এরকম একেকটি পাথর পোঁতা আছে। প্রত্যেক পাথরে লেখা আছে কলকাতা থেকে ওখান পর্যন্ত কত মাইল পথ। কলকাতা থেকে এক মাইল দূরে যে পাথরখানা পোঁতা আছে তাতে ইংরেজিতে ‘এক’ লেখা আছে। আর দেখ, এখানে লেখা আছে উনিশ। মানে কলকাতা এখান থেকে উনিশ মাইল। সাড়ে নয় ক্রোশ।

বাংলা অঙ্কের হিসাব জানে ঈশ্বর। ঊনিশ লেখা পাথরটি সে ভালো করে দেখে নিল। একের পিঠে নয়, মানে ঊনিশ। পাথরে হাত দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ইংরেজিতে কি এটা এক আর এটা নয়, বাবা?

বাবা বললেন, হ্যাঁ।

ঈশ্বর মনে মনে ঠিক করল, পথে যেতে যেতে ইংরেজি অঙ্ক শিখে ফেলতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা মাইলস্টোনের কাছে এসে থামল। সেটিতে লেখা দশ মাইল। মানে পাঁচ ক্রোশ। ঈশ্বর বলল, বাবা, আমি ইংরেজি অঙ্ক চিনে নিয়েছি। এক থেকে দশ পর্যন্ত শিখে ফেলেছি।

বাবা বললেন, সত্যি সত্যি শিখে ফেলেছ? পরীক্ষা করে দেখা যাক তাহলে।

নয় নম্বর পাথরটি দেখিয়ে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, এটা কত বলো তো?

ঈশ্বর বলল, নয়।

আট নম্বর পাথরটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কত?

ঈশ্বর বলল, আট।

সাত নম্বর লেখা পাথরটি দেখিয়ে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, এবার বলো এটা কত?

ঈশ্বর উত্তর দিল, সাত।

ঠাকুরদাসের মনে সন্দেহ জাগল। দশের আগে নয়, নয়ের আগে আট, আটের আগে সাত। হয়ত ইংরেজি অঙ্ক চেনে না ছেলে, নিশ্চয়ই চালাকি করে উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। বুদ্ধি করে তিনি ছয় নম্বর পাথরটি ঈশ্বরকে না দেখিয়ে গোপন করে গেলেন। পাঁচ নম্বর লেখা পাথরটির সামনে এসে বললেন, এবার বলো এটা কত?

ঈশ্বর বলল, বাবা, এটা ছয় হওয়া উচিত। কিন্তু ভুলে পাঁচ লিখে রেখেছে।

ঠাকুরদাস খুশি হলেন। বললেন, সত্যি সত্যি তুমি ইংরেজি অঙ্ক চিনেছ। ওটা ঠিকই আছে। ছয় নম্বর পাথরটি আমি তোমাকে দেখাইনি।

কালীকান্তও খুশি হলেন। ঈশ্বরের চিবুক ধরে আশীর্বাদ করে ঠাকুরদাসকে বললেন, ঈশ্বরের পড়াশোনার ভালো ব্যবস্থা করবেন। বেঁচে থাকলে ও মানুষের মতো মানুষ হবে।

তিন.

কলকাতার ভাগবতচরণ সিংহের একমাত্র ছেলের নাম জগদ্দুর্লভ। ভাগবতচরণ মারা গেছেন। জগদ্দুর্লভই এখন সংসার দেখাশোনা করেন। তার বাড়িতেই থাকেন ঠাকুরদাস। বাবার সঙ্গে ঈশ্বর এই বাড়িতেই উঠল। বাড়ির কাছে শিবচরণ মল্লিকের বাড়িতে একটা পাঠশালা বসে। গুরুমশায়ের নাম স্বরূপচন্দ্র দাস। ঈশ্বরকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো এই পাঠশালায়। অঘ্রাণ, পৌষ, মাঘ―মোট তিন মাস এখানে পড়ালেখা করল ঈশ্বর। ফাল্গুনের গোড়ার দিকে অসুখ হলো তার। কবিরাজি চিকিৎসায় অসুখ ভালো হলো না। খবর পেয়ে তার ঠাকুমা কলকাতায় এলেন। দু-তিন দিন কলকাতায় থেকে ঈশ্বরকে নিয়ে তিনি বীরসিংহে চলে গেলেন। এখানে এসে ওষুধ ছাড়াই মাত্র সাত-আট দিনে সুস্থ হয়ে উঠল ঈশ্বর। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে আবার তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হলো।

প্রথমবার কলকাতায় আসার পথে মাইলস্টোন দেখে ঈশ্বর কেমন সহজে ইংরেজি অঙ্ক শিখেছে, ঠাকুরদাসের মুখে কয়েকজন সেকথা শুনল একদিন। সবাই বলল, তবে তো তাকে ইংরেজি পড়ানো উচিত। হেয়ার সাহেবের স্কুলে ভর্তি করানো যেতে পার। বেতন দেয়া লাগে না। যদি ভালো শিখতে পারে, হিন্দু কলেজে বিনা বেতনে পড়তে পারবে। ইংরেজিটা ভালো করে জানতে পারবে ঐ কলেজে পড়লে। মোটামুটি ইংরেজি জানলে অনায়াসে সাহেবদের অফিসে চাকরি পেয়ে যাবে।

কিন্তু ঠাকুরদাস ছেলেকে ইংরেজি পড়াবেন না। সংস্কৃত শেখার ইচ্ছে ছিল তার। অভাবের কারণে পারেননি। তিনি ঠিক করে রেখেছেন ছেলেকে সংস্কৃত শেখাবেন। চাকরি করে সংসারের অভাব ঘোচাবে সেজন্য তিনি ছেলেকে কলকাতায় আনেননি। তার ইচ্ছা, সংস্কৃত শাস্ত্রে প-িত হয়ে ছেলে গ্রামে গিয়ে একটা টোল খুলবে। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ছেলেকে তিনি সংস্কৃত কলেজেই ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

১৮২৯ সালের ১ জুন, মাত্র নয় বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হলো ঈশ্বর। বড়বাজারের বাসা থেকে বাবার সঙ্গে পটলডাঙার কলেজে যায়। ছুটির পর বেলা চারটার সময় আবার বাবার সঙ্গেই বাসায় ফেরে। কিছুদিন পর বাবাকে আর সঙ্গে যেতে হয় না, ঈশ্বর একা একাই কলেজে যাতায়াত করে।

ঈশ্বর দেখতে ছোটখাটো। কিন্তু মাথাটি দেখতে সেই তুলনায় বড়। সহপাঠীরা তাই ঠাট্টা করে বলে, ‘যশুরে কৈ, কসুরে জৈ।’ ঈশ্বর রেগে যায়। যত বেশি রাগে, সহপাঠীরা ততবেশি তার পিছনে লাগে।

রোজ রাতে বাবার কাছে পড়া দিতে হয় ঈশ্বরকে। পড়ায় ভুল হলে রক্ষা নেই। লেখাপড়া ছাড়াও কাজের শেষ নেই তার। সকালবেলা গঙ্গা¯œান সেরে আসার পথে বাজার করে আসতে হয়। তারপর মশলা বাটতে হয়, মাছ-তরকারি কাটতে হয়। রান্নাও করতে হয় তাকেই। চার-পাঁচজনের রান্না একাই করে। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পরে তাকে খেতে হয়। ফেলে-ছড়িয়ে খাওয়া যাবে না। একটি ভাত পাতের পাশে পড়ে থাকলে ঠাকুরদাস রেগে যেতেন। খাওয়ার পর সবার থালা-বাসন মেজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, তারপর যায় কলেজে।

ঠাকুরদাসের আয়-রোজগার বেশি নয়। টেনেটুনে কোনোরকমে সংসার চালাতে হয়। রোজ দুই বেলা ভাত জোটে না। জুটলেও সবসময় পেট ভরে খেতে পায় না। অনেক সময় শুধু লবণ দিয়ে ভাত খেতে হয়। যখন মাছ-তরকারি জোটে তখনও ঘটা করে মাছ-তরকারি খাওয়ার উপায় নেই। এক বেলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত, আরেকবেলা ভাত আর তরকারি। মাছটুকু খাওয়া হবে পরের দিন। পরদিন ঐ মাছ দিয়েই অম্বল রান্না হতো। অম্বল দিয়ে ভাত খাওয়া।

রান্নাঘরটা ছিল অন্ধকার। একফোঁটা রোদ ঢোকে না। তার উপর রান্নাঘরের পাশে একটা ময়লার ভাগাড়। মলমূত্র আর কৃমিকীটে ভরা। দুর্গন্ধ তো আছেই। তারচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার, খাবার সময় ঈশ্বরকে এক ঘটি জল নিয়ে বসতে হয়। নইলে ভাত খাওয়ার উপায় নেই। দলে দলে কৃমি থালার দিকে এগিয়ে আসে। ঘটি থেকে জল ঢেলে ঈশ্বর কৃমির দলকে ভাসিয়ে দেয়, সরিয়ে দেয়।

রান্নাঘরে আরশোলার খুবই উৎপাত। একদিন খেতে বসে ঈশ্বর দেখল, তরকারির মধ্যে একটা আরশোলা। কাউকে বলল না সেকথা। বললে তো কারো খাওয়া হবে না। আরশোলাটা যদি পাতের পাশে ফেলে দেয়, অন্যদের চোখে পড়বে। কী করা যায়? অন্যদের যাতে অসুবিধা না হয়, কেউ যাতে কিছুই টের না পায়, তরকারির সঙ্গে আরশোলাটাও খেয়ে ফেলল সে।

চার.

সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার দেড় বছর পরে ১৮৩১ সালের মার্চ মাস থেকে ঈশ্বর মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি পেতে শুরু করল। কৃতী ছাত্ররা কলকাতায় বাসা খরচের জন্য এই বৃত্তি পেত। যারা বৃত্তি পেত তাদের বলা হতো পে-স্টুডেন্ট।

ঈশ্বর ভর্তি হয়েছিল ব্যাকরণ তৃতীয় শ্রেণিতে। ভালো করে লেখাপড়া শেখার জন্য তার চেষ্টার কমতি নেই। বাবাকে প্রায়ই বলত, রাত দশটার সময় খেয়ে শুয়ে পড়ব। বারোটা বাজলে আমাকে জাগিয়ে দেবেন, নইলে পড়া হবে না। খাওয়া শেষ করে তাই দুই ঘণ্টা বসে থাকতেন বাবা। আরমনি গির্জায় রাত বারোটার ঘণ্টা শুনে ছেলেকে জাগিয়ে দিতেন। ঈশ্বর সারা রাত পড়ত।

মাসিক বৃত্তির টাকা বাবার হাতে তুলে দিত ঈশ্বর। ঠাকুরদাস একদিন বললেন, তোমার এই টাকায় জমি কিনব। দেশে একটা টোল করে দেব। দেশের লোক যাতে লেখাপড়া শিখতে পারে তুমি সেই ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত তাই করলেন তিনি। কাঁচিয়াগ্রাম অঞ্চলে কয়েক বিঘা জমি কিনলেন। কিছুদিন পর বললেন, বৃত্তির টাকায় যেন ঈশ্বর তার প্রয়োজনীয় বইপুস্তক কেনে। বাবার কথামতো ঈশ্বর তাই করল।

ঈশ্বর যখন বীরসিংহে যায়, কারো বাড়িতে আদ্রশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হলে তার উপর নিমন্ত্রণের কবিতা লেখার ভার পড়ে। নিমন্ত্রণে আসা প-িতরা তার সঙ্গে ব্যাকরণের বিচার করেন। বিচারকালে ঈশ্বর সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে। প-িতরা অবাক হয়ে যান। ক্রমে দেশে প্রচার হয়ে গেল ঈশ্বর অদ্বিতীয় প-িত।

সংস্কৃত কলেজে ‘অলঙ্কার শ্রেণি’তে পড়ার সময় ঈশ্বর রোজ কলেজ ছুটির পর বিকেল চারটার সময় ঠনঠনিয়ার চৌরাস্তার কাছে তারাকান্ত বিদ্যাসাগর, তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও মধুসূদন বাচস্পতির বাসায় যেত। তারা তাকে খুব ¯েœহ করতেন। সেই বাসায় ঈশ্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সাহিত্যদর্পণ পত্রিকা পড়ত। একদিন ঐ বাসায় এলেন প্রখ্যাত প-িত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন। ঈশ্বরকে সাহিত্যদর্পণ পড়তে দেখে তিনি তো অবাক। এই অল্পবয়সী বালক কি করে সাহিত্যদর্পণ বুঝতে পারে? বাচস্পতি বললেন, কী রকম শিখেছে জিজ্ঞেস করে দেখুন।

ঈশ্বরকে সাহিত্যদর্পণের রসের বিচার জিজ্ঞেস করলেন জয়নারায়ণ। ঈশ্বরের ব্যাখ্যা শুনে তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, এই বালক বড় হলে বাংলাদেশের মধ্যে অদ্বিতীয় লোক হবে। এত অল্পবয়সে এমন প-িত আমি কখনো দেখিনি।

উঁচু শ্রেণির ছাত্রদের মাঝেমধ্যে সংস্কৃতে গদ্য-পদ্য লিখতে হতো। সংস্কৃত রচনা লিখতে সাহস হতো না ঈশ্বরের। রচনার সময় এলেই সে পালিয়ে যেত। ১৮৩৮ সালে সংস্কৃত কলেজে নিয়ম চালু হলো, স্মৃতি, ন্যায় ও বেদান্ত শ্রেণির ছাত্রদের বার্ষিক পরীক্ষার সময় গদ্য-পদ্যে সংস্কৃত রচনা লিখতে হবে। গদ্য যার সবচেয়ে ভালো হবে সে পাবে এক শ এবং পদ্য যার ভালো হবে সেও পাবে এক শ টাকা পুরস্কার। গদ্য-পদ্যের পরীক্ষা একই দিন হবে। দশটা থেকে একটা পর্যন্ত গদ্য এবং একটা থেকে চারটা পর্যন্ত পদ্য রচনা পরীক্ষা।

সেবার গদ্য-পদ্য পরীক্ষার দিন সব ছাত্র ঠিক সময়ে এলো, দশটার সময় লিখতে শুরু করল, অথচ ঈশ্বর এলো না। অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ খুব ভালোবাসেন ঈশ্বরকে। তিনি জোর করে ঈশ্বরকে ধরে নিয়ে পরীক্ষায় বসিয়ে দিলেন। কিন্তু সংস্কৃত রচনা লিখতে তো ঈশ্বরের কিছুতেই সাহস হয় না। কী করে সে? প্রেমচন্দ্র বললেন, যা পার কিছু লেখ। নইলে সাহেব খুব রাগ করবেন।

সাহেব মানে ইংরেজ মার্শাল সাহেব। তিনি সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি। ঈশ্বর বলল, সবাই দশটার সময় লিখতে শুরু করেছে, এখন বাজে এগারোটা। এই অল্প সময়ে আমি কী লিখব?

বিরক্ত হয়ে প্রেমচন্দ্র বললেন, যা ইচ্ছা লেখ।

প্রেমচন্দ্র চলে গেলেন। ‘সত্য কথনের মহিমা’ সম্পর্কে সংস্কৃতে গদ্যরচনা লিখতে হবে। বারোটা পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল ঈশ্বর। কিছুই লিখতে পারল না। খোঁজ নিতে এসে প্রেমচন্দ্র দেখলেন ঈশ্বর কিছুই লেখেনি। চুপচাপ বসে আছে। তিনি রাগ করলেন। ঈশ্বর বলল, কী লিখব, কিছুই ঠিক করতে পারছি না। প্রেমচন্দ্র বললেন, ‘সত্যং হি নাম’ এই বলে শুরু করো।

‘সত্যং হি নাম’ লিখ রচনা লিখতে শুরু করল ঈশ্বর। অনেক কষ্টে অনেক ভেবে-চিন্তে এক ঘণ্টায় কয়েকটি লাইন লিখতে পারল। একটার সময় নাম সই করে কাগজ জমা দিল। পুরস্কার তো দূরের কথা, ঈশ্বর মনে মনে ভাবল, রচনার নমুনা দেখে পরীক্ষকেরা নির্ঘাত হাসাহাসি করবেন। কিন্তু তার ধারণা সত্য হলো না। গদ্য রচনার জন্য সে-বারই পুরস্কার পেল সে।

১৮৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজের সার্টিফিকেট পেল ঈশ্বর। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়েই তার নামের শেষে জুড়ে গেল একটি উপাধি―বিদ্যাসাগর। পরবর্তীকালে তিনি বিখ্যাত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে।

[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০, মৃত্যু ২৯ জুলাই ১৮৯১) উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পা-িত্যের জন্য প্রথম জীবনেই লাভ করেন বিদ্যাসাগর উপাধি। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি ছিল তাঁর। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ করে তোলেন ও অপারবোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনি। রচনা করেছেন জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা।

বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনোই তাঁর কাছ থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থসংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। পিতামাতার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।

বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ভারতের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তাঁরই নামে উৎসর্গিত।]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :