ভগ্নাংশ প্রেম প্রকাশ

অনলাইন ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:৫৯

আমাদের কাব্যাঙ্গনে নানা কারণে একটা দুঃসময় যাচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভের একটা দুর্বার বাসনা লক্ষ্য করি। তাতে মন্দের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু কবিতা সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক পরিচিতি তার স্কুলজীবনে ঘটে না। শিক্ষক কবিতা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। পরীক্ষায়ও বলা হয় প্রসঙ্গসহ ব্যাখ্যা লিখ। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা যে আসলে কবিতা বিশেষের বিকৃতি, সেটা বোঝার সৌভাগ্য অনেকেরই হয় না। কবিতা যে বুদ্ধি দিয়ে বোঝার ব্যাপার না এ বোধ তার জন্মায় না। আসলে কবিতা যে নিজেই নিজের সর্বোত্তম প্রকাশ সেটা স্কুলের বাংলা শিক্ষায় কখনো বলা হয় না।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কবিতার যেটুকু বোঝা গেল সেটা তার দেহ, যেটা বোঝা গেল না সেটা তার প্রাণ।

কবিতা আসলে একটা অন্তরঙ্গ অনুভূতি, যা পাঠকের প্রাণে সঞ্চারিত হয়। সেটা বুদ্ধিজাত কিছু নয়। বুদ্ধি দিয়ে তাকে বিচার করা কবি ও কবিতা উভয়ের প্রতি অবিচার করা। কারণ কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে প্রেরণা। সেটাকে কেউ কেউ ঐশ্বরিক বলে না মানলেও, সেটা যে পরাবাস্তব প্রেরণাজাত তা সম্ভবত সবাই স্বীকার করবেন। অন্ত্যমিল দিয়ে কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না। তাকে বলা যাবে পদ্য। কিছু পদ্য কবিতা হতে পারে, কিন্তু সব পদ্য কবিতা নয়। আবার অনেক গদ্যও কবিতা হতে পারে।

তাহলে কবিতা আসলে কী? কবিতার সংজ্ঞা যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা দিয়ে গেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা বলা যায় না যে, সবাই যে কোনো একটি সংজ্ঞা সম্পর্কে একমত হয়েছেন। আমার কাছে যে সংজ্ঞাটি সবচেয়ে সহজ ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে সেটা ড. জনসনের। তিনি বলেছেন, যদি প্রশ্ন করো কবিতা কী? তাহলে বলব আমি জানি না। তবে যদি প্রশ্ন না করো তাহলে বলব আমি জানি।

যা হোক, কবিতার মাধ্যম হচ্ছে শব্দ। শব্দের মাধ্যমে কবি তার অনুভূতিকে পরিবেশন করেন। সে শব্দে আছে চিত্রকল্প, সংগীত বা ধ্বনিমাধুর্য বা ছন্দ, যাকে এক অর্থে আঙ্গিক বলা যায়। তরুণদের অনেকেই এ সম্পর্কে না জেনেই কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং যেহেতু অর্থের অভাব নেই, সেগুলো বইমেলায় আসে প্রচুর পরিমাণে। আমাদের সংগীতের জগতেও একই দুর্ভাগ্য। রাগ-রাগিণী সম্পর্কে তালিম না নিয়ে বা যথেষ্ট রেওয়াজ না করে সরাসরি টেলিভিশন-রেডিওতে গান করা। এরপর আছে প্রবীণ কবিদের নিজ নিজ প্রভাব বলয় সৃষ্টির প্রয়াস এবং তরুণদের সে বলয়ে প্রবেশের চেষ্টা। সাহিত্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশও আমাদের কাব্যানুভূতির সীমানাকে করেছে সংকীর্ণ।

কবি সালেহ মুজাহিদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভণিতা একটু দীর্ঘই হয়ে গেল। তবে কবি যে প্রেক্ষাপটে কবিতা লিখছেন সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দেয়াটা সমীচীন মনে হলো। সালেহ মুজাহিদ কবি, শুধুই কবি। তিনি কোনো গোষ্ঠীতে অবস্থান নেননি। কবিতা সম্পর্কে তার অনুভূতিও স্বচ্ছ। কবিতায় তার নিজস্ব একটা জগৎ আছে, নিজস্ব কিছু ভাবনাও আছে। কিন্তু সে ভাবনা কখনো কবিতার নান্দনিক অনুভূতিকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠেনি। বইটিকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগটি তার নিজস্ব চিন্তার জগতের বিস্তার ও বিচরণ। দ্বিতীয় ভাগটিতে তিনি তাঁর সাম্প্রতিক চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতাপ্রসূত লেখা কিছু কবিতা, যা তিনি লিখেছেন প্রাচীন চৈনিক কবিদের আঙ্গিকের আদলে, তার মধ্যে কিছু চীনা কবিতার অনুবাদও আছে।

সালেহ মুজাহিদের কবিতার মূল উপজীব্য হচ্ছে প্রেম, যা নানা রঙে, নানা বর্ণে, নানা আভরণে উদ্ভাসিত। তার সে প্রেমের একটা দর্শন আছে কিন্তু সে দর্শন কখনোই কাব্যের আঙিনা পেরিয়ে দর্শনের দহলিজে নীতিবাক্য উচ্চারণ করেনি। সে প্রেম নিতান্তই সহজ-সরল ভাষায় পাহাড়ি ঝরনার মতো কলকল রবে বয়ে গেছে। বিমুগ্ধ পাঠক সে শব্দে বিমোহিত হয়েছেন। তার একটি কবিতার নাম ‘জীবন ও মৃত্যুর খেলা’। শিরোনাম দেখে মনে হবে নিশ্চয়ই কঠিন দুর্বোধ্য কিছুর অবতারণা। কিন্তু লক্ষ্য করুন কী অদ্ভুত তার অন্তরঙ্গ স্বর, কী আশ্চর্য ওম ওম চিত্রকল্প, নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার কী অসাধারণ উপস্থাপনা :

জীবন তোকে খুব ভালোবাসিরে

তুই আমার নভেম্বরের কাঁথা শীতে

সকাল বেলার নরম রোদ্দুর।

আধ বেলাতে গরম ভাতের ধোঁয়ার সাথে

আলতো মাখা ঘি।

মরণ তোকেও খুব ভালোবাসিরে

জানি তুই আমার কাঁধে হাত রেখে

হেঁটে যাবি কোনো এক দূর সকালে

সেই জীবনে

আকাশ আকাশ স্বপ্ন থাকে

দীর্ঘ রাতের ঘুম হবে

দেহের বাইরে ভ্রমণ হবে।

সালেহ মুজাহিদের কবিতায় প্রেমের উপস্থিতি সার্বক্ষণিক। সে প্রেম প্রাত্যহিক দেহের ভাষায় কথা বলে, কামে ঘামে শীৎকারে তা মানবিক মনে হয় ঠিকই কিন্তু তার গভীরে যে প্রেম তার আরাধনা হয়ে শয্যাসঙ্গিনী হয় তা নিতান্তই তার নিজস্ব মরমী অনুভূতি এবং সেটাই তার কবিতার মূল উপজীব্য। ‘হে আমার প্রেমাস্পদ’, ‘আমাদের ভালোবাসারা’, ‘প্রেম কড়চা’ ইত্যাদি কবিতা প্রাত্যহিক জীবনের সব অনুভূতি অনুষঙ্গ নিয়েও শেষ অবধি তাঁর অধ্যাত্মবাদের ও ঈশ্বর প্রেমের প্রকাশ। ‘তিনি একজন’ কবিতাটি একটু ভিন্নধর্মী কিন্তু খুবই হৃদয়গ্রাহী।

যেহেতু প্রেমের সওদা করেন কবি সালেহ মুজাহিদ, সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই তুমি আমি দুটি শব্দ এসে যায় যমজ সন্তানের মতো। কিন্তু এ ‘তুমি আমি’ শেষ অবধি তুমিতেই বিলীন হয়ে যায়। ‘দর্পণে কার মুখ’ একটি এ জাতীয় কবিতা। আয়নার সামনে কবি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন তার আপন অস্তিত্ব নিয়ে। কবিতাটা খুবই সুখপাঠ্য, কিন্তু পাঠক সম্ভবত আন্দাজও করতে পারেন না যে, তিনি অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি কঠিন সুফি দর্শনের বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। ওহদাতুল ওজুদ ও ওহদাতুস শহুদ, দ্বৈত-অদ্বৈত বাদ ইবনে আরাবীর সময় থেকে একটি অতি বিতর্কিত বিষয়। কে আসল আয়নার ভেতরের ছায়াটি, নাকি যে আয়নার সামনে দণ্ডায়মান সে। তাই কবির প্রশ্ন-

আমি বিনা তুমি, তুমি বিনা আমি কে যে কার রই? কে যে কারে বই?

অন্যত্র ‘আমি তুমি’ কবিতায় জবাবটা নিজেই দিচ্ছেন :

কখনও আমি আমিই, কখনও আমি তুমিই!!!

এ গ্রন্থের আরও কয়েকটি কবিতায় তুমি-আমি বার বার ধ্বনিত হয়েছে, যা সুফিবাদের প্রধান উপজীব্য। আর সেখানে ‘আমি’ বিলীন হয়ে যায় তোমার মধ্যেÑ কে যে কে তা বোঝার উপায় থাকে না। এখানে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য ওস্তাদ আমীর খসরুর বিখ্যাত সেই কবিতাটির উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না-

মান তু শুদাম তু মান শুদি

মান তান শুদাম তু জাঁ শুদি

তাকস বেগুইয়াদ মান দিগরম তু দিগরি।

[আমি হই তুমি, তুমি হও আমি

আমি হই শরীর, তুমি হও প্রাণ

যাতে কেউ না বলে আমি পৃথক তোমা থেকে

কিংবা আমি তোমা হতে]

এবার তুলনা করুন-

আমি সেতারের তার, তুমি তাতে ছুঁয়ে যাওয়া আঙুল।

আবার তুমি সেতারের তার, আমি তার ছন্দায়িত সুর।

তুমি হৃদয় হলে আমি তার কাঁপন।

তুমি আমি, আমি তুমি, আপনারই আপন।

(হে আমার প্রেমাস্পদ)

সালেহ মুজাহিদের আর একটা বিশেষত্ব হলো কিছু বিমূর্ত চিন্তাকে অনুভূতির আকাশে মূর্ত করে তোলা। শিরোনামটা দেখলে মনে হবে, এ তো দুর্বোধ্য বিষয়। কিন্তু পড়তে শুরু করলে তাতে চিত্রকল্প, উপমা উৎপ্রেক্ষা এবং ছন্দের প্রবহমানতা পাঠকের মন কেড়ে নেয়। এ গ্রন্থের প্রথম কবিতাই এ জাতীয়, যার শিরোনাম ‘মানবতা’। লক্ষ্য করুনÑ

মানবতা, মা তোমায় সাজিয়েছিল সুন্দর

লাল জামা, নীল প্যান্ট, কালো জুতোয়।

নিষ্পাপ তুমি ঘুমিয়ে গেছ চিরতরে

সাগর বেলায় উপুড় হয়ে বালুচরে মুখ গুঁজে।

‘অমরত্বের সেই পথে তুমি আমি’, ‘আজ অনেক আনন্দদিন’ ‘ভালোবাসার পরিক্রমা’ ‘বীজমন্ত্র’ কবিতাগুলো এ ধরনের।

তার চীনা কবিতাগুলো যার কিছু অনুবাদ, কিছু চৈনিক রীতিতে মৌলিক রচনা, সেগুলো অবশ্যই পাঠকের আগ্রহ সঞ্চারের দাবি রাখে। প্রাচীন চীনের শি কবিতার আলোকে ৫ শব্দের গাঁথুনিতে রচিত তার মৌলিক রচনা ‘টংশনের মন্দিরে এক বিকেলে’ কবিতাটি খুবই সুখপাঠ্য। একই রীতিতে রচিত তার লেখা ‘হাজার বছর পরে’ কবিতাটি নিশ্চয়ই একটি উল্লেখযোগ্য রচনা, যা পাঠকের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাবে। কবি সালেহ মুজাহিদের ‘ভগ্নাংশ প্রেম প্রকাশ’ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। একঘেয়ে কিছু কবিতার বিষয়বস্তুর জগতে সালেহ মুজাহিদের কবিতা পৃথক অস্তিত্বের দাবি রাখে। আমি তার কাব্যের বহুল প্রচার কামনা করি।

মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ

সাবেক মহাপরিচালক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :