আমিও হতে পারতাম জঙ্গি

আরিফ হাসান
  প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৫১| আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪১
অ- অ+

২০০৭ এর শেষের দিকের কথা বলছি। তখন সবে এইচএসসি পাস দিয়ে বিবিএসে ভর্তি হয়েছি। বাড়িতে থাকি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়ি। ঠিক ওই সময়টাতেই পড়লাম একটা চক্রের খপ্পরে। ওরা আমারই পাশের এলাকার পরিচিত ভাই, বন্ধু। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম আর চলাফেরা দেখে ওরা ঠিকই বুঝেছিল যে, একে দিয়েই কাজ হবে।

বর্তমানের প্রেক্ষাপট দিয়ে যেটুকু বুঝি ওরা প্রত্যেকেই ছিল জিহাদি নামধারী, সাধারণ মানুষের অন্তরে জঙ্গির বীজ রোপণকারী। হাদিস-কোরআনের রেফারেন্স দিয়ে মানুষকে ইসলামী জিহাদের দিকে আহ্বান করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। ওরা মানুষকে বোঝাতো- কালেমার দাওয়াত নয় বরং অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেই কায়েম করতে হবে ইসলাম। যুদ্ধের জন্য নিতে হবে যথাযথ প্রশিক্ষণ। কীভাবে অস্ত্র ধরবেন, কীভাবে গুলি করবেন এমন টেনশনের ওষুধও ছিল তাদের কাছে। কোথায়, কীভাবে প্রশিক্ষণ নেবেন সব তথ্যই ছিল ওদের কাছে।

যুদ্ধ করতে শুধু অস্ত্র বিদ্যা নয়, মল্লযুদ্ধেও আপনাকে হতে হবে পারদর্শী। আর এ জন্য কারাতে শেখার ব্যবস্থাও ছিল তাদের কাছে। ভাবছেন এতো কিছু আমি কীভাবে জানি? খুব গোপনে ডেকে নিয়ে এসবই বোঝানো হতো আমাকে। বোঝানো হতো- আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) জিহাদ করেছেন, আমাদেরও করতে হবে। এখন তো আর তখনকার মতো তরবারির যুগ নেই, যুদ্ধ করতে হবে বোমা আর পিস্তল দিয়ে।

শুরুতেই অবশ্য এত গভীরে নামেনি তারা। প্রথম প্রথম তারা আমাকে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ঘরোয়া মাহফিলে ডাকতো। সেই মাহফিলেই বোঝানো হতো জিহাদের গুরুত্ব। প্রতিটা মাহফিল হতো ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। প্রতিটা মাহফিলের বিষয়বস্তুই থাকতো জিহাদ। অস্ত্র ধরতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে। হাদিস-কোরআনের কথা ভেবে আমিও শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কখনোই মনে হতো না যে তারা আমাকে হাদিস-কোরআন সম্পর্কে ভুল বোঝাচ্ছে। হাদিস-কোরআনে যাদের বিরুদ্ধে, যে জিহাদের কথা বলা আছে তার ভুল ব্যাখ্যা তারা আমাকে সহ অন্যদের শোনাচ্ছে, বোঝাচ্ছে।

কয়েকদিন পর কিছুদিন বাদে বাদেই বিভিন্ন মানবিক সমস্যার কথা বলে তারা আমার কাছ থেকে টাকা নেয়া শুরু করলো। ওমুক এলাকায় এতিমখানা চলছে না, ওমুক এলাকার মাদ্রাসায় কয়েকজন গরিব বাচ্চা আছে- ইত্যাদি বলে বলে টাকা চাইতো। সওয়াবের আশায় আমিও দিতাম সাধ্যমত। একদিন তো অনেকদিন ধরে মাটির ব্যাংকে জমানো পুরোটাই দিয়ে দিলাম।

কিন্তু আল্লাহ সহায়। ভুল ভাঙলো খুব দ্রুতই। যখন তারা আমাকে বিভিন্ন জিহাদি বই দিতে শুরু করলো। একটা শেষ হলেই আরেকটা দিতো। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ আমার কোনদিনও ছিল না, তারপরও নিতাম লজ্জার খাতিরে। পড়তাম, দেখতাম প্রতিটা লাইনই আপনার রক্ত গরম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই সকল যুদ্ধের বর্ণনা যে যুদ্ধের কথা হাদিস-কোরআন কিংবা কোনো ইতিহাসে পড়িনি। ঘোর কাটলো তখন থেকেই।

এখন শেষ করবো। কারণ, তোমাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, অস্ত্র ধরা শিখতে হবে, গুলি চালানো শিখতে হবে, কারাতে শিখতে হবে-এসব অফার ওরা আমাকে এখনই দেবে। সিলেট-চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার কথা ওরা আমাকে বলতো-যেখানে এসবের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমি তো কোথাও চিনি না- ভয় নাই ওরাই আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে। আমাকে শুধু মাসখানেক থাকা-খাওয়ার জন্য হাজার দশেক টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। চূড়ান্ত ভুলটা তখনই ভাঙলো।

এর পর থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে শুধু এড়িয়েই চলতাম ওদের। কখনোই আর পাত্তা দেইনি। কেন না, ছোটবেলায় মাদ্রাসায় হাদিস-কোরআন পড়ার সুবাদে অন্তত এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে- সত্যিকার জিহাদ এটা নয় যেটা ওরা আমাকে বোঝাচ্ছে। সেদিন সঠিক বুঝ না আসলে আজ হয়তো আমিও থাকতাম কোন না কোন জঙ্গি দলের সদস্য। আমাকেও পাওয়া যেত কোন জঙ্গি আস্তানায়। নিজের দেহে বোমা বেঁধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের মিথ্যা সাহস নিয়ে চিৎকার করে বলতাম, ‘সময় কম, দ্রুত সোয়াট পাঠান।’

লেখক: শিক্ষক, হাসিমুখ স্কুল

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাজীপুরে হাসনাত আব্দুল্লাহর গাড়িতে হামলা, আটক ২ 
পল্লবীতে বিশেষ অভিযানে পেশাদার ছিনতাইকারীসহ ২৬ জন গ্রেপ্তার
হাসনাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে বাংলামোটরে এনসিপির বিক্ষোভ
দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা